গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

কৃষ্ণা দাস


ভুবা

  দেখিস বাবা মাথায় ফেলিস না ।
  তুমি বসে বসে দেখো পিসি, আমি সব ঠিকঠাক নামাব ।
  তবু সাবধানে নামারে,দেখেশুনে বাবা ।
  ও পিসি তুমি দেখ না.বলতে না বলতে বিতানের পায়ের তলার টুল গেল নড়ে আর ওর হাতে ধরা টিনের জং ধরা ছোট্ট বাক্সটা বিকট শব্দ করে পড়ে গেল মেঝেয় মুহূর্তে ভেতরের কাগজ পত্র ছড়িয়ে পড়ল ঘরময় আনন্দিতা চমকে উঠে বিতানকে জড়িয়ে ধরে ফেলল মুহূর্তের পতন থেকে রোধ পেয়ে পিসির কাঁধ ধরে নেমে এল নীচে ।
  দেখেছ ছেলের কাণ্ড, কী অঘটনটাই না ঘটছিল এখন, খুব বাঁচা বেঁচেছিস তুই।
  দুস্ পিসি, আমি ঠিক লাফিয়ে পড়তাম, তুমি পাশে ছিলে বলেই তো লাফালাম না ।
   অনেক হয়েছে বাবা, তুই যা আর তোকে ডাকব না ।
   বিতান অপরাধী মুখ করে মেঝে থেকে ছড়ানো কাগজ গুলো তুলে টিনের বাক্সে ভরতে ভরতে বলল, “তুমি এতবার সাবধান করলে বলেইতো অন্যমনষ্ক হয়ে গেলাম ।
   ওরে আমার বীরপুরুষ রে, নে হয়েছে এবার পালা, আর তোকে খেলা থেকে ডাকব না ।
   আর আমার গিফ্ট?”
    আনন্দিতা ব্যাগ খুলে একটা হাজার টাকার নোট নিয়ে বললএতে তোর ভিডিও গেম হবে না ?”
    বিতান ছোঁ মেরে হাত থেকে নোটটা নিয়ে বলল, “সবটা?”
    আনন্দিতা ঘাড় নাড়তেই বলে, “খুব হবে পিসি । তোমায় ম্যগনাম খাওয়াব ।
   ও কী রে বাবু ?”
   ম্যাগনাম ,ম্যাগনাম? খাওনি? আইসক্রিম গো আইসক্রিম, জিভে দিলে মনে হবে পুরো সগ্গে আছো, ঘ্যাম খেতে, তোমায় খাওয়াব ।বলেই ধাঁ।
     আনন্দিতা বিতানের চলে যাওয়া দেখে হেসে ফেলল । ছোটবেলায় কত অল্পেই না খুশি হওয়া যায় ! আজ এত দিন পরে মনে হচ্ছে বড় হয়ে অনেক পেয়েও খুশির পরিমাণ কিছুতেই ছোটবেলার খুশির সীমা ছুঁতে পারে না ।
    এ বাড়িতে আজ সকালে আট বছর পরে আসা । বাবা মারা যাবার পর আর আসা হয়নি । কার জন্যেইবা আসবে । শৈশবে মা চলে যায়, ভালো করে তাকে মনেও নেই, ছোট বেলায় ক্যান্সার কথাটা শুনেছিল, মার নাকি তাই হয়েছিল । তখন সবে বছর নয়, দাদার চোদ্দ, সে এক দিন গেছে বটে, বড় অসহায় তখন ওরা ।
             এবারের আসাটা হঠাৎই । তাও হয়তো আসা হত না, নেহাত দাদা ইউএসএ থেকে চট করে আসতে পারছে না তাই দায়িত্ব পড়েছে আনন্দিতার ওপর । আসলে দেড়শ বছরের শরিকি এই বাড়ি অবশেষে আর পাঁচটা বাড়ির মতই পঞ্চত্ব পাবে । এমনিতেই এ বাড়ির জির্ণ ভগ্ন দশা, পুরোসভা বিপদজনকনোটিস টাঙ্গিয়ে গেছে ।শরিক যারা ছিল বহু আগে, একে একে ছেড়ে গেছে এ বাড়ি। শুধু জাঠতুতো এক দাদার অবস্থাটা ভালো নয়, সেই পরিবার নিয়ে ভিটে আগলে নিচের ঘরে পড়ে আছে । এ বাড়ি ভেঙ্গে এখান বহুতল হবে। দীর্ঘ দিনের বচসা সামলে সব শরিককে প্রমোটর এক জোট করতে পেরেছে । এই তরফে দুটো ফ্লাট আর কিছু ক্যাশ দিচ্ছে প্রমোটর । বাড়ি ভাঙ্গা হবে শীঘ্র, অগত্যা যার যা আছে বের করে নিতে বলেছে । দাদা বলেছে সব বেচে দিতে । পুরোনো জিনিসপত্র যা আছে সকালে একজন লোক এসে দর দিয়ে গেছে । কাল এসে নিয়ে যাবে । আনন্দিতার ভেলোরের ফার্নিস্ড ফ্লাটে সব কিছুই যথাযথ, কোন বাহুল্যের বালাই নেই, আর আসবাবপত্রে নষ্টালজিয়াও তার নেই, অগত্যা বিক্রি করে দিতেই হচ্ছে ।
      একটা অকাজের ছোট টিনের বাক্স বাঙ্কে তোলা ছিল । আজ ভাবল নীচের তলায় জাঠতুতো দাদার ছেলেকে ডেকে বাঙ্ক থেকে ওটা নামায়, কিন্তু নামাতে গিয়ে যা কাণ্ড হচ্ছিল, ভাগ্যিস ওকে ধরে ফেলেছিল, তা না হলে কী অঘটনটাই না ঘটত!
