গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

আফরোজা অদিতি

নিজেকে নিয়ে খুঁজি

আমার বিয়ে বাড়িতে হৈ হৈ রৈ রৈ বাদ্য-বাজনা গান চারদিকে আমার কিছু ভালো লাগছে না অতিথি মেহমান আসছে, যাচ্ছে আজ গায়ে হলুদ কাল বিয়ে হলুদের পাটি বিছিয়ে ডাকছে চাচি আমার যেতে ইচ্ছা করছে না পাটিতে বসতেও ইচ্ছা করছে না আমার মাকে মনে পড়ছে মা, আমার মা

আমার ষোলটি বসন্ত গেলো মাকে ছাড়া আজ মাকে আমার চাই আমাকে আশির্বাদ করবে, গায়ে হলুদ দিয়ে কপালের হলুদ মুছে নেবে শাড়ির আঁচলে, তবেই না পরবো লাল বেনারসী, বলবো -রাজি আমি পাটির দিকে চেয়ে থাকি খুব সু্ন্দর নক্সাদার পাটি পাটির পাশেই বসে এক চাচি বাটছে হলুদ, অন্য চাচি মেহেদী  যে চাচি হলুদ বাটছে, তার মুখের ভেতর পান পানের বোঁটা দুঠোটের ফাঁকে বেরিয়ে আছে চাচি কথা বলছে না চাচিকে ডাকতেই ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন কথা বলা নিষেধ কি জানি, এটাই বোধহয় নিয়ম হলুদের আর সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকলেন দাদি আমাকে হলুদ দেবেন তিনিই প্রথম
কই রে, বুবু আয় দাদি ডাকছেন
আমি, দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে দাদি উঠে এলেন আমার কাছে হাত ধরে বললেন, বেলা হয়ে যাচ্ছে, ওঠ
দাদি, দাদি গো, আমার মাকে এনে দাও না!
আমি আগে কখনও মায়ের কথা বলি নি আজই প্রথম দেখলাম, মায়ের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো হয়ে গেলো দাদির মুখ দিয়ে এমন বাক্য বর্ষিত হলো, যা ভদ্রলোকের মুখে মানায় না, শোভা পায় না মাকে গালাগালি করতে দেখে আমিও জ্বলে উঠি
অযথা রাগ করছো কেন? সে তো তোমাদের খায়ও না, পরেও না তাহলে তোমাদের এতো রাগ কেন?
ওই বেহায়া, পুরুষ ঢলানির নাম নিবি না মুখে
কেন নেবো না কী করেছে আমার মা? শুধু কি আমার মায়ের দোষ? বাবার দোষ নেই? দোষ নেই তোমাদেরউত্তেজিত হয়ে পড়ি আমি দুই চাচিও উঠে এসেছেন
থাম, থাম এভাবে কথা বলে না রিপা মামণি
কেন থামবো আমি! কেন? যাকে খেতে দাও নি, পরতে দাও নি, বাড়িতে থাকতে দাও নি, তাকে বকাবকি করবে! কেন?
রাগে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে আমার কান্না দেখে দাদি বলেন, চুপ বুবু, চুপ! বিয়ে বাড়িতে এসব কথা শুনলে লোকে মন্দ বলবে, তাছাড়া সে তোর কী করেছে, কী কাজে এসেছে যে, এখন মা, মা, করে হেঁদিয়ে মরছিস!
আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি, তিনি তো আমার মা তাছাড়া তিনি তো আমার জন্য করতে চেয়েছিলেন, তোমরা করতে দাও নি
তার কাছ থেকে তোমরা নিয়ে এসেছো আমাকে
এসব কথা রাখতো বুবু তোর বাবা শুনলে রাগ করবে এখন আয়, এগুলো পর
আমি ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকি, দাদি, আমার হাতে লাল রেশমি চুড়ি পরাতে থাকেন জোর করে চুড়ি পরাতে গেলে তা ভেঙে হাত রক্তাক্ত হয়

আমার মা, তার বিশ বছরের যৌবনে অন্য পুরুষকে আহ্বান করতে বাধ্য হয়েছিলো কারণ অবশ্যই ছিলো আমার জন্মের পর থেকেই দেখেছি, আমার বাবা আর মায়ের পৃথক বিছানা আমার বাবা নারীতে আসক্তি হারিয়ে ক্রমশঃ পুরুষে আসক্ত হয়ে পড়েন এসব কথা শুনেছি আমার দাইমার কাছ থেকে দাইমা আমার মাকেও লালন-পালন করে বড়ো করে তুলেছিলো অনেক কষ্ট ছিলো তার মনে প্রায়ই কাঁদতো আর বলতো, অনেক চেষ্টা করেও বাবার সুস'তা ফিরিয়ে আনতে পারেন নি মা

