বাপমায়ের আদরের
প্রথম সন্তান সরোজ। দুর্গাষষ্টীর দিন
জন্ম বলে বাবা ভারিপ
য়মন্ত মানতেন তাকে। বাবা
হঠাৎ কলকাতায় অসুস্থ হয়ে
মারা গেছেন।দেশে ফিরে এসেছে
সে মায়ের সংগে। সংগে
ছোট দুইবোন। এখানে সাজগোজ
রংহীন মাকে সাদা পাথরের
মূর্তির মত লাগে। সরোজ
বোনেদের নাওয়া খাওয়ায়। কলকাতার
মেমসাহেব টিচারের কাছে শেখা
লেখাপড়া মনে রাখার চেষ্টায়
খাতাবই নাড়ে চাড়ে। একদিন
পাশের শরিকের খুড়িমা দাওয়ার
নিচে থেকে ডাক দিলেন
এসে।
"হ্যাঁলা সরো,
মায়ে কই ? সুখবরডি
শুনসে ?
মা পুজোর
আসনে মাথা ঠেকিয়ে মাথায়
গায়ে আঁচল জড়িয়ে এসে
বলেন,"কয়েন খুড়িমা। কিসের
খবর” ?
ভারি দুল পরে পরে কানের লতিটি কাটা। তাই টানা দেওয়া ভারি কানপাশা খুড়িমার কানে। কাঁচাপাকা চুলে চওড়া সিঁদুর। একগাল হেসে বললেন, "মেয়ের
পাত্তর ঠিক হল বউ, এর চাইতে আর ভাল খবরকি? মাথার উপর
ত তিনডি ভারি পাথর তোমার।
একটার গতি
হইলেও কিসু
তো নিশ্চিন্দি।
কার পাত্র
?
দিশেহারা দেখায়
হেমাংগিনীকে।
এইবার রসিয়ে
বলেন খুড়ি ।
কত কাঠখড়
পুড়িয়ে বাড়ির পুরুষরা এই
বাপহারা সরোজের জন্য পাত্র
ঠিক করে কথা দিয়ে
এইয়েচেন। বংশের সকলে কি
আতান্তরেই না পড়েছে তিন
মেয়ে সমেত এই অনাথা
বিধবাকেনিয়ে ।
পাত্রের নাম
ধাম জিজ্ঞেস করেন হেমাংগিনী।
শুনে ঠান্ডা
গলায় বলেন, "আমার
মেয়ের বিয়ে আমি এখানে
দেবনা,খুড়িমা । আমার মত
নেই।
ঘরে যেতে
গিয়ে পিছনে কাংস্যনিন্দিত গলার
চীৎকারে একটু থমকে গেলেন।
"আলো আবাগীর বেটি!
কপালে আগুন পোড়া,
অকালে সোয়ামীকে খেয়ে কলকেতা
ফেরত হয়ে এইয়েচ,
ঘরে দোরে ঢুকতে দিয়েছে
মানুষ এই না কত?
আবার বড়বড় কতা ।
বলি,একটা পুতের
মুখ দ্যাখনের ক্ষেমতা থাকলে
তবু বুইজতাম । প্যাটে ধরসো
তিন তিনডি মাইয়ামানুষ। তোমার
মত জানতে
চায় কেডা?
আমি কি
না ভালমুখে সুখবর দিতে
আইলাম। ওমা!
লুড়া জ্বালি
মুখে তোমার। যত বড়
মুখ নয় তত বড়
কতা । পরিবারের পুরুষ মানুষেরা,সব গন্যিমান্যি মিলে
পাত্রস্থ করে দিতাসে মাইয়া।
গৌরীদানে কুলীনস্থ পাত্রে বংশের
পুন্য কত! আরে মরণ...
দিনকাটে। রাতযায়।
অবশেষে এল একটা সকাল।
বন্ধ কাঠের
দরজার এপারে দাঁড়িয়ে হেমাংগিনী।
নায়েব চিন্তাহরণ চৌধুরীর সদ্য
বিধবা তিরিশ ছোঁয়া বউ।
ওপারে চৌধুরী পরিবারের বাকি
লোকজন।
বড় মেয়ে
সরোজের না কি বিয়ের দিন আজ।
মেধাবিনী,
অপরূপ সুন্দরী সরোজ।
ডুরে শাড়ির
আঁচল খানা গায়ে জড়িয়ে
স্থির হয়ে বসে আছে
ঘরের মেজেতে।
অশ্রাব্য ভাষার
চীৎকার শোনা যাচ্ছে ঘরের
বাইরে থেকে। কর্কশ পুরুষ কন্ঠে গর্জন করছেন মেয়ের বড়কাকা।
সংগে বহু কন্ঠের গুঞ্জন
ভেসে আসছে ঝাঁপফেলা বেড়ার
জানালার ফাঁক
দিয়ে।
রাসভ নিন্দিত
কন্ঠমৃত দাদার অপুত্রক বউয়ের
অসহ্য স্পর্ধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে
ফেটে পড়ছিল। এমন সৃষ্টিছাড়া
সাহস পেল কোত্থেকে এই মেয়েছেলেটা ?
বাপের অবর্তমানে
কাকারাই যেখানে অভিভাবক,
সেখানে মেয়ের মাকে জানায়নি
বলে বিয়ে ভেংগে যাবে?