             কাগজ গুলো তুলতে গিয়ে কিছু ইনল্যান্ড চিঠি দেখল আনন্দিতা । কার চিঠি? আনন্দিতা চিঠির ওপরে নিজের নাম দেখল আনন্দিতা চৌধুরী’, মানে সে নিজে? কৌতুহলে দ্রুত চিঠি খোলে আনন্দিতা । ওপরে হেডিং বনি”, নীচে ভুবা মুহূর্তে তার সারা শরীর বেয়ে ইলেকট্রিক শক বয়ে গেল । সে পলকে চিঠি খুলে অতি দ্রুত তারিখ হিসাবে সাজিয়ে  পড়তে থাকল ।
 বনি 
      তোকে প্রথম চিঠি আমার, তুই কি ভেবেছিলি আমি কখনো তোকে চিঠি লিখব? ভাবিসনি তো ? আমি এখন নিলডি পাহাড়ে বসে লিখছি । সেই যে পাথরে তুই আর আমি বসে ছিলাম সেই পাথরে বসে আছি । কাল তোরা চলে গেলি, আমিও চলে যাচ্ছিলাম, না তোদের সাথে যেতে চেয়ে ট্রেনের পাশে তোর হাত ছুঁয়ে দৌড়টা শুরু করেছিলাম বটে তারপর হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল আর স্টেশনও শেষ হয়ে গেল, পড়ে যাচ্ছিলাম চাকার তলায়, একটা কাকু হাত টেনে বাঁচিয়ে দিল । বনি আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি কেন বলত ? খুব কষ্ট হচ্ছে বনি, লিখতে পারছি না । কেন বনি ?
     ভালো থাকিস, ভালোবাসি, যেমন রক্ত মাখা হৃদপিন্ড লাবডুবকরে বুকের ভেতর, তেমনি করে তুই, সবসময়, দিনে রাতে ।
        ভুবা
     বনির বিস্ফারিত দুচোখে ধীরে ধীরে জলচ্ছ্বাস দেখা দিল, প্রাণপণ চেষ্টাতেও তার বহির্গমণ রোধ করতে পারল না, চোখের নোনা জল গাল বেয়ে নেমে এল বুকে । সে চিঠি পড়তে পড়তে হারিয়ে গেল ফেলে আসা কুড়ি বছর আগে ।
    বনি এর নাম ভুবা এ পুরুলিয়া বয়েজ এর ফার্স্ট বয়, মাধ্যমিকে ফিফ্থ। এর থেকে জেনে নাও কী ভাবে এগোবে, এখনো সময় আছে হাতে ছমাস, ঠিক মতো এগুলে তুমিও মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করবে ।বাবা পরিচয় করিয়ে দেয় এক মাথা ঝাঁকড়া চুলো আর উদাস দৃষ্টির লম্বাটে ছেলের সঙ্গে।
    বনি ঘাড় নাড়ে, ভুবার দিকে তাকায় ।
    ভুবা তাকিয়েছিল দূরের ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলের দিকে, যেন মনে হল সে আনন্দিতাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, সে তাকাচ্ছিল না । ব্যাপারটা সহজ করার জন্য বাবা দূরের পাহাড় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ওটা কী পাহাড়?”
    একমুখ উচ্ছ্বাস নিয়ে সে ঘুরে তাকিয়ে বলে ওটা? ওটা পাহাড় না টিলা, নিলডি ।
   ভুবা তুমি কি পারবে আমাদের গাইড হতে ?”
   একটু দাঁড়ান কাকাবাবু বাড়িতে বলে আসি ।
   আচ্ছা সে হবেখন, এখন তো যাচ্ছি না, তুমি রাজি তো ?”
     ভুবার বড় বড় চোখ দুটো হেসে উঠল । সে নীরবে মাথা কাত করে সম্মতি জানাল ।
   আচ্ছা তোমরা গল্প কর, আমি ও দিকটা দেখি ।বাবা গেষ্ট হাউসের বাগানের চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন লাগোয়া বিডিও অফিসের দিকে ।
    ভুবার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল বনির । ভুবা অদ্ভূত বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল বনির দিকে । বনি একটু হাসল । ভুবা থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল-
   তোমার প্রিয় সাবজেক্ট কী ?”
  ম্যাথ, তোমার ?”
  আমারও । তোমার প্রিয় লেখক ?”
  অনেকে ,তার মধ্যে সব চেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ।
  আমারও, তুমি গান ভালোবাস ?”
