আচমকা
কার্বলিকের গন্ধে পাড়ার সর্পভীরু মানুষগুলো উঁইপোকার মত কিলবিল করে বেরিয়ে পড়েছে!
নৃপেন মুদির গুদামঘরের সামনে এই মুহূর্তে সুচ রাখারও সুজোগ নেই। মিশ্র
প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দু’একজন ধর্মপ্রাণ
দেশভক্তও থাকেন ,--‘যাক এতদিনে দেশটার শনির দশা কাটল
তাহলে! এত উপদ্রব আর নেওয়া যাচ্ছিল না!’ মানুষগুলো এমনভাবে উদ্বেগ নিয়ে ঝুঁকে আছে,
যেন একটা ক্ষুদে পিঁপড়ের ঘাড়ে আর একটা ডেও। শাপমোচনের স্বপ্নে
এখন বিভোর গোটা দেশ; সেক্ষেত্রে নৃপেন মুদির দুঃসাহসে
মনসারও চোখ কপালে ওঠার অবস্থা! –‘সাপ কি বেরোল জেঠু?’
শ্রমিক ইউনিয়নের বরখাস্ত নেতা কাশেম;
তার বস্তাপচা ধ্যানধারণায় নৃপেনের তিরিক্ষি জবাব,--‘ একটু
ধৈর্য ধর বাপু! সবে তো লেজ ধরে টানটা মেরেছি। খেলিয়ে খেলিয়ে বার করতে হবে যে!
বাস্তুসাপ বলে কথা। এক টানে এমন একটা জন্তু বার করা কী চাট্টিখানি কথা!’ উৎসাহ আর উদ্দীপনার
কোপে দেশবাসীর চোখের ঘুম চটকে পিচুটি হবার উপক্রম।
--‘এতটা বাহাদুরি দ্যাখান ঠিক না নৃপেন। তুমি তো বাপু সামান্য একজন মুদি;
এখন যদি গায়ের জোরে ওঝার বিদ্যেও ফলাতি যাও---! এসব কাজে
তিন-মাথার বুদ্ধি নিতে হয়। আমাদের কালে ফাঁসজাল পেতে হ্যেইয়া হ্যেইয়া সব হেতের
মেরেছি!’
--‘তুমি সর তো বাপু। তোমরা অনেক ঘাস উপড়িয়েছ। অত গাল বাজিও না। দ্যাখলাম তো তুমাদের মুরোদ! দুধকলা খাইয়ে যত দেশের কালকেউটে গুলোকে মোটা করেছো; আর এখন একটা হেলে ধরতে বললেও তোমরা সুইচ বোর্ডের গল্প শোনাও!’ মেনকা খুড়ির মুখের ওপর আর রা কাড়ে না মনোহর সিং। উইপোকার পাখনা এখন বাবুদের পায়ে পায়ে প্রসাদ।-- ‘ সাপটা বেরবে তো? ল্যাজটা জোরসে টেনে ধরে থাক জেঠু; আমরা আছি তোমার সাথে!’ কৌতুহল ফেনিয়ে ফেনিয়ে অ্যালকোহল হয়ে ওঠে,---‘কি সাপ রে? শাখামুটে; নাকি শঙ্খচূড়?-- ওফ! পুরনো কংক্রিটের নীচে এত সরু গর্ত -----পাতাল পুলিশের বাপেরও সাধ্যি নেই ওকে বাগে আনা!’
হঠাত
হঠাত জোনাকির মত ঝিকমিক করে ওঠে হাজার জোড়া চোখ,---‘ হ্যাঁ! হ্যাঁ! বেবুচ্ছে! বেরুচ্ছে! টান! টান! ওফ শেট! মাথাটা আটকে গেল!’
