গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

মনোজিৎকুমার দাস

ভরা থাক স্মৃতিসুধায়                                                     
                                                                                                                 
সুজাতই আজ সবচেয়ে সুখি,সুশোভন মনে মনে ভাবে। তবে কি সে নিজে সুখি নয়! কেন সে সুখি হবে না লাবণ্যের মতো রূপসী জীবনসঙ্গিনীকে পেয়ে,লাবণ্যের পাশে শুয়ে সুশোভন কেন যেন ভাবতে থাকে। লাবণ্য নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। তবে কি সুশোভন নস্টালজিক হয়ে পড়ছে। ফুটফুটে সুন্দরী মেয়েটি সুশোভনের খেলার সাথী ছিল এক সময়। তার চেয়ে তিন চার বছরের ছোট সুজাতা তার চোখে সামনে বড় হয়ে ওঠতে দেখেছে সুশোভন। সুজাতা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। বাবা কলেজের পড়ান, মেয়েকে লেখাপড়া সাথে সাথে গান শিখিয়ে নামী শিল্পী করার ইচ্ছে সুজাতার মায়ের। সুজাতার মা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।সুজাতার যত আবদার সুশোভনের কাছে।আবদারের অন্ত নেই। শীতকাল,সরষে ফুলে ছেয়ে আছে সারামাঠ। প্রজাপতি ওড়াওড়ি দেখে সুজাতা একদিন বিকেলে সুশোভনের কাছে বায়না ধরলো," একটা প্রজাপতি ধরে দাও না,শোভনদা। " অগত্যা সুশোভনকে অনেক দৌড়াদৌড়ি করে তা ধরতে হলো।
সুজাতা সেবার মেয়েদের সরকারী স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলো,আর সুশোভন সরকারি বয়েজ স্কুলে ক্লাস সিক্সে উঠলো। লাবণ্যে পাশে শুয়ে সুশোভনের মনের কোণে সুজাতার সেই মুখটা মনে পড়ে,তখন সুশোভন ক্লাস এইটে। সুজাতার শরীরের পরিবর্তন সুশোভনের নজরে আসে,তার মুখে আগের মতো খই ফোটে না। সুজাতা লাবণ্যের মতো ফর্সা নয়। কিন্তু উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা হলে কী হবে মুখের দেহের গড়ন অসাধারণ।যেন তন্বী তনুলতা।
এমন দিন নেই সুশোভন সুজাতাদের বাড়িতে যায় নেই।ক্লাস থ্রিতে শিশু বিভাগে রবীন্দ্রঙ্গীতে জেলা প্রথম হওয়ায় আন্ত:জেলা প্রতিযোগিতায় সুজাতাকে খুলনায় যেতে হবে, সঙ্গে একজনকে যেতেও হবে, কে যাবে! সুজাতার বাবা ট্রেনিং এ। সুশোভনও ডিবেট কম্পিটিশনে অংশ নিতে খুলনা যাবে। সুজাতার মা সুশোভনকে বললেন," তোর সঙ্গেই সুজাতা যাবে।"ওরা দু'জনেই পুরস্কার নিয়ে ফেরে। সুজাতা বড় হয়েও বায়নার শেষ ছিল না। সুশোভনদের স্বর্ণচাঁপা গাছ ফুলে ফুলে ভরে আছে, সুজাতার বায়না ফুল পেড়ে দিতে হবে। ফুল পেড়ে তবেই সুশোভনের রেহাই।
স্কুল ফাইনাল শেষ করে কলেজে ভর্তি হবার পর সুজাতার সঙ্গে সুশোভনের যোগাযোগ আগের মতো থাকলো না। কলেজের পড়া শেষ করে সুশোভন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।ঢাকা থেকে সে জানতে পারলো,ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলেই সুজাতা বিয়ে দেবে ওর বাবা মা।তার ঠাকুমার বড়ই সাধ নাতজামাই দেখে মরবার। সুজাতার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।বর লন্ডন প্রবাসী সিলেটি।
খবরটা জেনে সুশোভনের মনটা কেন যেন খচ করে উঠলো। সুশোভন ভাবলো, কেন তার মনটাতে এমন অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে! সে একটা গোলাপের কুঁড়িকে পরিচর্যা করেছিল ভালবেসে। আজ সেই কুঁড়িটি ফুটে উঠেছে নয়নভোলানো রূপে আর সুরভি নিয়ে। সে অপরূপের পূজারি।বিকশিত ফুলটিকে কি ছিড়ে ফেলে দিতে পারে!
এক কথায় অনিন্দ্যসুন্দরী সুজাতাকে সে শৈশব থেকে বড় করে তুলেছে ভালবেসে। সে ভালবাসায় কোন খাদ ছিল না। আজ তার বিয়ের কথা শুনে তো মনের কোণে অস্বস্তি রেখা টানার কোন অর্থ হয় না। একটা অব্যক্ত ভালবাসা তার মনের কোণে অবশ্যই জেগে উঠতে পারে। তাই বলে তা কখনোই কামনা জাড়িত নয়। সুজাতাকে সে চেনে ভালভাবেই, সে তাকে অবশ্যই ভালবাসে,তবে অন্য রকমে ভালবাসা।সুজাতার বিয়ের খবরে সুশোভন অনেক ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত এটাই ভেবেছিল, আমার মনের মণিকোটায় সুজাতা ভরা থাক স্মৃতিসুধায়।
সে রাতে লাবণ্যের পাশে শুয়ে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে অ্যানরয়েড ফোনের সংযুক্ত করে  রবীন্দ্রসঙ্গীতের এলবাম থেকে তার প্রিয় শিল্পী হেমন্তের কন্ঠে গানটি সিলেক্ট করে সুশোভন শুনতে থাকে।