গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

জয় চক্রবর্তী

স্বপ্নের দৌড়

        সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য । রাস্তা , ফুটপাথ , রাস্তার ধারের বারান্দা , কোথাও তিল ধারনের জায়গা নেই । অথচ একটাও গাড়ি ঘোড়া নেই । শুধু অসংখ্য মানুষ যেন উদগ্রীব অপেক্ষায় শহর ব্যাপী ছটফট করছে । ঘর থেকে পথে নেমে পড়েছে দলে দলে । কিন্তু কিসের টানে ? কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে নিচু স্বরে , কেউ চুপচাপ তাকিয়ে আছে পুব দিকে । চওড়া রাস্তাটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে অনেক দূরে । যতটা দৃষ্টিগোচর , শুধু মানুষ আর মানুষের ভিড় । বিলটু একটু কান খাঁড়া করতে যা কানে এল , তার বিন্দু বিসর্গও মাথায় ঢুকল না । অনেক দিন ধরে নাকি এক স্বপ্নের দৌড় চলছে । আজ তার ফাইনাল । যে কোন মুহূর্তে এই রাস্তা দিয়ে স্বপ্নের শেষ দৌড় হবে । কথাগুলো বিলটুর মাথার অনেক ওপর দিয়ে উড়ে গেল । স্বপ্নের দৌড়টা কি ? তার আবার ফাইনাল ! কেই বা দৌড়বে ? আর এই থিকথিকে ভিড় রাস্তায় দৌড়বেই বা কিভাবে ? বিলটু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল ওর প্রশ্নের বোঝা নিয়ে । একটা দাড়িওয়ালা পাগল বেশ অদ্ভুত আচরণ করছে । একবার গম্ভীর হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকছে --- আবার পরক্ষনেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে আর কত কি বলে যাচ্ছে নিজের মনে । বিলটুর কৌতূহল হল --- এগিয়ে গিয়ে ওর থেকে হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগল । পাগলটা পেত চেপে হাসতে হাসতে উঠে বসে বলতে শুরু করল , “সব যাবে , সব যাবে ! কিচ্ছু থাকবে না --- কিচ্ছু না ! স্বপ্ন দেখা , না ! দ্যাখ এবার , দ্যাখ ! আরে নিজের খ্যামতা বুঝে দ্যাখ ! তা না, বামন হয়ে চাঁদ ধরব !” বলেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল । একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল পূবের পানে । বিলটু বেশ অনুভব করল যে ওর প্রশ্নের বোঝাটা ক্রমশই ভারী হয়ে চলেছে , খালি হচ্ছে না একটুও ।

কদিন আগেই মাধ্যমিক শেষ হল বিলটুর । মাথা থেকে প্রচণ্ড চাপ নামিয়ে একটু হাল্কা হওয়ার চেষ্টায় আছে । পরীক্ষার সিলেবাসের চাপ যত না , তার চেয়ে ঢের বেশী বাবা মায়ের প্রত্যাশার চাপ । মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন আর সাইন্স গ্রুপে লেটার না থাকলে ভাল জায়গায় চান্স নেই । ভাল জায়গায় ভর্তি না হতে পারলে উচ্চ মাধ্যমিক আর জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ভাল ফল করতে পারবে না । আর ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হলে মানব জনম বৃথা । বিলটু ভেবেছিল পরীক্ষা শেষ হলে মাথা থেকে টেনশনগুলো একটু নামবে । কিন্তু তা তো হলই না , উল্টে এখন রেসালটের চিন্তায় রাতে ভাল করে ঘুম হচ্ছে না । তার ওপর সক্কাল বেলা এরকম আজব পরিস্থিতি শহরে । বিলটুর কিছু ভাল লাগছে না । একটা অদ্ভুত অবসাদ ভেতরটা যেন ছেয়ে ফেলছে । বিলটু বাড়ির দিকে পা বাড়াল । রাস্তার ধারেই দোতলায় ওদের ফ্ল্যাট । ঘরে ঢুকেই বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ল বিলটু । দাড়ি পাগলের মুখ আর ওর কথাগুলো যেন ভিডিও রেকর্ডিং হয়ে রয়েছে ওর চোখ আর কানে । কিসের স্বপ্ন ? আর স্বপ্ন দেখতে অন্যায়টাই বা কি ? স্বপ্নের দৌড়ের সঙ্গে পাগল বুড়োর কথার সম্পর্কটাই বা কি ?