  খুব ।
  আমিও, এবার তুমি জিজ্ঞেস কর ।
  আমি?” বনি চিন্তায় পড়ল কী জিজ্ঞেস করবে । ভুবা তো সব কটা প্রশ্নই করে ফেলেছে যা বনি করতে পারতো ।
  হ্যাঁ তুমি ।
  তুমি চুল আঁচড়াও না কেন ?” বনি ফস করে জিজ্ঞেস করে বসে ।
  হা হা হা!”
  হাসছো কেন ?” বনি ভ্রূ কুঁচকালো ।
  এমনি ।
  এমনি না, বল?”
  ভাল্লাগে না ।
  এ আবার কী? দাঁত ব্রাশ কর ?”
  হা হা হা!” ভূবা আবার জোরে হেসে উঠল ।
  আবার? আমি চলে যাব কিন্তু?”
  আরে না না না ,হ্যাঁ করি, ব্রাশও করি, স্নানও করি, সাবান শ্যাম্পূও করি, শুধু চুল আঁচড়াতে ইচ্ছা করে না ।
   তবে নেড়া হলেই পার ।বনি ঠোঁট উল্টে বলল ।
    এবার দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল ।
   তোমরা কদিন থাকবে এখানে ?” ভুবা জিজ্ঞেস করল ।
   জানি না, বাবা অফিসের কী একটা কাজে এসেছে । বাবা বলছিল এসেছি যখন তখন দু দিন থেকে জায়গাটা ঘুরেই যাইতোমাদের বাড়িটা কোথায়”?
   এই পাশেই । তোমাদের গেস্ট হাউসের পেছনে ।
   বাড়িতে কে কে আছেন?”
   দিদি ।
   বাবা, মা?”
   আমার বাবাকে আমি জন্মের আগেই হারিয়েছি, মা দু বছর আগে……
   আমারও মা নেই ।ভুবাকে থামিয়ে দিয়ে বনি বলে উঠল । তার চোখ দুটো কেমন নরম হয়ে গেল ।
    দুজনেই এবার চুপ । একটা কাঠবেড়ালি বাগানের শাল গাছের ডাল বেয়ে নেমে এল নীচে, সামনের দুটো পা এক করে কিছু একটা ধরে কুট কুট করে খাচ্ছে । বনি এক মনে খাওয়া দেখছে । ভুবা দেখছে বনিকে । বনির আড় চোখে দেখে অস্বস্থি হল । সে সহজ হবার জন্য বলল-
     এই তোর নাম ভুবা কেন রে?”
      ভুবা চমকে ওঠে।
     বল?” বনি আবার প্রশ্ন করে ।
     আমার ভালো নাম ভবার্ণব, তার থেকে ভবা, ভবা থেকে ভুবা ।  ভুবা গম্ভীর হয়ে বলল ।
     ইশ ! কী নামের ছিরি ভবার্ণব, মানে কী ?” বনি মুখ বিকৃত করে বলল ।
     আরে ভব+অর্ণব কর না ।
     ম্যাগো, ভব সমুদ্র, ছ্যাঃ ।বনি আরো বিকৃত করল মুখ যেন কুইনাইন মুখে পড়েছে ।
      ভুবার মন খারাপ হয়ে গেল, সে মিন মিন করে বলল, “কী করব? আমার দাদু নাম দিয়েছে যে, আমার তখন কী করার ছিল বল?”
     তা ঠিক, শোন, তোর ভুবা নামটা বেশ, আমি তোকে ভুবা বলেই ডাকব, ঠিক আছে ?” বনির ভুবার মুখটা দেখে নরম করে বলল ।
      ভুবা হাসি মুখে ঘাড় নাড়ে ।

    আনন্দিতা প্রাণপণ চেষ্টায় স্মৃতি থেকে বর্তমানে ফেরে।তার পর রুদ্ধশ্বাসে দ্বিতীয় চিঠি খুলে পড়তে লাগল।
         বনি
         কী করছিস বনি? এখন দুপুর, আমি নীলডিতে বসে এ চিঠি লিখছি । তোর কাছ থেকে একটুও সরে থাকতে পারছি না । বনি আমি কী করি বলতো? সকাল থেকে রাত, রাত থেকে দুপুর বুকের ভেতরটায় এত হাহাকার, এত কষ্ট! বনি আমি কী করি? আজও স্কুলে যাবার নাম করে এখানে চলে এসেছি । বনি তুই বুঝি খুব পড়ছিস ? পড়, খুব পড় আর মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট কর । আমি সবাইকে বলব বনি, আমার বনি দারুণ রেজাল্ট করেছেজানিস বনি আমি এখন চুল আঁচড়াই, সবাই বলে আমি নাকি বদলে গেছি । বলে আমি নাকি বড় হয়ে গেছি, আমার নাকি গাম্ভীর্য এসেছে । ওদের কী করে বলি আমি কষ্টে আছি, আগের মত নেই ? বনি তোকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে, খুব । চিঠি দিস, আগের চিঠিতে ঠিকানা দিয়েছি, এটার নীচেও দিয়ে দেব।
      ভালো থাকিস বনি, ভালোবাসি, এই নিলডি পাহাড়টা যেমন করে মাটিকে আঁকড়ে আছে গভীর ভাবে তেমন করে আমার ভালোবাসা তোকে।
