গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৯ মার্চ, ২০১৪

সম্পিতা দাস


অবসর

মস্ত লোহার মরচে ধরা দরজাটা আজ রঙিন ফুলের সজ্জায় অনেক অনেক দিন পর স্বমহিমায় ফিরতে চাইছে। এই দরজাটার এক অদ্ভুত মাহাত্ম্য। দরজাটা যেন পৃথিবীটাকে দুটো ভিন্ন দুনিয়ায় ভাগ করেছে। একদিকে সবাই ব্যাস্ত, জীবন দৌড়ে কে জিতবে তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। আর অন্যদিকে যে সব মানুষগুলো নির্বিকার চিত্তে বসবাস করছে,তাদের এখন দৌড়ে অংশগ্রহণ করার শক্তি, ক্ষমতা, সাহস সবই প্রায় নিঃশেষিত। তাই তাদের পৃথিবীটাও অন্যদের থেকে আলাদা। কিন্তু একসময় এরাও ঐ ব্যস্ত পৃথিবীর ট্র্যাকে অনেক দৌড়েছে। তবে এই বিজ্ঞানের যুগে আর ইতিহাসকে কেই বা মনে রাখে? বৃদ্ধাশ্রমের ফুল সাজানো দরজাটার দিকে তাকিয়ে এই সব কথাই ভাবছিল অদ্বিতীয়া।

লাল কাপড় আর হরেক ফুলে সাজানো মাঠের মাঝখানে তৈরি হাওয়া মাচাটায় মধ্যমণি হয়ে বসে আছে সে। আজ তাকে বৃদ্ধাশ্রমের তরফ থেকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে।আর সেখানে বসেই মনের মাঝে একরাশ স্বচ্ছতা নিয়েও চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে উঠছে কিছু অস্পষ্ট ছবি।

সবচেয়ে বেশী করে মনে পরছে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিনটা। জীবনে ভুলের শুরু এই দিনটা থেকেই। রেজাল্টের সাদা পাতায় কালো কালিতে ভেসে ওঠা কিছু সংখ্যা। অঙ্কে ৯৮, ভৌতবিজ্ঞানে ৯৭, জীবনবিজ্ঞানে ৯৫ আর বাংলায় মাত্র ৮০। রেজাল্টের উল্লাসের মাঝে মা-বাবা, বাহবা দিতে আসা আত্মীয়স্বজন এবং প্রশংসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দিদিমণিদের চোখে মুখে একটাই প্রশ্নের ঝলক “এরপর? কি হওয়ার ইচ্ছা? ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়ার?” অদ্বিতীয়া সেদিন গলা উঠিয়ে চিৎকার করে বলতে পারেনি “আমি লিখতে চাই, সাহিত্যের ইতিহাসে নিজেকে স্থাপন করাই আমার একমাত্র স্বপ্ন। এরপর তথাকথিত ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে সে মিশে যাচ্ছিল “রুডিমেন্টস অফ ফিসিক্স” কিংবা “অরগানিক কেমিস্ট্রি” র ময়দানে। মোটা মোটা জয়েন্ট এন্ট্রান্সের বইয়ের ভিড়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসটা ব্ড্ড বেশী ফিকে হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

        বেথুন কলেজ-এ ফিজিক্স অনার্স পড়ার সময়ই অনিন্দ্যর সাথে পরিচয় অদ্বিতীয়ার। অনিন্দ্য তখন যাদবপুরে ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশনে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। কলেজ লাইফে কলেজ স্কয়ারের অলিতে গলিতে একসাথে ঘোরার সময়ও অদ্বিতীয়া রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুনীলকেই সঙ্গে নিয়েই হাঁটতে চেয়েছে কিন্তু আনিন্দ্যর কাছে আর্চিস কার্ড কিংবা লাভবার্ডই বেশি আকর্ষণীয় লাগত বরাবর...। অদ্বিতীয়ার লেখা হিজিবিজি কবিতাগুলো অনিন্দ্য চোখ দিয়ে পড়লেও মন দিয়ে কখনই পড়া হয়ে ওঠেনি তার। বিয়ের আগে প্রেমিক যতটা মেকি নির্ভরশীলতার আবরণে ঢাকা ছিল, বিয়ের পর সেই আস্তরণের ছিটেফোঁটাও চোখে পড়েনি  অদ্বিতীয়ার। আনিন্দ্যর অফিস পার্টির জাঁকজমক, সংসারের জটিলতা আর কিছুটা অনুপ্রেরণার অভাবই  অদ্বিতীয়ার লেখা ডাইরিগুলোকে কিলো দরে বেঁচে দেওয়া বেশী মূল্যহীন করে তুলেছিল। তবু তার মনের লেখিকা স্বত্বাটা বাঁচিয়ে রেখেছিল তার স্কুলের চাকরিটাই। দুএকটা অনুষ্ঠান কিংবা স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা ছাপানোর তাগিদেই মাঝে মাঝে লিখতে বসতো  অদ্বিতীয়া। তবে পাঠকের অভাবে সব লেখাই সম্পূর্ণতার ভিড়ে কিছুটা অসম্পূর্ণতা লাভ করে।

