গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৯ মার্চ, ২০১৪

দীপঙ্কর বেরা


ঘটনার ঘনঘটা


         বাজার করতে যাওয়ার পথেই বুঝে গেছি এর থেকে রেহাই পাওয়ার কোন রাস্তাই নেই । যত ভাবি আর ভাবব না ততই ভাবনা আসে ।
কাল যা ঘটে গেল আমরা তো জানি যে এর জন্য কে দায়ী আর এর প্রেক্ষাপট অনেকটা পেছনে । তবুও খবরে এসে গেল একেবারে সামনের ঘটনা । সেই কথাটা বলতেই বউ বলল – রাখ তো তোমার ভাবনা । যা ঘটেছে আর যা পড়ছ দুটোকে মেলানোর দরকার কি ? যাও সময়ে বাজার না করলে অফিসের আগে খাবার পাবে না ।
না , তুমি ভাবো কিভাবে দিনের পর দিন অরুণের উপর ......আর মেয়েটারও কিছু করার ছিল না ।  কার উপরে কিভাবে দোষটা চেপে গেল ।
বউ মুখে হাত দিয়ে আমাকে থামিয়ে বলল – চুপ , একদম চুপ । যা পড়ছ তাই গিয়ে যেখানে সেখানে আলোচনা করলেও করতে পারো তবে নিজের মত একদম প্রকাশ করবে না । করেছ তো মরেছ । সবার ভাবনার সাথে তাল মেলানোতেই জীবনের ছন্দ । নিজের মত মানেই কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে আর অন্য দলের বিপক্ষে ।
এখানেও রাজনীতি ।
তা তো হবেই । তাতে তোমার কাজ কি বাজারে যাও তো বাপু ।
কি সব কিনতে হবে তাই বার বার ভুলে যাচ্ছি । কানে ঢুকছে – অরুণটা এমন আগে জানতে পারি নি ।
সমাজটা কেমন হয়ে গেল ।
মেয়েদের বেরনো বিপদ হয়ে গেল । 
কেউ যেন অন্যের দিক থেকে নিজেকে ভাবতেই চাইছে না ।
আদিম প্রবৃত্তি যেন উল্লাস করে বেড়াচ্ছে ।
মানুষ আর মানুষ নেই ।
মাছ নিয়ে ফিরতে হবে । আর অপেক্ষা করলে চলবে না । প্রভাসবাবু চেপে ধরলেন – শুনেছেন । অরুণের কথা ।
হ্যাঁ পড়লাম । 
দূর মশাই , খবরের কথা ছাড়ুন তো । কতদিন ধরে মেয়েটি  প্রোভোক করেছিল জানেন ।  নিজের মতামত থেকে দূরে থাকার জন্য বললাম – কি জানি হবে হয়ত ।
প্রভাসবাবু এদিক ওদিক তাকালেন , আরো ফিস ফিস করে বললেন – জানেন একজনের দোষ আর একজনের ঘাড়ে পড়ে । যৌবনের ধর্মকে তো আর অস্বীকার করতে পারবেন না। মানুষ চারিদিকে যা দেখছে সব যেন আমার খোলা হাওয়া । তাতে নিজেদের সামলে রাখাই মুশকিল ।
এটা একটা বাহানা মাত্র । নিজেকে ঠিক জায়গায় ঠিক ভাবে ধরে রাখাই তো মানবতা ।
সেই মানবিক চেতনাও পরিস্থিতির চাপে হারিয়ে যায় । আপনি আপনার ছেলেকে কোনদিন মেরেছেন ।
হ্যাঁ । সে তো ওর ভালোর জন্য ।
আপনি শিওর তাতে ওর ভালো হবেই ।
না , ঠিক তা না একটু শাসনে তো রাখতেই হবে তা না হলে ......... 
