গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৯ মার্চ, ২০১৪

সূর্যনাথ ভট্টাচার্য


দিদিমা


আমাদের পাড়ার বারোয়ারী দিদিমার মত আশাবাদী মানুষ খুব কম হয়। বয়েস তাঁর সত্তর আর দাদুর বাহাত্তর। দুজনেরই মাথাজোড়া টাক, মুখে একটিও দাঁত অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তাই বলে দিদিমার দাপট কম নয়। সর্বদা নিজের শরীরের যত্ন নেন আর দাদুর দিকেও রাখেন কড়া নজর। দুজনেরই শরীর বেশ ফিট, তাঁরা থাকেনও ফিটফাট। দাঁত বাঁধিয়েছেন, চুল যতদিন ছিল নিয়মিত পরিচর্যা করেছেন, ক্রীম সাবানে ত্বকের যত্ন নিয়েছেন। ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি সব দূরে, এলাকার সব ছেলে-বুড়োকে তাঁরা আপন করে নিয়েছেন। তাঁরা এখন আমাদের পাড়ার সার্বজনীন দাদু-দিদিমা। সেদিন তাঁদের বাড়ী গিয়ে দেখি দিদিমার মুখ গোমড়া। আমি তাঁকে চাঙ্গা করতে বললাম'হাউ ডু ইউ ডু, দিদিমা?'

—'আ গেল যা, আমি কি করে করি তা তোকে বলবো কেন রে মুখপোড়া?' দিদিমা মুখ ঝামটা দিলেন। তারপর গলা নামিয়ে কপট চিন্তার ভান করে বললেন, 'আমি মরছি নিজের জ্বালায় আর কোত্থেকে উনি এলেন হা-ডু-ডু খেলতে।'
—'আরে দিদিমা, চটছো কেন? দাদু কিছু বলেছে নাকি? 'দাদু বারান্দায় খবরের কাগজ পড়ছিলেন, গলা বাড়িয়ে বললেন, 'আমি কিচ্ছু বলিনি গো। শুধু নাতিটা কাল ফোন করে জিজ্ঞেস করলে, দাদু তুমি ঠাম্মাকে বিয়ে করলে কেন? তা আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে, দেখেছো, নাতিটাও আফসোস কচ্ছে। তাইতেই...।' তীরটি ছেড়েই দাদু আবার কাগজে মন দিলেন।
—'মরণ দশা আমার।' দিদিমা মুখভঙ্গী করে বললেন, 'এই জন্যেই মিনতির ছেলেটাকে ঐ কথা বলেছিলাম।'
—'
কি বলেছিলেন দিদিমা?'
—'সেদিন মিনতির ছোট ছেলে, ভারি মিষ্টি দেখতে হয়েছে ছেলেটা, এসে বললে, দিদিমা, দাদুর সম্বন্ধে ক'টা লাইন ইংরিজিতে বলো তো। আমিও বললাম, ওরে আমি সেকালের স্কুল ফাইনাল পাস। ভেবেছিস কি বলতে পারবো না? খুব পারবো, শুধু হাড়হাভাতে আর অলপ্পেয়ের ইংরিজিটা একটু দেখতে হবে। 'দাদু ওদিক থেকে হো-হো করে হেসে উঠলেন, 'আহা, গিন্নি আমার প্রথম নাতি হওয়া থেকে আমার ওপর সেই যে রেগে গেছেন, আজও তা কমলো না। দোষের মধ্যে নাতি জন্মাবার খবর পেয়ে বেয়াইকে বলেছিলাম, ল্যাও, এবার থেকে এক ঠাকুমার সঙ্গে শুতে হবে।'
—'
আ গেল যা, বুড়োর রস যে উথলে পড়ছে' দিদিমা আবার দাদুকে ধমকালেন, 'কচিকাচাদের সামনে আদিখ্যেতা কত্তে লজ্জা করে না?
'দাদু-দিদিমার এসব খুনসুটি চলতেই থাকে। দিদিমার কাছে আর সবাই কচিকাচা। অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলাম, মাথায় চুল তো নেই। তাও আয়নার সামনে মাথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কি দেখে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, 'আয়নায় অত কি দেখছেন দিদিমা?'
—'চুলটা দেখে নিচ্ছিলাম একটু। বিকেলে ক্লাবে মিটিং আছে, হেয়ারস্টাইলটা ঠিক কত্তে হবে না?'