                     ভুবা

    পশ্চিমের জানলা দিয়ে চড়া রোদ এসে পুড়িয়ে দিল আনন্দিতার মন, আনন্দিতার শরীর । দাউ দাউ জলন্ত মনে আনন্দিতার কানে দুর থেকে দুই কিশোর কিশোরীর খিলখিল হাসির শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল ।
  এই ওই দেখ নীলডি, যাবি ওখানে?” ভুবা বলে ।
  ওই পাহাড়ে? ওতো অনেক দূর ।
  ধুস দূর কই? চল দৌড়াই ।
  বাবা?” বনি জিজ্ঞেস করে ।
  কাকাবাবু আসুক পেছনে, আমরা দুজনে দৌড়ে আগে উঠে পড়ি
  চল ।
     তার পর শুধু দৌড় দৌড় দৌড় । দুজনে হাত ধরে শাল শিমুল গাছের জঙ্গল পেরিয়ে ছুটতে লাগল । নীল আকাশের ঝকঝকে রোদ যেন আছড়ে পড়ছে দুজনের গায়ে । বনির উড়ন্ত চুল মুখ ঢেকে দিচ্ছে, অথচ সে যেন মুক্তির আনন্দে সব শিকল ভেঙ্গে উড়ে চলেছে । বুনো কুলের ঝোপে ফ্রক আটকে গেল । ভুবা হাত ধরে টানতেই ফ্যাঁচ করে খানিকটা গেল ছিঁড়ে । বনি ঠোট ফোলাল এমন সুন্দর ফ্রকটা ছিঁড়ে গেল? ভুবা নীচু হয়ে সে ফ্রক জোড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল । না পেরে সে অপরাধী মুখ করে বলল, “দাঁড়া আমি যখন চাকরি করব তখন তোকে আরো ভালো ফ্রক কিনে দেব ।
  দুর বোকা ।বনি ভুবার কথা শুনে ফ্রকের দুঃখ ভুলে হেসে ফেলল।
    ভুবা বনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে হ্যাঁ করে । বনি ভুবাকে এক ঠেলা মেরে দৌড়তে দৌড়তে বলে, “তুই একটা বুদ্ধু, বুদ্ধুরাম ।
    ভুবা দৌড়ে বনিকে ধরে ফেলে, বলে, “বল কেন বুদ্ধু?”
   বুদ্ধু বুদ্ধু বুদ্ধু!” বনি খিল খিল করে হাসতে হাসতে নীলডি পাহাড় ছুঁয়ে দেয় । ভুবা পাহাড়ে উঠতে উঠতে বলে যা বলতে হবে না, আমিও একটা জিনিস বলবো না ।
   বা রে, তুই যখন বড় হয়ে আমার জন্য ফ্রক কিনবি তখন কি আমি ছোট থাকবো? বুদ্ধু, তখন যে শাড়ি পড়ব, বুদ্ধু একটা! কী জিনিস বলবি বল?”
  আবার তুই বুদ্ধু বললি? আমি জিনিসটা বলবো না, যাঃ ।ভুবা রাগ করে বনির থেকে অনেক উঁচুতে উঠে পড়েছে।
   বনি হঠাৎ চিৎকার করে কঁকিয়ে ওঠে । ভুবা পিছনে ফিরে চায়, দেখে বনি বসে পড়েছে পা ধরে । ভুবা দ্রুত নেমে আসে, কাছে এসে দেখে জুতো ভেদ করে একটা ডাকাতে কাঁটা বনির পায়ের তলায় ফুটে আছে, যন্ত্রণায় বনির মুখ বেঁকে যাচ্ছে । ভুবা তাড়াতাড়ি বসে বনির পা নিজের কোলে তুলে নেয়, তার পর বিশেষ কায়দায় কাঁটা পা আর জুতো আলাদা করে । বনি চোখের জল মুছে নেয় । তার পর হেসে বলে, “চল আরও ওপরে যাই ।
  পারবি?” ভুবার চোখে হাসি।
  পারব।বনি আবার পাহাড়ে উঠতে লাগল।
   একদম ওপরে উঠে বনি হাঁফাতে লাগল । ভুবা তার হাত টেনে একটা পাথরে বসাল । দুজনেই দেখল অনেক নীচে বাবা স্থানীয় এক সাঁওতালের সাথে কথা বলছে ।
    বনি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, “বাবা.......!”
সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসতে লাগল বাবা -বাবা বাবা !”
    বাবা নীচ থেকে হাসি মুখে হাত নাড়ল দুজনের দিকে।
    ভারি মজা হল বনির, সে আবার চিৎকার করে, “ভুবা....!”
    প্রতিধ্বনি হয়ে তা ফিরে আসে মজা পেয়ে যায় দুজনে, বনি চিৎকার করে ভুবা............!”
    ভুবা চিৎকার করে বনি..............!”
    সমস্ত পাহাড় সড়গরম হয়ে যায় । চারি দিকে ভুবা’, ‘বনিশব্দ দুটো আর খিলখিল হাসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় ।
    বনি একটা সময় হাঁফিয়ে যায়, বড় পাথরের ওপর বসে পড়ে বলে,-
   তুই যাবি কোলকাতা, আমাদের বাড়ি?”