আরে বাবা
মেয়ের ভবিষ্যৎ কিসে ভাল
হয় সেত গুরুজন এই
কাকারাই বুঝবে। তুমি মেয়েমানুষ,বোঝই বা কি,আর করবাইবা কি?
পাত্র কি
কম লোভনীয়? সাংঘাতিক কুলীন
বংশের বংশধর! কাজেই বয়েস
একটু বেশি, দোজবরে ত হবেই। আর গাঁজাটা আশটা নেশা সব
পুরুষ মানুষেই করে।
পৌরুষের প্রবল
আস্ফালন ভাসে।
"দাঁড়ারে নষ্ট মাইয়ামানুষ,
ত্যাজ বাইর করি। হেই
ক্কে আছস। ডাক পাইকদের।
ভাংগ দরজা লাঠির বাড়ি
দিয়া। চুলে ধইরা টাইন্যা
আনুম মা বিটিরে। কথা
ভংগ হইব না কিসুতেই।"
রে রে
রে হাঁকার দেওয়া চৌধুরী
বাড়ির বাগদী লেঠেলদের ভয়পায়
সবাই। এ এলাকায় এদের
জন্যেই বাঘে-গরুতে
জল খায়।
ঘরের ভিতর
বসে থাকা কিশোরী মূর্তিটি
থরথর করে কেঁপে ওঠে।
"মা--
ধীর পায়ে
উঠে গিয়ে জানালার বাঁশের
ঝাঁপ খুলে তুলে দ্যান
হেমাংগিনী । বাইরের ভীড় তীব্র
গুঞ্জন ছড়িয়ে স্তব্ধ হয়।
কালো কুচকুচে
লেঠেলের দল ভাবে,
" নায়েব
মশয়ের পুজো করা দুগগিপিতিমে খান
সাদা কাপড় পরি জলের
তল থে উঠি আল নাহি?"
সেই থান
পরা হাতে আলো ঝলসায়।
পুকুরের বড় মাছ কাটার চকচকে
লোহার আঁশবটির বাঁকানো ফলাখান
ধরা আছে।
তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর
থমথমে বাইরের বাতাসকে কেটে
ঘোষনা করে,
"চেয়ে
দ্যাখো,
এইআঁশবটি। আর ভাল করে দেখে
নাও । এই যে মেয়ে।"
মায়ের হাতে
বঁটি উঠে আসার পর
সরোজ মূর্তির মত হাঁটু
মুড়ে পায়ের কাছে এসে
বসেছে ।
" ভাল করে শুনে
নিন সকলে। যে মুহুর্তে
লাঠির বাড়ি দরজায় পড়বে
এক কোপে নেমে যাবে
মেয়ের মাথা। আমি যে
সকল পূজা-আচ্চায়
বিরাট রুই-কাতল
এক কোপে ফালা দিই
বাড়ির সকল মানুষ জান।"
দা এর
ফলায় আলো লেগে ঝকঝক
করে ওঠে।
বাইরের নিস্তব্ধ
ভীড় জানে অনায়াসে বিরাট
ভোগের হাঁড়ি,জলের কলস
একঝটকায় নামানো হাতের জোর
কত।
আস্তে আস্তে
ফিসফিস, গুজগুজ, চাঞ্চল্য দেখা
দেয় ভিড়ের মধ্যে। বয়স্ক
গলায় রবওঠে।
"হেই থামো থামো।
খুনোখুনি হইলে দারোগা পুলিশ
বাড়ির কুনডিরে বাদ দিবনা।
চলচল। একটা নষ্ট মাইয়া
মানুষের লাইগ্যা বাড়িসুদ্ধা হাজত
হাতকড়া হইলে হয়না।"
হেরে যাওয়ার অপমানে গালির ঝড় তুলে দু হাতের ধাক্কায় ভীড় সরিয়ে চলে যান কর্তারা।
বেলা গড়িয়ে বিকেল।
বাড়ির অন্যদিকে শাঁখের আওয়াজে ধরমড় করে উঠে বসে সরোজ।
"মা!"
সিধা হয়ে বসেন হেমাংগিনীও । দা খানার দিকে দৃষ্টি দ্যান।
পিছনের দরজায় মৃদু টোকার শব্দ।
"কে?"
"আমি মাঠাইন,
মাঝি বউ । উদিকে বিয়া বসল ।
"তোমার দ্যাওরের দ্যাড় বসরের মাইয়াডি ঘুমাইতাসিলো দাওয়ায়। একখান বড় কাঁসার থালায় উঠাইয়া ঘুরাইয়া দিয়া কয় বিয়া হইতাসে।"
আঁতকে ওঠেন হেমাংগিনী।
ভয়ার্ত গলা মাঝিবউয়ের,
"চল মা গো,ঘাটে
নাওলা গায় মাল্লারা। হেরা কয় কইলকাতার বাসায় যাইতে। এইহানে রাইতে হয়ত ঘরে আগুন দিবারো পারে। এগো বিশ্বাস নাই। ত্বরা কর মা।
মেয়েরা ছইঘরে ঘুমিয়ে কাদা।
হেমাংগিনী জেগে বসে থাকেন।
কলকাতা কত দূর।