– ঠিক তাই , শাসন  অনুশাসন ছাড়া সমাজ সংসার চলে না । তাকে যতই আলগা করবেন ততই এমন হবে ।
-  আপনার কি মনে হয় ওই যে ছেলেটি যাচ্ছে । দেখুন । আমি হাত তুলে অল্প ইশারায় একটা কিম্ভুত ছেলেকে দেখালাম । অনেকটা নীচে ছেড়া মত জিনস পরা , সামনের বোতাম খোলা সকালেই স্নানগ্লাস আর লাল সবুজ জুতো । আমি বললাম – ও তো কোন না কোন সংসারে আছে । অনুশাসনে ।
প্রভাসবাবু জমিয়ে ধরলেন – আমার তো মনে হয় নেই । কাজের জন্য কিংবা কাজ খোঁজার বাহনায় ছেলে মেয়েরা সব সাংসারিক সহবত শেখার আগেই আলাদা হয়ে থাকে । এই সিস্টেম বা ম্যানার ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে । এর হাওয়া গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে । সবার মাঝে বাগে পাচ্ছে না তাই আপনি নিরাপদ ।  কিন্তু যেখানেই পাচ্ছে সেখানেই ছাড়ছে না ।
সত্যি বা বা ! আপনি ভাবতেও পারেন । 
 - ওদের অনেকের সাথে অনেক জায়গায় মেয়েটিকে অরুণকে আমি নিজের চোখে দেখেছি । আর বিশ্বাস করেছে মেয়েটি । তাতে তারও দোষ নেই ।  এখন সে সব কিছুই চাপা পড়ে গেছে সামনে এসে পড়েছে কালকের ঘটনা । যেহেতু মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াই শুরু তাই ঘটনার রঙও ছড়িয়ে পড়ছে । তাহলে মানুষ কিভাবে চলাফেরা করবে ?
আমি বেশ চিন্তার সুরে বললাম – তদন্তে সামনে অনেক কিছুই আসবে ।
তা আসবে ।
আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে । চললাম প্রভাসবাবু । পরে কথা হবে । ঘরে ঢুকেই চুপচাপ হয়ে গেলাম । একে দেরি তার উপর যদি একথা তুলি তা হলে আর রক্ষে থাকবে না । আমি অফিসে আর ছেলে স্কুলে একই সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ।
ঘটনাটা যেহেতু বেশ মুখরোচক , তাই অফিসে আলোচনা হতে লাগল । আমি নাক গলালাম না । সংবাদে যা লেখা তাই কথার ফাঁকে ফাঁকে কথা তুললাম । পক্ষে বিপক্ষে কিছু বললাম  না । মিতুনবাবু বললেন – খোলামেলা সিনেমাই দায়ী ।
মিলন টান দিল – বিজ্ঞাপন আরো খারাপ ।
সমীর এক কাঠি উপরে – না না , মেয়েরাই দায়ী । রাস্তা ঘাটে যে ভাবে গায়ে ঢলে পড়ে । সোহম তাল দিল – সমাজ সিস্টেম দায়ী । 
শুনেই চুপচাপ মিনতিদি জ্বলে উঠলেন – আচ্ছা , আপনি বাসে মেয়েদের গা ঘেঁসেই দাঁড়ান  কেন ?কেন ভাবেন মেয়েরা শুধুই আপনার ভোগের পেয়ালা । সকাল থেকে সন্ধ্যে সবাই দৌড়চ্ছে নানান কাজে । এর ফাঁকে এই সব অমানুষ পশুর দল , হঠাৎ চাগাড় দিয়ে উঠল কেন না উনি বীর পুঙ্গব । কি যেন বীরত্ব ! আমি নেশায় বুঁদ হওয়া একমাত্র । কি চায় এই সব অপাংক্তেয়রা ? কোন সুখের জন্য এমন করে কে জানে ? আদিমতা কি এতই তরল তুচ্ছ সাধারণ ? তাকে এভাবে ধ্বংসের বহ্নিশিখায় নামিয়ে আনছে । এখন মেয়েরা যদি একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি তখন কি হবে এই সমাজ ? 