অন্তঃস্বত্বা  অদ্বিতীয়াও তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে হাজার হাজার স্বপ্নের রঙে খাতা ভরাত। ভেবেছিল ছেলে বা মেয়ে বড় হলে শ্রেষ্ঠ উপহারগুলো তুলে দেবে তাদের হাতে। তবে না, আবারও  অদ্বিতীয়ার পরাজয়। তাদের ছেলে অরণ্য একদমই মায়ের মত লেখনির ভাবাবেগে বিশ্বাসী নয়। বরং বাবার কিনে আনা ইলেক্ট্রনিক্স গেজেটের ভিড়ে মায়ের সাজানো ভালবাসা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছিল অরণ্যের কাছে।

অনিন্দ্যর মৃত্যু এবং আই আই টি ফেরত ইঞ্জিনিয়ার অরন্যের নতুন করে সাজানো সংসারে  অদ্বিতীয়ার অপ্রয়োজনীয়তা- এই দুটো ঘটনাই বোধহয়  অদ্বিতীয়ার জীবনের শেষ ঘটনা। অল্প বিস্তর প্রভিডেন্ট ফাণ্ড এবং পেনশনের টাকায় ব্রিদ্ধাশ্রমের দিনগুলো  অদ্বিতীয়ার মন্দ কাটছিল না। বরং জীবনে এই প্রথম সে নিজের মনের মত করে দিনগুলো অতিবাহিত করার সুযোগ পেল। বৃদ্ধাশ্রমের হাজার অপ্রয়োজনীয় মানুষের লক্ষ্য রকম জীবনের গল্পগুলোই হয়ে উঠল  অদ্বিতীয়ার লেখনীর বিষয়। আর ওই অপ্রয়োজনীয় মানুষগুলোরও বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠল তাদের নিজেদের গল্প।

অদ্বিতীয়ার লেখাগুলো নিয়ে এখানকার সবাই বড্ড বেশি  মাতয়ারা। তার কপালে এতটা সুখও ছিল? জীবনের সেশপ্রান্তে এসে পৌঁছানো সর্বহারা মানুষগুলোর মৃদু হাসি আর স্বল্প বাহবাই  অদ্বিতীয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। দুএকটা ম্যাগাজিনে আজ তার লেখা ছাপা হয়, “অবসর” নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।  অদ্বিতীয়ার নিজের ভাষায় লেখা বৃদ্ধাশ্রমের গল্প। লেখিকা হিসাবে একটু আধটু নামডাক হয়েছে। রাস্তাঘাটে অনেকেই আজকাল অটোগ্রাফ চায়, ছোট্ট থেকে এতদিন ধরে দেখে আসা স্বপ্নটা হয়তো আজ একটু হলেও সার্থক।

হ্যালো টেস্টিং হ্যাল”- মাইকের শব্দে ঘর কাটল  অদ্বিতীয়ার। অনুষ্ঠান প্রায় শুরু হওয়ার পথে। ফুল, গল্পের বই, সাদা শাল সবই রাখা হয়েছে শুধু  অদ্বিতীয়ার জন্য। কিন্তু দর্শকের আসনে বসে থাকা বৃদ্ধ বৃদ্ধার ফোকলা দাঁতের আন্তরিক হাসিটাই তার সম্বর্ধনার শ্রেষ্ঠ উপহার।

ফুল সাজানো দরজাটার দিকে চোখ পড়তেই  অদ্বিতীয়া দেখতে পেল স্যুট-বুটে ছেলে থেকে লোকে পরিণত হওয়া অরণ্য একটা বছর পাঁচের ছেলের হাত ধরে ব্যাস্ত পৃথিবী থেকে পা রাখছে অবসরের দুনিয়ায়। কিন্তু কেন? মায়ের লেখা পড়ে অরন্যের ফিকে হয়ে আসা মনে কি সত্যি পরিবর্তনের জোয়ার এল? সেকি মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়? হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি আর শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে চলা স্রোতের গতি দুটোই একনাগাড়ে বেড়ে চলেছে  অদ্বিতীয়ার।  কিন্তু না! সময় আরন্যকে বদলাতে পারেনি। মনের বদল না, অরন্যের কর্তব্যে বদল এসেছে। ছেলে এবং স্বামীর গণ্ডী পেড়িয়ে আজ আরন্য বাবা হয়েছে। নাম করা লেখিকা মায়ের “রেফারেন্স” নিয়ে ছেলেকে ভর্তি করতে চায় শহরের নাম করা ইংলিশ  মিডিয়াম স্কুলে। শুধু টাকায় হয়তো কাজ হয়নি, তাই আরন্যের মায়ের কাছে ফেরা। সংসার জীবনের নিষ্ঠুরতা আজ আর  অদ্বিতীয়াকে নতুন করে নাড়া দেয় না।

 মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিন করা ভুলটার পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে অনায়াসেই অরণ্যকে ফিরিয়ে দিয়ে সে বলতে পারল “আমার জীবনের মেয়ে, স্ত্রী, মা নামক মূল্যহীন স্বত্বাগুলোকে মেরে ফেলে আজ আমি শুধুই লেখিকা  অদ্বিতীয়া”