গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

শংকর দেবনাথ


ইঁদুরছানা ভয়ে মরে
            

-
চল ছানারা, এবার আমরা বেরিয়ে পড়ি। সব মানুষজন ঘুমিয়ে পড়েছে। চল...
ইঁদুর মা তার ছানাদের বলে।

গভীর রাত। শুনশান চারপাশ। অন্ধকারে গুটিগুটি পায়ে ছানাপোনাদের নিয়ে মা-ইঁদুর বেরিয়ে পড়ে খাবারের খোঁজে।

রান্নাঘরের পেছনের কাঠ-ঘরে মাসখানেক আগে ছানাদের জন্ম  দিয়েছিল মা-ইঁদুর। ধীরে ধীরে ছানাদের চোখ ফুটেছে। চলতে শিখেছে।
আগে রাতে ওদের বাবা খাবার জোগাড় করে আনত। আর মা পাহারা দিত। কিন্ত ক'দিন আগে ওরা পিতৃহারা হয়েছে।
গৃহস্বামীর পাতানো কলে আটকা পড়েছিল বাবা-ইঁদুরটা। তারপর মানুষরা তাকে বস্তাবন্দী করে জলে ডুবিয়ে ডুবিয়ে নির্মমভাবে মেরে ফেলেছে।


সেই দুঃখ আর ভয় এখনও ইঁদুর মা আর তার ছানাদের তাড়া করে ফিরছে। দু'রাত তো ওরা বেরই হয়নি। কিন্তু খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। সবকিছুকেই ভুলিয়ে দেয়। বাঁচার জন্য তাদের রাতের অন্ধকারে বের হতে হয়।

ছানাদের নিয়ে মা ইঁদুর রান্নাঘরের এককোণে এসে দাঁড়ায়। উৎকর্ণ হয়ে এদিক সেদিক ভাল করে দেখে নেয়। বাড়িওয়ালার পোষা বিড়ালটা আশেপাশে কোথাও আছে কি না।
না নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে মা ছানাদের বলে - তোমরা এখন এখানে খেলা করতে লাগো। আমি দেখছি কোনো খাবার আছে কি না।
-
আচ্ছা মা।
ছানারা আনন্দে ছুটোছুটি করতে লাগে। আর মা খুঁজে বেড়ায় কোথাও খাবার মত কিছু পাওয়া যায় কিনা।

মিঁউ, মিঁউ, মিঁউ।
হঠাৎ বিড়ালের ডাক কানে আসতেই মা ইঁদুর দৌড়ে ছানাদের কাছে আসে।
-
শিগ্গির লুকিয়ে পড়।
ওরা কোণায় রাখা তরকারির ঝুড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।
না বিড়াল এঘরে আসেনি। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে ওরা।
একটি ছানা বলে - মা, এভাবে এত ভয়ে ভয়ে কি বাঁচা যায়?
আর একটি ছানা বলে - দিনের আলোয় বের হতে পারবো না। একটু খেলাধুলো করতে পারবো না। সবসময় ভয় শুধু ভয়...
মা ইঁদুর ছানাদের আদর করে হতাশামাখা গলায় বলে - এছাড়া আর উপায় কী! আমরা ইঁদুর। যে দেখবে সেই আমাদের মারতে তেড়ে আসবে। এমনিই তো আমাদের ইঁদুর জীবন। দুঃখ কোরো না সোনারা। তোমার বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে। আমি তোমাদের মা তো আছি।
ছানারা আর কিছু বলে না। ওরা বোঝে-এই জীবনটাকে মেনে নিয়েই ওদের চলতে হবে। শুধু একটা নীরব কষ্ট যেন ওদের বুকটাতে পাথরের মত চেপে থাকে।
-
এসো তোমরা আমার সাথে। ওদিকে একটা রুটি পড়ে আছে। দেখে এসেছি। খাবে চলো।

ছানাদের নিয়ে মা এগিয়ে যায়।
খাবারের পাশে আসতেই ছানারা বলে - মা, আমরা এখন একটু খেলা করবো। তুমি আগে খেয়ে নাও। কাল তো তোমার কিছুই খাওয়া হয়নি। যেটুকু খাবার পেয়েছিলে, সবটাই তো আমাদের দিয়ে দিলে।
সন্তানদের কথায় আনন্দে গর্বে মায়ের চোখে জল এসে যায়। -আচ্ছা।
মা ইঁদুর রুটিতে কামড় বসায়। কিছুটা খেয়েও নেয়।
তারপর হঠাৎ কেমন বিকট সুরে ডেকে   উঠে ছটফট করতে থাকে।
ইঁদুর ছানারা  খেলা ফেলে ছুটে আছে মায়ের কাছে।
-
মা, ওমা, কথা বলছো না কেন? মা মা
চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ছানারা।

মা ইঁদুর মৃত্যুযন্ত্রণায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে অনেক কষ্টে বলে -ওরা আমাকেও বাঁচতে দিল না। ছানারা তোমাদের বাবামা হারা করল ওই নিষ্ঠুর মানুষরা। রুটিতে বিষ মিশিয়ে রেখেছিল আমাদের মারার জন্য। তোমরা সাবধানে থেকো আমার সোনারা- - -
অসাড় হয়ে গেল মা ইঁদুরের দেহ।
-
মা ---
হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে ছানারা।

সহসা আবার মিঁউমিঁউ।

মায়ের লাশের পাশে বসে দু'দণ্ড চোখের জল ফেলার অবকাশও পায় না। প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে হয় ইঁদুরছানাদের।