এত ঝাঁ ঝাঁ কথার মাঝে সবাই থ । চুপ । আমাদের বস  ম্যাডাম মিনতিদিকে বসালেন – এত উত্তেজিত হবেন না । শান্ত হন । 
কি করে শান্ত হব ? চারিদিকে যা পরিস্থিতি বলার নয় । আমি জানি সমীরদা মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান করেন । আইন যতই মেয়েদের পক্ষে থাক , পুরুষ সমাজ সেই আগের ভাবনাতে থেকে গেছে । যেন পৃথিবীর বুকে সাজানো ভোগ্য অস্তিত্ব । যখন যেভাবে যেখানে পাও শুধু ভোগ করে যাও । কাজ যাই কর মেয়েরা যেন মানুষ নয় । তাদেরকে যেভাবে পারো দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেল । এই মানসিকতা থেকে না পুরুষ না স্ত্রী কেউই বেরুতে পারছে   না । শুধু নিজের নিজের সুরক্ষার কথা ভাবছে ।  ফলে মেয়েদের উপর অত্যাচার ক্রমেই বাড়ছে ।
সবাই অবস্থা খারাপ বুঝে যে যার কাজে লেগে পড়ল । আমি একটা কথাও বলি নি । বলেই অনেকবার ফেঁসেছি । এক কথার আর এক মানে করে টেনশন । তার উপর আছে রাজনীতির গ্যাঁড়াকল । সেটা আবার বাড়িতে বললে মিসেস বলে আমারই দোষ । আমি যতই নিজেকে ঠিক মনে করি না কেন ।
         অরুণ সেদিন ঠিক কি পরিস্থিতির মধ্যে ছিল আমি কেন কেউ জানে না । মেয়েটি জানতে পারে এবং সে যদিও বলে তার হিসেবে ঠিক যেটা সেটাই সে বলবে । অন্য অনুভূতি ভাবনা ইশারা এ সব গ্রাহ্য নয় । কিন্তু যাই ঘটুক মানুষের এই দখল প্রবৃত্তির মনোভাব মোটেই ভাল নয় । 
বিকেলের চায়ের আড্ডায় একই আলোচনা । সেই ভোর চারটে থেকে মনোজ দোকান খুলে ফেলে । বন্ধ নটা নাগাদ । ওই শুরু করল – জানেন মেয়েটার কিছু হয় নি । তবে ঘটনাটি ঘটেছে । এখান দিয়ে তো যায় । ভাল মেয়েটি । যাকে বিশ্বাস করেছিল সেইই যদি ......। মানুষ তাহলে কোথায় যাবে
ললিতদা অভিজ্ঞ । বয়সী । রসিক – তবে মনোজ ,  পুংকেশর গর্ভকেশরকে যেমন পাপড়ি দিয়ে ফুল লুকিয়ে রাখে । তেমনি ভাবনা সবার থাকা উচিত ।
কি বললেন দাদা ? আমি তো আমাদের অরুণের পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছি ।
আমি চায়ের গ্লাস রেখে বললাম – ললিতদা তাই বলছেন । ছেলেমেয়েরা যেন যৌবন দেখাতে ব্যস্ত । দেখতে দেখতে উত্তেজনা সারাদিন মনের মধ্যে ঘুর ঘুর করে , সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে । মনে থাকে না সে কি করছে ।
ললিতদা হুঁ বলেই টান দিলেন – কি আর করা যাবে । যুগের কালচার । এত অঘটনের মাঝে কিছুতেই চেতনা আসছে না । কি হবে ভবিষ্যতের । অরুণদের জীবন গড়ার এ কেমন  চিন্তা কে জানে । সময় সুযোগে যা সহজেই সহজলভ্য তাকেই এ ভাবে কব্জা করা ! সেম ! সেম ! মনোজ চা দিতে দিতে সব শুনছিল । কিছুই বুঝতে পারল না । আমিও না বোঝার ভান করে বাড়ি ফিরে আসি ।
ছেলেকে পড়াতে পড়াতেও মিসেস আমার দিকে তাকাল না । বুঝলাম মুখ ভার । সারাদিনের কাজের মধ্যে কি ভুল করেছি তার হিসেব করার চেষ্টা করলাম । জানি ভুলটা বলবে না , কিন্তু আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে । কেন করে কে জানে ? এ ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলে মুখের যদি ইচ্ছে করে মুখ বদলের তখন .........। মনের এইসব চিন্তা থেকে রাতেও মুক্তি পেলাম না ।