   নারে দিদি যেতে দেবে না ।
   দুর বোকা এখন কেন? তুই উচ্চমাধ্যমিক দে, ভালো রেজাল্ট কর, কোলকাতায় পড়াশোনা করবি, তখন যাবি ।
   আমার পড়তে এখন ইচ্ছা করে না, বই এর পাতায় শুধু তোর মুখ দেখি ।ভুবা মাথা গোঁজ করে বলল ।
   দুস এসব ভাবিস না, ভালো রেজাল্ট কর, দেখবি দিদি কত খুশি হবে, সবাই কত খুশি হবে । তোকে কত কষ্ট করে দিদি পড়াচ্ছে বল?” বনি খুব নরম স্বরে বলল ।
   দিদি সরকারি স্কুলে পড়াচ্ছে, আর আমি টিউশনও নিই না, স্কুলের স্যারের থেকেই সব জেনে নিই, খরচ কই?”
   তবুও রে, ভালো রেজাল্ট করলে তোরই তো থাকবে, নাকি?” বনি বোঝাতে চেষ্টা করে ।
   শোন বনি, কাল তোরা কোথায় যাচ্ছিস রে?”ভুবা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে
   পাঞ্চেত, মাইথন ড্যাম দেখবো আর পাহাড় গুলোয় উঠব ।
   আমিও যাব ।
   না, স্কুল অ্যাবসেন্ট করে নয়, কী জিনিস বলবি বলছিলি? বল?”
   কাল বলবো, তার আগে তোকে একটু দেখিভুবা অদ্ভূত ভাবে বনিকে দেখতে লাগল
    আনন্দিতা লজ্জা পেল, উঠে দাঁড়িয়ে সে দ্রুত টিলা থেকে নামতে থাকল । পেছন পেছন ভুবাও চিৎকার করতে করতে নামতে লাগল, “বনি দাঁড়া, পালাস না, দাঁড়া বনি, আর তোকে দেখব না, প্রমিস !”

     জানলা দিয়ে পড়ন্ত রোদের শেষ আলো আনন্দিতার মুখ স্পর্শ করল । তখন আনন্দিতার সমস্ত মন জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বনি দাঁড়া, পালাস না, দাঁড়া বনি, আর তোকে দেখব না, প্রমিস !” দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তৃতীয় চিঠি খুলল।
 
      বনি
      তুই কী আমার চিঠি পাসনি বনি? কই একটাও তো চিঠি দিলি না? তবে কি খুব পড়ছিস এখন? বনি একটা চিঠি দিবি? প্লিজ বনি একটা চিঠি দে, কিছু লিখতে হবে না শুধু লিখিস ভুবা তোকে ভালোবাসিব্যস, ওতেই হবে । বনি দিবি তো? আমি ভালো নেই বনি, পড়ায় মন দিতে পারছি না, স্কুলের স্যররা খুব বকছে, দিদিকে স্কুলে ডেকে জানিয়েছে, দিদিও খুব বকছে, আমি কী করব বনি? আমাকে বলে দে ।
     যা কিছু ভালো সব তোর হোক ।
     ভালো থাকিস, ভালোবাসি, এক সমুদ্র ভালোবাসি তোকে ।
                                          ভুবা

     চিঠি পড়ে আনন্দিতার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল । অসহ্য যন্ত্রণায় সে ছটফট করে উঠল । এ চিঠি তাকে কেউ দেয়নি । আজ প্রথম সে এ চিঠি পড়ছে । কেন সে এ চিঠি গুলো পায়নি ? তবে কি বাবা সরিয়ে রেখেছিল? নাকি দাদা? কিন্তু কেন? অভিমানে আবার দু চোখে জল ভরে গেল । কেন এমন করল ওরা? ভুবা বা আনন্দিতা ওদের কী ক্ষতি করেছিল? চিঠিগুলো পরম মমতায় সে গালে ছোঁয়ায়, চোখে ছোঁয়ায়, চুমু খায় । সে কী বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে? সে কী নষ্টালজিয়ায় ডুবে যাচ্ছে? বনি চোখ বন্ধ করে দেখল রোগা লম্বা ভুবা সাদা জামা সাদা প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে।
  ড্রাইভারজি জিপ রোকো ।
   ভুবার গলা পেয়ে বাবা বনি দুজনেই সামনে তাকিয়ে দেখে পিঠে স্কুল ব্যাগ স্কুল ইউনিফর্ম পরে ভুবা দাঁড়িয়ে ।
   বাবা হাক দিলো আরে ভুবা যে ।
 কাকাবাবু আমি কি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি?”
 কেন নয়? কিন্তু তুমি যে স্কুলে যাচ্ছ?”
 আজ স্কুল যাবো না, আমাদের ছুটি ।
 কিসের ছুটি ?”
 আসলে ঠিক ছুটি নয়, ইলেভেনের ক্লাস হবে না, আজ হেড স্যরের ফেয়ারওয়েল ।
 বেশ বেশ, কিন্তু বাড়িতে না বলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে ?”