—'
কেশবতী কন্যা আমার। এই বয়েসে এমন চুলের ঢাল তোমরা কোথাও দেকোছ? আর ক'গাছা রয়েছে বলে দাও তো ডারলিং?' দাদুর ঠাট্টার স্বর ভেসে এলো।
—'মিনসেকে মশকরা কত্তে মানা কর বিনি,' দিদিমা দাদুর উদ্দেশ্যে তর্জন করলেন। তারপরেই আমার দিকে চেয়ে প্রফুল্লস্বরে বললেন, 'এখনও পুরো তিনগাছা আছে। দিব্যি বিনুনি করা যাবে, বল?'

দিদিমার এই রূপটাই আমাদের অবাক করে, কিছুতেই তিনি দমে যান না। তাড়াতাড়ি বললাম, 'ঠিকই তো। চমৎকার বেড়া বিনুনি হবে।' বললাম তো, কিন্তু সত্যি ঐ কেশ বিহীন মাথায় আবার না চলে যান। তাই একটু কায়দা করে বলি, 'তবে মিটিংএ সঙ্গীতা মাসিমাও তো আসবে। আপনার নতুন উইগটা সেদিন দেখতে চাইছিলেন। বিনুনির ওপর ওটাও চাপিয়ে নেবেন না হয়।'
এর ক'দিন পরে দাদুর সাথে বাজারে দেখা। টেনে বাড়ী নিয়ে গেলেন। আমি একা না, সঙ্গে রবি ছিল। রবি আমার শালা, বয়স আমার চেয়ে খানিকটা কম। সেই জন্যেই বোধহয় একটু বেশী ফাজিল। দাদু আমাদের তাড়া দিয়ে বললেন, 'চল চল, তোদের দিদিমা কি যেন বলবে বলছিল।'
—'
ও দাদু, অতো তাড়া কেন? দিদিমার জন্যে মন কেমন করছে?' রবির গলায় ফাজলামির ইশারা।
দাদু একটু আমতা আমতা করছেন দেখে রবি যাত্রার ঢং-এ দু'হাত ছড়িয়ে বললে, 'আহা, দেখেছেন জামাইবাবু, এখনো কি প্রেম! 'দাদু কটমট করে চোখ পাকালেন, তাইতে রবি আদুরে গলায় বললে, 'আচ্ছা দাদু, সত্যি করে বলুন তো আপনি দিদিমাকে ভালবাসেন না?
—'ডেঁপো ছোকরা, তোমার দিদিমার বয়স কতো হল জানা আছে?'
—'তাতে কি, প্রেম থাকলে এই বয়সেও কতো কি আবিস্কার করা যায়।'
—'ওরে হতচ্ছাড়া, আমি কি প্রত্নতাত্বিক? এখনো আবিস্কার করে বেড়াবো?'
আমি হাসি চেপে বললাম, 'আমি কিন্তু জানি দাদু আপনি দিদিমাকে কতো ভালবাসেন। তুমি জানো রবি, দাদু দিদিমাকে এখনও হানি, ডার্লিং, প্রিয়তমা এইসব বলেই ডাকেন। 'রবি ডানহাতটা মুঠি পাকিয়ে বলতে যাবে, 'ইয়ে-এ-এ', দাদু তাকে থামিয়ে একটু মুচকি হাসি দিলেন। বললেন, 'আসলে ব্যাপারটা তো তোমরা জানো না। আমিও কাউকে বলি না...।' রবি সুযোগ পেয়ে গেল, নাছোড়বান্দার মতো বলতে লাগলো, 'দাদু বলুন দাদু, আমাকে বলুন প্লীজ... আমি কাউকে বলবো না।'
দাদু চোখ বড় বড় করে চাপাগলায় যেন রহস্য ফাঁস করলেন, 'আসলে ওর নামটা বহুকাল আগেই ভূলে গেছি। আর জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় নি।'
—'তবে যে আপনি দিদিমাকে কিসমিস বলেন?'