হুড়োহুড়ির কোপে হাঁড়ির মুখ আরও সরু হয়ে আসে,--‘ টর্চটা জ্বাল না রে! উঁহু খোঁচা দাও কোন দুঃখে!’ ল্যাজের আগায় শোনা যায় বিষ নেই; কানে কানে
ছড়িয়ে পড়ে উৎকণ্ঠা মাখানো উপকথা।--‘ওই বুঝি গ্যাকগোক করে
ডাকল! ইয়েস! এইজন্যই মাথার দিকটায় এতটা প্রবলেম। নিশ্চই ঘেপো এক কোলাব্যাঙ গিলেছে!’
এইবার অনন্ত ধৈর্যের পরীক্ষা। বুদ্ধিমানেরা মাথা ঝাকালেন,
‘ব্যাঙটাই আসলে বিশাল একটা ম্যাটার!’
ধৈর্যশীলা
তারারা জলটুঙির গায়ে ঝুলিয়ে রাখা লন্ঠনের মত টিমটিম করে জ্বলতে লাগলেন। নৃপেনের
উঠোনে ঝুঁকে পড়েছে ঘুমে ঢুলুঢুলু গোটা দেশ। দেশিয়ালী সমস্ত শান্তি স্বৈস্তয়ন ও
শবযাত্রার সকলপ্রকার অন্তিম উপকরণ সাথে নিয়ে প্রহর গুনতে থাকল প্রহেলিকা আচ্ছন্ন
একটা জাতি। বাকলমোচনের ব্যথা আলাদা করে লেখেনা কেউ; শুধুমাত্র বাধ্য হয়ে খসাতে হয় বর্ষবলয়ের ভাজে শিথিল হয়ে আসা অবাঞ্ছিত
কিছু বাসনা। বুদ্ধের দেশে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সহিষ্ণুতার দীক্ষা একপ্রকার এভাবেই
নিয়ে থাকেন। হল্লা ও হরিধ্বনির ফাঁকে ফাঁকে, নৃপেন মুদির
হয়ে বলতে থাকেন অনেকেই, ‘দ্যাখাই যাক না, কিছু তো একটা বেরোবে। মরতে তো একদিন হবেই; ষষ্ঠীচরণের
মত নাহয় লাইনে দাঁড়িয়েই মরি। ভূভারতে এমন দুঃসাহস নৃপেনের আগে কেউ কোনকালে
দ্যাখাতে পেরেছে?’ আশা আর হতাশা জাগিয়ে মাঝে মাঝে ধূধূ
ভারতভূমির বুকের ওপর দিয়ে এখনও গরম দমকা হাওয়া হুশহুশ করে বয়ে যায়,--‘জীর্ণ বুকের হাপর ঠেলে উচ্চারিত হয় শাশ্বত সত্য,--‘আসলে আমাদের মরণটাই হল শেষ কথা!’ সুজোগ বুঝে
কাশেম আবার সেই কাসুন্দিতেই কাঠি দিল,---’নৃপেন’দা যে বললেন সাপটা তিনি বার করেই ছাড়বেন? তাহলে
আমরা এই যে এতটা ত্যাগ স্বীকার করে উনার উঠোনে এসে হাঁটু ভাঙলাম, এখন তবে অকারণ অনিশ্চয়তা নিয়ে ক্যান বাঁচব? আমাদের
ভবিষ্যতের গ্যারান্টি কী?’
বয়ঃবৃদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানীরা দাড়ি চুলকে বললেন, ‘এই রঙ্গ রয়ানীর শেষ দৃশ্য দেখে সারমর্ম যা বুঝলাম,’এখন ওই মাথামোটা ব্যাঙটার বাঁচা ও মরার ওপর নির্ভর করছে আমাদের সবার সম্ভাব্য সুদিনের ভূত ও ভবিষ্যত।‘
বয়ঃবৃদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানীরা দাড়ি চুলকে বললেন, ‘এই রঙ্গ রয়ানীর শেষ দৃশ্য দেখে সারমর্ম যা বুঝলাম,’এখন ওই মাথামোটা ব্যাঙটার বাঁচা ও মরার ওপর নির্ভর করছে আমাদের সবার সম্ভাব্য সুদিনের ভূত ও ভবিষ্যত।‘