 এই ভুলু এদিকে শোন ।ভুবা হঠাৎ দুরের এক ছেলেকে হাতের ঈশারায় ডেকে তাকে স্কুল ব্যাগ দিয়ে নিচু স্বরে কিছু বলেই পিছনে বনির পাশে লাফিয়ে উঠে পড়ল ।
  বাড়িতে না বলে এলি, দিদি যদি রাগ করে ?” বনি বড় বড় চোখ করে বলে । ভুবা উত্তর দেয় না । সে চুপ করে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
  তুই না এলে ভালো করতিস ।বনি আবার বলল ।
  থাক থাক আর বলতে হবে না, এসেই যখন পড়েছে তখন চলুক, এক যাত্রায় দুরকম ভাবতে নেই । আজ আমরা অনেক কিছু দেখব, তাই না ভুবাবাবু?” বাবার কথায় ভুবা মাথা নাড়ে, কিন্তু তার মুখটি ছিল মলিন ।
    সারা দিন জিপে করে পাঞ্চেত মাইথন ড্যাম দেখা হল, অনেক জঙ্গল নদী পাহাড় ঘোরা হল । নাম না জানা একটা পাহাড়ে ভুবা নিয়ে চলল ওদের । সেখানে নাকি পাহাড়ের ফাটল দিয়ে কিছুটা গেলেই সুন্দর একটা জায়গায় পৌছানো যায় । বাবা শুনে উৎসাহ দেখালেন, ওরা চলল সেই দিকে । আগে আগে ওরা দুজন পিছনে বাবা ।
    কিছুটা ঢুকে ভুবা ফিসফিস করে বলল, “আমি না এলে তোর ভালো লাগত ?”
   না, কিন্তু..
   জানি তো তাই এলাম ।
   কিন্তু এত অন্ধকার ! আমি আর ঢুকব না ।
   আমিতো আছি, তোর ভয় কী?”
   আমার ভয় করছে ।
   আমার হাতটা ধর বনি ।
   ধরেছি।
   বনি আর ভয় করছে?”
   না ।
   ধরে থাক আমায়, আর এগিয়ে চল ।
    আচমকা ভুবা অন্ধকারে বনিকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে গালে চোখে ঠোঁটে চুমু খেতে থাকে, বনি কিছু বুঝে ওঠার আগে আবার, আবার । বনি ফিস ফিস করে বলল, “এই কী করছিস? কী করছিস ? ছাড়, ছাড় আমায় ।
   না ছাড়বো না।ভুবা পাগল, সে আরো দৃঢ় ভাবে বনিকে বুকে চেপে ধরল, তার গায়ে যেন অসুরের শক্তি । তার শরীর যেন গরম লোহা । বনি হাঁসফাঁস করে উঠল । সে সব শক্তি দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না ।
    বনি ফিস ফিস করে বলে উঠল, “এই ছাড়, ছাড়, বাবা পিছনে আছে, বুঝতে পেরে যাবে, ছাড় লক্ষ্মীটি ।
   আগে বল তুই আমাকে ভালোবাসিস ?”
    তড়িঘড়ি বনি বলে ওঠে, “ভালোবাসি, খুব ভালোবাসিতার পরেই চিৎকার করে বাবাকে শুনিয়ে বলল এই ফাটল দিয়ে কোথায় যাওয়া যায় রে?”
     ভুবা বনির কপালে চোখে মুখে ঠোঁটে বুকে পাগলের মত চুমু খেতে খেতে চিৎকার করে বলে উঠল খুব সুন্দর বনি, খুব সুন্দর!”
     বনি কী এক আবেশে গলে পড়তে লাগল। সমস্ত রক্ত কণিকারা অবাধ্য দৌড় শুরু করেছে, কী এক যন্ত্রণা আর ভালোলাগা তাকে এক সাথে দংশন করতে লাগল, সে দু হাতে ভুবার চুল খামছে ধরল । মনে হচ্ছে আরো কিছু সময় এই অন্ধকার থাকুক, আরো কিছু সময় এই যন্ত্রণা থাকুক, কিন্তু সামনে আলোর আভাস । সে ভুবাকে সংযত করতে বাবাকে শুনিয়ে চিৎকার করে বলল হ্যাঁ ওই তো আলো দেখা যাচ্ছে! আমরা এসে গেছি ।
   ছিটকে সরে গেল ভুবা । সে কেমন যেন ভাবলেশ হীন হয়ে তাকিয়ে রইল বনির দিকে, তার চোখ লাল, কেমন ঘোর লাগা, নাসারন্ধ্র দিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস।
   বনি একটা ঠেলা মেরে সরিয়ে তার বেশভুষা ঠিক করে নিয়ে আলোয় বেরিয়ে এলো ।
   ভুবা বাইরে এসে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল-“ভয় করল?”
  না ।বনি ভুবার দিকে পেছন করে ফুল দেখতে লাগল ।
  তবে?”
  তুই হাত ধরলি যে ।
  আর? আর কী করলাম?” ভুবার চোখে ঘোর। সে বনির সামনে এসে দাঁড়াল ।
  আর কিছু না, যাঃ ।বনি লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে তাকাল ।
  বনি, তুই আমাকে এই রকম সবসময় হাত ধরতে দিবি”?
  ভ্যাট্!”
  কেন দিবি না?”
  কী সুন্দর ফুল রে এখানে, কী সুন্দর প্রজাপতি!”
  কেন দিবি না? বল?”
  আমি জানি না যা, বাবা আসছে কিন্তু পেছনে ।বনি আবার সাবধান করে ভুবাকে।
   তোরা কাল চলে যাবি?”
