গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

তন্ময় বসু


চৌকিদার

না চাইলেও মর্জি মতো শব্দটা কানে ঢুকছেই - চাদরে জড়িয়ে চড়া সুরের ডায়ালগ, অঙ্গীভঙ্গীটা উপরি। বেশ মজা লাগে সদানন্দের রকম সকম দেখে। মামারবাড়ির দশহরা পুজোয় ফি-বছর দু রাত যাত্রা বাঁধা ছিল। প্রথম রাত মানে পুজোর দিনে 'লাইব্রেরী'র সামাজিক পালা, পরের রাতে কোটাল পাড়ার ঐতিহাসিক পালা। কতদিন আগে একবার বেনেদের 'ভোমে'র বাবা, সংগ্রাম সিংহের পাঠ করেছিল, পালার নাম কে জানে - মনেহয় 'পানিপথের পরে'সদানন্দ আজও ওটাকেই বেঞ্চমার্ক করে তাবৎ ঐতিহাসিক মাপজোক করে। তবে ঐতিহাসিক চরিত্রদের কেউ গলা নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেই সদানন্দের কানে বাজে "কোথায় সেই গুপ্তপথ রেজা খাঁ?" কালো কাপড় জড়িয়ে হাতে মশাল নিয়ে, পলাশীর ষড়যন্ত্রের সেইদিনগুলোতে ফিরে যেত। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটাও যেন মাঝরাতের অন্ধকার আবহকে ঘিরে আরো ভয়াল চাক্রান্তের জাল বুনতো। তা হচ্ছিল চৌকিদার নিয়ে কথা ---শব্দটা কানে এলেই সদানন্দর 'দুলো' হাড়ি কে মনে পড়ে। ভালো নাম ছিল দুর্লভ, তবে সে কেবল সরকারী খাতায়। গাঁয়ে-ঘরে কে কবে কাকে ভালো নামে ডেকেছে। লম্বা, রোগা পাতলা দুলো হাড়ি ছিল ওদের গাঁয়ে সরকারের অবিসংবাদী প্রতিনিধি। ধুতির উপর লম্বা ঝুলের খাঁকি পাঞ্জাবী, কোমরে ইয়া মোটা বেল্ট তাতে পেতলের পেল্লাই অশোক ছাপ বকলশ্। সরকারী নোটিশ দেবে কে, গাঁয়ে পুলিশ এলে সঙ্গে থাকবে কে, ছোট বড় ঝুট ঝামেলা হলে থানায় খবর দেবে কে, মোড়ে মোড়ে ঢোল বাজিয়ে - ডুগ-ডুগ ডুগ- ডুগ - "শু--নু----গো মশা---ই রা, সরকার বাহাদুরের ---" বলে ঢ্যাঁড়া দেবে কে -- একমেবাদ্বিতীয়ম সেই দুলো হাড়ি। এ হেন দুলো হাড়ির বউকে লোকে ডাকত 'বড় গিন্নী' বলে। বড় গিন্নী অত বড় গাঁয়ের প্রতিষ্ঠিত ধাই-মা। বাঁশের ছিলা কেটে সবসময় রেডী। কচি কাঁচার পেট ব্যাথার নিদান বড় গিন্নীর হাতে। দাঁতে পোকা! এক সের সিদ্ধচালের সিধে, আলু, কচু, ডাল, হলুদ নুন সমেত বড় গিন্নীর শরণাপন্ন, ব্যস, তারপর শুরু হত খেল! ঝোপ থেকে গাছের সরু ডাল ভেঙ্গে দাঁতে ঠেকিয়ে মন্ত্র আওড়ালেই পোকা হাজির। বহুমুখী ক্যারিশমা। সদানন্দের কি দোষ -- মামার বাড়ি গাঁয়ের চৌকিদার পেবা হাড়ি, সেই বা কম কিসে! ভাল নাম প্রভাকর। বাবা নন্দ হাড়িও ছিল চৌকিদার। মাঝারি হাইটে কুঁদো কাটা চেহারা। গায়ে ভীষণ জোর। সদানন্দের এখনও মনে আছে -- সাতাত্তরের সেবার বন্যায় দুর্গা পুজোয় মামার বাড়ি যায় নি। অজয়ের বাঁধ ভেঙ্গে দিদিমার বাপের বাড়ি গ্রাম ধুয়ে সাফ, মা গেলেও সদানন্দ থেকে গেছিল ঠাকুমার কাছে। যথারীতি ষষ্ঠীর সকালে বাইশ কিমি পথ হেঁঠে, পেবা হাড়ি হাজির, সদানন্দকে নিয়ে যেতে। তারপর মুড়ি টুড়ি খেয়ে বারান্দায় সেই যে সদানন্দকে কাঁধে বসাল, চলল হুম হুম করে পথ হাঁঠা। তখন নদী পেরোতে হত ছোটবেলুনের ঘাটে, পানসি করে। সেই একবার নামিয়ে ছিল, তারপর আবার একেবারে মামার বাড়ির বারান্দায়। সদানন্দের দোষ বলতে ওই - ভুলতে না পারা --, অমন বর্ণময় চৌকিদার চরিত্রদের পাট, অন্য কেউকে সে এ জীবনে দিতে পারবে না।