অসহায় মা, প্রতিদিন কেঁদেছেন, অনুনয় করেছেন তার অনুযোগ, অভিযোগ কাজে আসে নি প্রতিবাদ করেছেন যতো প্রতিবাদ করেছেন ততো অত্যাচারিত হয়েছেন মা মায়ের উপর রাগ হলেই বাবা তাকে ঘরে আটকে রাখতেন, পেটাতেন মা চিৎকার করে কাঁদতেন কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতো না চাচা, দাদি সবাই বাবাকে ভয় পেতো আর এড়িয়ে চলতো
দিনদিন মায়ের উপর বাবার অত্যাচার বেড়েই চললো একদিন সহ্য করতে না পেরে মা, আমাকে নিয়ে  চলে যান আমার নানির বাড়ি পরদিন দাদি গিয়ে আমাকে জোর করে নিয়ে আসেন, বাড়িতে বলেন, সন্তানের উপর মায়ের কোন অধিকার নেই অধিকার সব বাবার তাছাড়া, মা নষ্ট মেয়েমানুষ  সে, স্বামীর সংসার থেকে চলে এসেছে যে নারী পরিবার ছেড়ে চলে এসেছে, সে নারীর  কাছে পরিবারের মেয়ে থাকবে না মায়ের কাছে থাকলে নষ্ট হবে, হবে মায়ের মতোই

এরপর নানা, মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেন ওখানে মা কেমন আছেন, আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে আমার কথা তার মনে পড়ে কিনা?-তাও জানতে ইচ্ছা করে মা কি আমার কথা মনে করে কাউকে ছড়া কিংবা কবিতা শোনান,
দেখা যায় তালগাছ কিংবা আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে...’

আমি ডিগ্রি পড়ি ইচ্ছে ছিলো আইন পড়ার কিন' তা হলো না বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে কারণ আমার রক্তে আছে নাকি মায়ের স্বভাব পালিয়ে মুখে চুনকালি দিতে পারি আমাদের এই সমাজে তো সন্তানেরা সব ভালো পায় বাবার আর সব মন্দ পায় মায়ের  আমি মায়ের কথা ভাবছি মা, আমার মা
দাদি গোমড়া মুখে হলুদের শাড়ি বের করে পরতে বললেন আমি এবার দাদির গলা জড়িয়ে আদুরে কন্ঠে বললাম, যাও না দাদি, আমার মাকে এনে দাও বাবাকে বলো না আমি তো চলেই যাবো
দাদির কন্ঠে রাগ তুই চুপ করবি! চুপ না করলে, তোর বাবা তোকে আস্ত রাখবে না কেটে কুচিকুচি করে ফেলবে
আমি, দাদির গলা ছেড়ে দেই ধীর শান্ত কন্ঠে বলি, তোমরা আসলে মানুষ নও, তুমি বাবাকে বলো না বললে আমি তুলকালাম কান্ড করবো বলে দিলাম
আমার কথায় দাদি উঠে দাঁড়ালেন ডাকলেন চাচিকে বউমা, এদিকে এসো তো বসো এখানে
শাশুড়ির ডাকে আমার বড়ো চাচি এলেন দাদি যাওয়ার সময় বললেন, মজা দেখাচ্ছি

দাদি চলে যাওয়ার পর, বড়ো চাচি বললেন, এমন করে না মা এমন করলে অসম্মান হবে তোমার বাবার, অসম্মান হবে তোমার চাচাদের, অসম্মান হবে বাড়ির তোমার মায়েরই অসম্মান হবে বেশী, তুমিও বাদ যাবে না
চাচির কথা শুনে মনে হলো আসলেও তাই সমাজ তো যতো অসম্মান, যতো অপবাদ সব মেয়েদের কপালেই লিখে রেখেছে পুরুষ এখানে ধোয়া তুলসি পাতা বিয়ে বাড়ির মানুষ কেউ আমার কাছে কোন কথা শুনতে আসবে না সবাই বাবার কথাই শুনবে শুনবে এবাড়ির সব মানুষের কথা এবং বিশ্বাসও করবে
আমি, চাচিকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম আমাকে কাঁদতে দেখে, আমার চাচাতো বোন, হিমানি কাছে এসে বসলো বললো, তুই কাঁদছিস কেন? সময় কেউ কাঁদে! আজ তো তোর খুশির দিন!
ওর মুখের দিকে তাকাই ভাবি, ওরা তো জানে না আমার বুকের যন্ত্রণা ওদের বাবা-মা দুজনেই আছে মাকে ছাড়া আমার জীবনের যে অপূর্ণতা, যে শূন্যতা, তার কথা তো ওরা বুঝবে না আমার দুঃখ বাড়তে থাকলো চোখ দিয়ে জল পড়ছে, এমন সময় বাবার কন্ঠ, আমার সোনা মা, কইগো!
বাবা, সিড়ি ভেঙে উপরে আসতে আসতে ডাকছেন বাবার ডাকে কান্না বেড়ে গেলো এতোক্ষণের শব্দহীন কান্না আর শব্দহীন থাকলো না যা কখনও করি নি, তাই করলাম বাবাকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললাম আমার কান্নায় বাবার চোখও সজল হয়ে উঠলো আমার মাথায় হাত দিয়ে বাবা বললেন, তুমি মাকে দেখতে চেয়েছো, কিন' আমি তো তোমার মায়ের ঠিকানা জানি না তোমার নানির বাড়ি লোক পাঠিয়েছিলাম তারা বলেছে, তোমার মায়ের বিয়ে হয়েছে বকুলপুর
এখন তুমিই বলো, বকুলপুরে কোথায় খুঁজবো তাকে
বাবা চলে গেলেন যাওয়ার সময় বলে গেলেন, আর যেন কোন ঝুট-ঝামেলা না করি