—'বিয়ের সময় শুনেছিলাম, ওর ঠাকুরদা আদর করে ডাকতেন আঙ্গুরবালা বলে।'
রবি উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো, আমিও। দাদু মুচকি হেসে বললেন, 'আরে হয়েছে হয়েছে। এবার জলদি চল দিকিনি, বাড়ী গিয়ে চুপি চুপি তোমাদের দিদিমার শাড়ীটা আবার খুলতে হবে।'
আমি চমকে গেছি। দাদু মাই ডিয়ার লোক জানি, কিন্তু তাই বলে এরকম অশ্লীল রসিকতা...। রবি বললে, 'এমা দাদু, ছি ছি...।'
—'আরে তোমরা যা ভাবছ তা নয়। এই দেখনা, ভুল করে তোমাদের দিদিমার শাড়ীখানা জড়িয়ে চলে এসেছি।' খেয়াল করে দেখি দাদুর পরনে সত্যিই একখানা লালপেড়ে ঢাকাই শাড়ী লুঙ্গির মতো করে জড়ানো। তাই দেখে রবির খ্যাক খ্যাক করে সে কি হাসি। আমরা দিদিমার কাছে আসতেই তিনি দাদুকে অগ্নিদৃষ্টিতে ভস্ম করে বললে, 'এই যে, ভীমরতি না হয় ধরেছে, তা বলে সং সেজে বাজার যাবে?' তারপর আমাদের দেখেই হইহই করে উঠলেন, 'ওরে দারুণ খবর। তোরা শুনলে পাগলা হয়ে যাবি।'
—'কিকি খবর দিদিমা?
'—'আরে পুজোয় ক্লাবে নাটক হচ্ছে। আমি পাট করবো।' দিদিমার খুশি আর ধরে না।
—'
দ্যাটস গ্রেট! দাদু আপনার উচিৎ দিদিমাকে এখুনি একটা চুমু দেওয়া।' রবির ফচকেমিতে আমিও বেশ বিব্রত। দিদিমার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, তাচ্ছিল্যভরে বেশ স্পোর্টিংলি বললেন, 'হুঁ, তবেই হয়েছে।' আস্কারা পেয়ে রবি আবার দাদুকে ধরলে, 'দাদু বলুন না আপনি দিদিমাকে কখন প্রথম চুমু দিয়েছিলেন?' দাদুও কম যান না। এক অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বললেন, 'প্রথম? শেষ কখন দিয়েছি তাই মনে নেই।' এই বলেই টুক করে পাশের ঘরে ঢুকে পড়লেন।
—'অসম্ভব, মিনসেটাকে নিয়ে আর পারা যাবে না।... ছাড় দিকিনি,' দিদিমা দাদুকে এবার নস্যাৎ করে বললেন, 'আজ বিকেলের মিটিংএ ঠিক হবে কে কি পাট করবে। অঘটন নাটক, দারুণ বই। যে রোলই পাই, দেখবি ফাটিয়ে দেবো।' দিদিমা আহ্লাদে আটখানা। দিদিমার আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হতে হয়। একবারও ভাবছেন না, এই বয়সে তিনি কি পার্ট করতে পারবেন? আদৌ পারবেন কিনা? আমি প্রসঙ্গ পালটে বলতে গেলাম, 'দিদিমা আজকের মিটিংএর হেয়ারস্টাইলটা...।' কিন্তু দেখি দিদিমা একটু অপ্রতিভ হয়ে আয়নার দিকে ফিরে দেখলেন। একটু উদাস হয়েই যেন বললেন, 'জানিস বিনি, আরো একগাছা চুল গেছে। বাকি রয়েছে দু'টো।'

দিদিমা কি আশাহত? তা আবার হয় নাকি? পরক্ষণেই উচ্ছসিত হয়ে বলতে লাগলেন, 'গেছে তো গেছে। যাবার তো ছিলই, গেছে। আমার ভারি বয়ে গেছে। এখনও আমি বেশ করে সিঁথি কেটে চুল বাঁধতে পারবো। কি বল, বিনি?' আমি কি বলবো ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। দুটো চুল দুদিকে করে দিলে মাঝে সিঁথি হয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কি! দিদিমাই বললেন, 'থাক আর উপদেশ দিতে হবে না। আমি জানি। সেদিন সঙ্গীতা মিটিংএ আসেনি। উইগটা এখনও ও দেখেনি। ... আজকে দেখিয়ে দেবো রে বাপু।'

এরপর ক'দিন আর যাওয়া হয় নি। সেদিন সক্কালবেলায় ভাবলাম, যাই একবার দেখা করে আসি। দিদিমার বাড়ী গিয়ে দিখি, দিদিমা সোফায় বসে জানলার বাইরে চেয়ে আছেন। কিন্তু টাক কোথায়, দিদিমার মাথায় ঘন বাদামী রঙের চুলের ঢেউ। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। এক ধাক্কায় বয়সটা যেন বিশ বছর কমে যেতে গিয়েও থমকে গেছে তা শুধু মুখের মধ্যে দাঁতের পাটিটা নেই বলে। দৃষ্টিটা বহুদূরে বিস্তৃত, মুখে একটা বিষণ্ণতা। যেন পাথরপ্রতিমা। দাদুকে ধারে কাছে দেখলাম না। আমি ঘরে ঢুকেছি বুঝতে পারেন নি। আমার ডাক শুনে একটু চমকে আমার দিকে ফিরলেন। তারপরেই আমাকে দেখে চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সেই পরিচিত হাসিটা ফিরে এলো। ঝরঝর করে বললেন, 'ওমা বিনি? এতো সকালে? ভালো করেছিস। কাল সেজঠাকুরপো এসেছিল, বর্ধমান থেকে। একগাদা সীতাভোগ নিয়ে এসেছে। দাঁড়া নিয়ে আসছি।' উঠতেই যাচ্ছিলেন, আমি থামিয়ে বললাম, 'সীতাভোগ হবে দিদিমা, আগে বলুন দেখি এসব কি? আপনাকে মেকাপে যা লাগছে, কি বলবো, আমাদের বিপাশাও হার মানবে। কিন্তু ব্যাপারখানা কি?'