হঠাৎ ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে বাইরের রাস্তায় সোরগোল শোনা গেল । বিলটু প্রথমে অতটা গা করে নি । কিন্তু আওয়াজ ক্রমশ বেড়েই চলেছে । মনে হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবলে ফাইনাল ম্যাচ চলছে । বিলটু আস্তে আস্তে উঠে ব্যাল্কনিতে গেল । যেতেই দেখে , সারা শহর যেন দুহাত তুলে চিৎকার করছে --- সবার চোখ পূর্বদিকে । ওদিকে তাকাতেই চমকে ওঠে বিলটু । কালো ধোঁয়ার একটা মস্ত বড় বল যেন রাস্তা দিয়ে গড়াতে গড়াতে এগিয়ে আসছে । নিচের লোকগুলো সেদিকে তাকিয়েই চিৎকার করছে । কিন্তু ওদের অঙ্গভঙ্গি বা মুখের ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই , অরা আনন্দিত না কি আতঙ্কিত ! বিলটু মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকে । কালো ধোঁয়ার বলটা যত এগিয়ে আসছে , চারদিক ক্রমশ ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।এবার যেন নিচের লোকগুলোর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে । সবাই এধার ওধার ছুটোছুটি শুরু করল --- যার ফলে ধাক্কাধাক্কি , মারামারি , সব মিলে একটা দক্ষযজ্ঞ অবস্থা । এদিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী একেবারে সামনে চলে এসেছে --- এবার বোঝা যাচ্ছে ওর গতি ! নিমেষে বিলটুদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে সোজা এগিয়ে গেল পশ্চিমের দিকে । রেখে গেল চারিদিকে কালো ধোঁয়া রাশি রাশি । কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না । অত ওপরেও বিলটুর চোখ জ্বালা করছে । এত মানুষের সমস্বর চিৎকার যেন এক ফুঁ-এ শ্মশানের নীরবতা এনে দিল । বিলটু ভাল করে নজর করেও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না --- শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া ! কেমন যেন ঘোরের মধ্যেই বিলটু নিচে রাস্তায় চলে এল । ধোঁয়ায় চোখ দুটো একটু সইয়ে নিতেই সামনে ভেসে উঠল এক নারকীয় দৃশ্য । রাস্তার এখানে ওখানে পড়ে আছে বহু মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ --- কোথাও চাপ চাপ রক্ত বা কোথাও বিভিন্ন অঙ্গ – প্রত্যঙ্গ । বিলটুর গা গুলিয়ে উঠল --- বমি আসছে ! ও কোনদিন কোন দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখেনি । মাথা ঝিমঝিম করছে । ফুটপাথে দাঁড়িয়ে টলছিল বিলটু ।

“অ্যাই উত্তরপুরুষ !” চমকে পিছনে তাকাল বিলটু । সেই দাড়ি পাগল ! সম্পূর্ণ সুস্থ দেহে একমুখ হাসি নিয়ে বিলটুর পেছনে দাঁড়িয়ে । বিলটু বলে উঠল , “দাদু , সবাই কি মরে গেছে ?” বুড়ো হো হো করে হেসে উঠল । বেজায় বিরক্ত হল বিলটু , এই পরিবেশে কি করে হাসে লোকটা ! হঠাৎ থমথমে মুখে দাড়ি পাগল বললে , “না , সবাই মরে নি । যারা অতিরিক্ত স্বপ্ন দেখেছে , শুধু তারাই স্বপ্নের তলায় চাপা পড়ে মরেছে । যারা এখনও বেঁচে আছে , তাদের উচিৎ শিক্ষা হয়েছে --- জীবনে আর ভুল করবে না ।“ আবার হাসতে শুরু করল বুড়োটা --- হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকল নোংরা রাস্তায় । বিলটু একরকম টলতে টলতে নিজের বিছানা অবধি এসে গড়িয়ে পড়ল । দুচোখ ভেঙে এক গভীর ঘুম ওকে আচ্ছন্ন করে দিল । এরকম অচেতন ঘুম বহুদিন ঘুমোয় নি বিলটু ।

হঠাৎ একটা প্রবল ঝাঁকুনিতে ঘুমটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল । চমকে উঠে বসল বিলটু । আসলে মা ওর ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য ওকে ধরে ঝাঁকাচ্ছিলেন । বিলটু উঠে বসায় মাও আস্বস্থ হয়ে বললেন , “কিরে ! বেলা বারোটা বাজে , এখনও এত গভীর ঘুম ? তোর শরীর ভাল আছে তো ?” বিলটু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে । শুধু আঙ্গুল তুলে ব্যালকনির দিকে দেখাল । মা  উঁকি দিয়ে এসে বললেন ,“কি ব্যাপার ? কি হয়েছে বল তো ?” বিলটু বলতে চাইল অনেক কিছু --- কিন্তু মুখ দিয়ে বের হল শুধু , “ধোঁয়া --- দাড়ি পাগল --- স্বপ্ন !” মা হেসে ফেললেন , ভর দুপুরে ছেলে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে । “ একে বলে ছুটি , তার চেয়ে বরং বড় দাদাদের থেকে জয়েন্ট এর বই জোগাড় করে এনে নাড়াচাড়া করলে তো পারিস । আর হ্যাঁ রে ! রেজাল্ট ভাল হবে তো ? না হলে আমার আর তোর বাবার সব স্বপ্ন ......” মায়ের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যাচ্ছে । বিলটু এরই মধ্যে আবার শুয়ে পড়েছে । আবার সেই গাড় ঘুম --- স্বপ্নবিহিন ঘুম ছেয়ে ফেলল বিলটুকে । ওর তো এখন ছুটি --- শুধুই ছুটি ।