মায়ের বিয়ে হয়েছে বকুলপুর আমারও বিয়ে হচ্ছে বকুলপুর মায়ের একটা ছবি থাকলে ভালো হতো আমি সমস্ত বকুলপুর খুঁজে বের করতাম আমার মাকে মা, আমার মা ছবি নেই তো কি হয়েছে? ছবির প্রয়োজন নেই, আমি তো আমার চেহারা রোজই দেখি আয়নায় আমার মা! মাকে দেখে, আমি আয়নায় আমার বয়সটা একটু বাড়িয়ে নেবো, তাহলেই হবে
বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো বিয়ের পর,একদঙ্গল ছেলেমেয়ে এলো বরের সঙ্গে আমাকে দেখতে ভিড়ের মধ্যে কে যেন বললো, দেখ, ভাবী দেখতে একদম মাম্মীর মতো
তাই তো! বিস্ময় প্রকাশ করে অন্যজন
আমি চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাই কে কথা বললো তাকে কাছে ডাকতে চাই কিন' ভিড়ের মধ্যে কে কথা বললো, আমি বুঝতে পারি না ডাকতেও পারি না যাদের কাছে মায়ের সংবাদ পেতে পারতাম হারিয়ে গেলো তারা এবার বিদায়ের পালা বাড়ির লোকজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ওদের ভয় ছিলো, যদি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলি বিয়ে-বাড়ির লোকজনের সামনে ওদের মুখ থাকবে না সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবার কাছে এসে দাঁড়ালাম বাবা, আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, সুখী হও আমি, বাবার দিকে তাকালাম ওই মুখ আমার চিরদিনই কঠিন মনে হয়েছে, আজও হলো আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, কিছু বলবি?
আমি চললাম বাবা আর আসবো না একটু থেমে চোখ মুছে আবার বলি, আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছো বাবা

শ্বশুর বাড়ি এলাম ওরা বউ বরণ করে ঘরে তুললো নতুন বউ, কারও মুখের দিকে তাকাই নি পরদিন,শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম, আমি যেন আয়নায় আমাকেই দেখছি শুধু বয়সটা একটু বেশি ওই মুখে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরের ঘরবাড়ি সব নড়েচড়ে গেলো উথলে উঠলো সমুদ্র মা বলে গলা জড়িয়ে ধরলাম উনি, আমার কপালে চুমু খেয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ উনার কাছ থেকে উঠে এসে আয়নায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম নিজেকে
ওই দিন দুপুরে স্বামীকে বললাম, তোমার মা মানে আমার শ্বাশুড়িকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে আমার তো মা নেই তিনি আমাকে মায়ের স্নেহ দিতে পারবেন বলেই মনে হলো আমিও তাকে মায়ের আসনই দেবো
আমার স্বামী, আমাকে পরম আদরে কাছে টেনে বললেন, হ্যাঁ, আমার ছোটমা, খুবই ভালো মানুষ খুবই দুঃখী
আমি অনেক প্রশ্ন নিয়ে তাকাই স্বামীর মুখের দিকে আমার স্বামী বলে, আমার বাবার সঙ্গে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে প্রথমবারে স্বামীর কাছে থেকে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন অসম্মানিত হয়েছিলেন ওনার স্বামী নাকি...
কথার মাঝপথে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে বললাম, থাক ওসব কথা ওনারা গুরুজন
স্বামী, আমাকে বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ করে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো আমি বুকে মুখ রাখলাম আমার বুকের ভেতর পরম শান্তি স্বস্তি