—'বলছি, তুই বোস তো।' বলে দিদিমা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। আমি আবার বললাম, 'কি অত ভাবছো দিদিমা?'
—'জানিস, গত বছর তোর দাদুর জন্যে একটা টুপি কিনতে গেছিলাম। টুপিওয়ালা ছোঁড়াটাকে বললাম, তোমার দাদুর জন্যে একখান টুপি দাও দিকিনি। আজও একটা চুল উঠে গেছে। তাই শুনে ছোঁড়া বলে কিনা, দাদুর একটা চুল উঠতেই টুপির দরকার পড়লো দিদিমা? তাকে আর বলি কি করে ওটাই ছিল বুড়োর শেষ চুলটা।' দিদিমার স্বরে বিষণ্ণতা। জানতাম দিদিমা দাদুকে খুব ভালবাসেন, কিন্তু একথা হঠাৎ কেন বললেন বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, 'দাদুকে তো দেখছি না?'
—'
বুড়ো ঢুকেছে বাথরুমে, ব্রাশ করতে। তুই বোস।' বলে দিদিমা চলে গেলেন পাশের ঘরে, বোধহয় সীতাভোগ নিয়ে আসতে। আমি চারদিকে চেয়ে দেখলাম, আসবাব সব সেইরকমই আছে। দেওয়ালে ঘড়িটা একইভাবে টিক টিক করে চলেছে। কিন্তু কি যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে, আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। এইরকম সময়ে আগে কখনও আসিনি, তাই কি অন্যরকম লাগছে? দিদিমা ফিরলেন সীতাভোগ আর কচুরি নিয়ে। টেবিলের ওপর সব নামিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমার চোখে মস্ত জিজ্ঞাসার চিহ্নটা দেখতে পেলেন। 'কালকে আবার মিটিং ছিল রে। ফিরে এসে থেকে আর উইগটা খুলি নি। ... নে ধর, খা দিকিনি।' আমার অনুক্ত প্রশ্নের আদ্ধেক উত্তর দিয়ে একটা প্লেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। প্লেটটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'দাদুর ব্রাশ করতে এতক্ষণ লাগছে?'
—'আমারটাও করছে কিনা।' দিদিমা নির্বিকার ভাবে ব্যক্ত করলেন। এই বলতে বলতেই দাদু এসে ঘরে ঢুকলেন। ঘরের আবহাওয়াটা একটু স্বাভাবিক হয়ে এলো। স্বভাবসিদ্ধ গলায় দাদু বললেন, 'ভালো দিনে এসেছ হে। আজকেই সেই দিন যে দিন আমি স্বর্গবাসী হয়েছিলাম।'
—'
আহা, সকাল সকাল কথার ছিরি দেখো না...।' দিদিমা অসন্তুষ্ট। আমিও বললাম, 'এ আপনার অন্যায় দাদু। এ কথার কি মানে হল?'তখন দাদু বুঝিয়ে দিলেন, 'আহা, আজকের দিনেই তোমার দিদিমা এই অভাগার গলায় মালা দিয়েছিলেন যে। ঘরে নববধূ এলেন, ঘর স্বর্গ হয়ে গিয়েছিল। তাহলে আমি স্বর্গবাসী হলাম না?'