   হ্যাঁ ।
   আমাকে ভুলে যাবি নাতো কোলকাতায় গেলে?”
   না কক্ষনো নয় ।
   ঠিক মনে রাখবি?”
   হ্যাঁ ।
   যদি ভুলে যাস?”
   যাব না রে ।
   প্রমিস?” ভুবা হাত বাড়ায়। বনি হাতের ওপর শব্দ করে হাত রাখে
   প্রমিস!”
                              
    পশ্চিমের জানলা দিয়ে পড়ন্ত বেলার রোদ চৌকাঠ পর্যন্ত প্রলম্বিত হল । বাকি আধা ঘর ধীরে ধীরে নিরাশক্ত আধা আলো আধা অন্ধকারে ডুবে গেল । মেঝেয় শুয়ে জানলা দিয়ে আগত রশ্মিতে উড়ন্ত ধুলিকণাদের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে আনন্দিতা চোখ বন্ধ করল । তার সমস্ত শরীর মন জুড়ে ভুবা । চোখ খুলল বুক ভরে শ্বাস নিল, তার পর ভুবার চতুর্থ চিঠি খুলল।
     বনি 
      ভেবেছিলাম আর তোকে চিঠি লিখবো না । কিন্তু থাকতে পারলাম না । বনি কেন তুই এমন করলি? না তোকে আর বিরক্ত করবো না, এটাই শেষ চিঠি । আমি বুঝে গেছি তুই আর আমাকে ভালোবাসিস না । তাই আর তোকে চিঠি দেব না, তুই ভালো থাক সুখে থাক । কিন্তু কেন আমাকে এমন করলি? কেন প্রথম থেকে বলিসনি তুই আমায় ভালোবাসিসনি? বনি এখন আমি কী করি? আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। দিদি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে হোস্টেলে দিয়েছে । এখানে সবাই আমায় উঠতে বসতে জ্ঞান দেয় ।আমি কী ছোট বাচ্চা? দিদি নিতে আসে না । আমি এবার এখান থেকে পালাব, আর আসব না। বনি কেন এসব তোকে লিখছি? কেন?
    চলি, সুখে শান্তিতে থাকিস, এক আকাশ ভালোবাসা রেখে দিলাম।
                                       ভুবা

    জানলার রডে একটা পাখি এসে বসেই আবার ফুরুৎ করে উড়ে যায়। উড়ে গেল আনন্দিতার মনটাও। হু হু করা যন্ত্রণা নিয়ে চিঠিটা হাতে করে জানলা দিয়ে অসীম শূন্যে তাকিয়ে রইল । জীবন বড় বিচিত্র । জীবনের চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ।আনন্দিতা চৌধুরীর সব আছে, বাড়ি গাড়ি খ্যাতি সম্মান, নেই শুধু সুখ, নেই শান্তি । জীবনটা কেন এমন হল ? এ যেন একটা চলন্ত ট্রেন, যার ভেতরে সব আছে শুধু থামার কোন স্টেশন নেই । আনন্দিতা আবার পিছিয়ে গেল কুড়ি বছর।
   
   ট্রেনটা ছেড়ে দেবে, ছুটতে ছুটতে ভুবা এল, সে হাঁফাচ্ছে।
  সকাল থেকে কোথায় ছিলি বাবা ? তোকে খুঁজছিলাম, আবার কবে দেখা হবে না হবে!বাবা তাকে  জানলা দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
   উত্তরে সে কী একটা বিড়বিড় করে বলল বোঝা গেল না ।
   বাবা ঠিকানা লিখে তার হাতে দিয়ে বললেন কোলকাতায় এলে আমাদের বাড়ি অবশ্যই আসবে, মন দিয়ে পড়বে, মানুষের মত মানুষ হবেসময় অভাবে বাবার যা কিছু বক্তব্য একবারেই বলে গেলেন ।
   সে ঘাড় নাড়ল । ট্রেন হুইসেল ছাড়ল । বনি জলভরা চোখে তার দিকে তাকায় । সে দ্রুত পকেট থেকে পেনসিলে তার আঁকা একটা সুন্দর লতাপাতা আঁকা কার্ড বনির হাতে ধরিয়ে দিল । ট্রেন চলতে শুরু করলে সে ট্রেনের পাশে পাশে দৌড়ল । একটা সময় পর ট্রেন তাকে রেখে এগিয়ে গেল ভবিষ্যতে চিরতরে । বনির দু চোখ দিয়ে বাবার সামনেই টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল । নিজেকে লুকাতে কার্ডটা হাতে নিয়ে জানলার বাইরে চলন্ত গাছগুলোর দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । তার পর চোখটা মুছে ধীরে ধীরে কার্ডটা খুলল, সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা বনিকে ভুলবো না, বনিও যেন  ভুবাকে না ভোলে কোন দিন, বনির জন্য ভুবা আছে, ভুবা থাকবে, চির দিন চির কাল । চিঠি দিও ।
   