—'মরণদশা আমার। সক্কালবেলায় তোমার এই ছেঁদো রসকেতাগুলো একটু বন্ধ করবে?' দিদিমা যেন দাদুকে কপাটবন্ধ করে আমার দিকে ফিরে বললেন, 'তুই ওর কোথায় কান দিস নি তো। দাঁড়া বাসন্তী এলো বোধহয়, একটু চা বলে আসি।'
—'আমি এখন চা খাবো না দিদিমা। আপনি আগে বলুন কি হয়েছে। ক্লাবের মিটিংএ কি ঠিক হোল? কি পার্ট পেলেন আপনি?' আমি দিদিমার একটা হাত ধরে তাঁকে আবার বসালাম।
—'
দূর বাবা, তুইও যেমন। আমি এই বয়েসে স্টেজে উঠে ধেই ধেই করে...ম্যাগো...,' দিদিমা ঘেন্নায় মুখবিকৃতি করলেন, 'ছোট ছোট কচি কচি ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে কি কান্ডটাই না কচ্ছে। আর কি সব জামাকাপড়ের ছিরি...ছ্যা ছ্যা ছ্যা। বুঝি না বাপু তোদের কান্ড, এই বয়েসেই ধিঙ্গি মেয়েগুলোকে এঁচোড়ে পাকিয়ে ছাড়বে। আমাদের সময়ে বাপু এমনটা হতো না, ঐ বয়েসে আমরা তো স্বামীপুত্তুর নিয়ে সুখে ঘর করছি।' দিদিমা সেকালের তুলনায় একালের অধোগতিতে শিউরে উঠলেন।
—'
তার মানে আপনি নাটক করছেন না? আপনাকে পার্ট দেয় নি?' আমার গলায় আশঙ্কা। খুব খারাপ লাগছিল, অমন হাসিখুশী মানুষটা অত উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এখন কি ভাবছেন তিনি?
—'দেয় নি বললেই হোলো? ... আরে দেয় নি মানে কি? বলি হলে বসে হাততালি দেবার পাটটা থেকে বাদ দিতে পারবে আমায়?' বলেই দিদিমা জানলার বাইরে মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন। বুঝলাম পার্ট না পেয়ে তিনি আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই দমে যাবার মানুষ নন। দিদিমা, তুমি ধন্য। তুমি যুগ যুগ জিও। তুসি গ্রেট হো। ঘরের হাওয়াটা আবার ভারি হয়ে এসেছিল। হঠাৎ দাদু বলে উঠলেন, 'ওমা, আমার কেশবতী চিকুরকুমারীর লেটেস্ট খবর শুনেছ তো? শোনো নি? আরে, আমাদের বাড়ীতে চিরুনীর পাট এবার উঠলো। শেষজনও বিদায় নিয়েছেন।'দাদুর বেমক্কা রসিকতা করার অভ্যাস আছে জানতাম। কিন্তু এই কথাটা নিয়ে যে এতো নিষ্ঠুর রসিকতা করবেন, এটা ভাবিনি। দিদিমা দেখি গুম হয়ে গেছেন। আমার বুঝতে কিছু বাকি ছিল না, তাও জিজ্ঞেস করলাম, 'কি হয়েছে দিদিমা?' একটা বড় শ্বাস ছেড়ে দিদিমা বললেন, 'আমার মাথার শেষ চুলটাও পড়ে গেছে রে বিনি।' একবারের জন্যে মনে হল দিদিমার কণ্ঠস্বরে সব হারাবার ব্যথা। যা অবধারিত হবার ছিল, তা ঘটে গেছে। সেইজন্যেই দিদিমা উইগটা আর খোলেন নি। একটা একটা করে চুল যখন তাঁর চলে যাচ্ছিল, একটু একটু করে মনে শক্তি সঞ্চয় করতেন। আর নিজের স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছ্বাস দিয়ে তা ভুলে থাকতেন। মনের গোপনে চুল হারাবার দুঃখ তাঁর ছিল, তাই চুল যখন তিন থেকে দু'গাছায় এসে ঠেকেছিল তখনও নানান ছলছুতোয় কিন্তু সেটা কারুকে বুঝতে দেন নি। এবার তিনি কি বলবেন? কি করবেন তিনি? উইগটা কি তাঁকে যথেষ্ট স্বান্তনা দেবে? এমন আশাবাদী মানুষটা এখন কি বলে মনকে বোঝাবেন? স্তোক দেবার তো আর কিছুই রইল না।
আমার ভুল ভাঙ্গতে বেশী দেরী হল না। হঠাতই জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে দিদিমা বললেন, 'যাক ভালোই হল, বুঝলি। গেছে, বেশ হয়েছে, আর আমার কোন চিন্তা নেই। চুল বাঁধারই আর পাট রইল না। আমার একটা কাজ কমলো।'


দেখলাম দিদিমার মুখটা উজ্জ্বল। মুখে সেই আগের মতো উদ্ভাসিত হাসি। চোখের কোণটা শুধু একটু চিকচিক করছে।