    সেই শেষ ভুবাকে দেখা । কার্ডখানি অতি যত্নে সঞ্চয়িতার পাতায় রেখেছিল বহুদিন, তার পর একদিন আর খুঁজে পেল না, অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না । কে নিল আজও অজানা ।ভুবার চিঠি গুলোর একটাও সে পায়নি । কেউ একজন এ চিঠি সরিয়ে রেখেছিল, কে সে? দাদা না বাবা? পুরুলিয়া থেকে ফিরে সেও চিঠির আশা করত, কত চিঠি লিখেও ঠিকানার অভাবে পাঠাতে পারেনি, ছিঁড়ে ফেলেছে । আর অভিমানে ছটপট করেছে, পড়ায় মন দিতে পারেনি । মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল সাংঘাতিক খারাপ হল । বাড়িতে দাদার বকুনি খেল, বাবা কেন জানি কিছুই বলল না । দাদা বনির পড়াশোনার ভার নিল ইলেভেন থেকে, ঊচ্চ মাধ্যমিকে অসাধারণ ফল হল বনির । সে মেডিকেলে চান্স পেল, ধীরে ধীরে ভুবার ছায়া সরে গেল বনির জীবন থেকে । শুধু পড়া আর পড়া নিয়েই জীবন এগিয়ে চলল । বড় হয়ে ডাক্তার হল । তার পর সে ভুবার খোঁজ করতে পুরুলিয়ায় গেল, কিন্তু আশ্চর্য, কোন খোঁজই পেল না তার । তারা সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কোথায় কেউ তা জানে না।
                          
     জানলা দিয়ে আসা অল্প আলোয় ভুবার শেষ চিঠি খুলে পড়ে আনন্দিতার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল । সমস্ত বিশ্বজগৎ ডুবে গেল নিবিঢ় যন্ত্রণায় । সন্ধে ঘনিয়েছে, পাখিদের কলতান কানে আসছে । সে ঘরে আলো জ্বালাল না, অন্ধকারে মেঝেয় উপুড় হয়ে শুয়ে প্রগাঢ় বেদনায় ধিকি ধিকি পুড়তে থাকল । দেখতে পেল ভুবা জঙ্গলের আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে বনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

    হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল, দাদার নাম্বার । আনন্দিতা ধরতেই দাদা বলল বনি কী খবর? সব ঠিক আছে তো? কোন সমস্যা নেই তো?”
   দাদা তুই টিনের বাক্সটা দেখেছিস?”
   মানে?”
   হ্যাঁ রে যেটায় ভুবার চিঠি ছিল, বাঙ্কে তোলা ।
   এত দিন পর এসব নিয়ে……তুই ঠিক আছিস তো বনি?”
   কেন? দাদা কেন?”
   বিশ্বাস কর বনি, ভেবেছিলাম তোর পড়াশোনায় ক্ষতি হয়ে যাবে, তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে ।
   হয়ে তো গেছে দাদা, .নষ্ট………….তোর জন্য,……………. আমার আর ভুবার, দুজনেরই 
   বনি প্লিজ, এতদিন পর এসব ইমোশন ছাড় লক্ষ্মী বোন আমার!”
   ইমোশন?..... ছেড়ে দেব?............ দাদা ঘুমের মধ্যে আজও ভুবাকে খুঁজি রে, পাই না,…… কী করে ছাড়তে হয় বলবি দাদা?”
     ওপাশ থেকে চুপ।
    দাদা আমারও তোর মত একটা সংসার হত রে, হ্যাপি ফ্যামিলি, কিন্তু হল না, তোর অত্যাধিক ভগিনী প্রীতির জন্য । নিজেকে কী করে ক্ষমা করবি দাদা?... বল? বল দাদা?”
    ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে গেল।
    গাঢ় অন্ধকারে আনন্দিতা ভুবার শেষ চিঠিটার প্রতিটা শব্দকে দেখতে পেল । তার দুচোখ বেয়ে জলধারা নীরবে গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়।
      বনি
      শেষ পর্যন্ত আমাকে মানতেই হল তুই একটা ঘৃণ্য খেলা খেলেছিলিস আমার সাথে ।  এ খেলায় তুই জিতেছিস আর আমি সর্বশ্রান্ত হয়েছি । হয়তো কোলকাতার মেয়েরা এমনই হয় । হয়তো এ ভাবেই ছেলেদের ইমোশন্যালী শ্লো পয়জন করে জীবনটাকে তছনছ করে দিয়ে আনন্দ পায় ।
    বনি আরো শুনে খুশি হবি তুই; আমি উচ্চমাধ্যমিক দিতে পারিনি । টেস্টে জোর করে বসাল দিদি, কিন্তু ফেল করলাম । আমি হোস্টেল থেকে পালিয়ে এলাম আর দিদি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল ।
     আমি এখন চুল আঁচড়াই না, দাঁত মাজি না, স্নানও করি না, এলাকার বাজে ছেলের লিস্টে আছি । আদিবাসী ছেলেদের সঙ্গে ঘুরি, হাড়িয়া খাই, আর ওদের মেয়েদের সাথে শুই । বনি প্রত্যেক রাতে ওদের মধ্যে তোকে খুঁজি রে, পাই কই?
    চলি তাহলে, ভালো থাকিস, সুখে আর শান্তিতে থাকিস । এক পৃথিবী ভালোবাসা রেখে গেলাম তোর জন্য।
                                                                                                                  ভবার্ণব