জীবন যেমনটা
--একটু ভিক্ষা দিবা মা !
--কেন,খেটে খেতে পার না গো
? দিব্বি তো শক্ত সমর্থ মনে হয় ! ঘরের গিন্নী
মা দু মুঠো চাল ভিখারিণীর আঁচলে ঢেলে দিতে দিতে বলে উঠলো।
এমনি কথা
অনেক জায়গা থেকেই শুনেছে ভিখারিণী,মন্দা। কেউ কারো কষ্ট বোঝে না--শরীরটা কিভাবে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দুটো পেটের যোগার করতে হয় সে কেবল সেই জানে।
--খেটে খেতে পার না ? শুরুতে এ কথা শুনেছে
মন্দা,এক জাগায় কাজ করবে বলে ঢুকে ছিল। দুদিন পর,তিনদিনের
দিন ছাড়িয়ে দিয়ে ছিল তাকে। এ পোড়া শরীর যে অসুখের ডিপো--তাড়াতাড়িতে
একটার জাগায় দুটো কাজ করতে গেলেই হাঁপ উঠে যেত মন্দার।
--তোমার তুকুনুকু কাজে আমার তো চলবে না বাপু !
একদিন মন্দার সময় ও বয়স ছিল। সেও স্বপ্ন
দেখত নিজেদের ঝুপড়ি ঘর ছাড়িয়ে কেউ তাকে ডাক দেবে--নিয়ে যাবে পাকা ঘরে--দেখতে শুনতে সে তো খারাপ নয়--ভাঙ্গা বাঁশ বেড়ার
ফাঁক দিয়ে সে আকাশের চাঁদ দেখত। তারাদের বাগান দেখত। দূরের বাঁশির আওয়াজ শুনত।
সুজন প্রায়ই আসত। ওর বাড়ি আছে--সুন্দর লাল রঙা
এক বাইক চড়ে ফটফটিয়ে এসে ঢুকত এই বস্তিতে। প্রথম দিনই মন্দাকে সে দেখে নিয়ে ছিল। বাইক
থেমে গিয়েছিল তার।
--একটু জল খাওয়াবে ? বাইকে বসেই মন্দার দিকে মোহিত
চেয়ে থেকে বলে ছিল সুজন।
মন্দার স্বপ্ন কি তবে সত্যি হতে চলেছে ? হালকা হাসির রেখা
ফুটে উঠেছিল তার মুখে। সুজনের চোখে ওর চোখ পড়ে গিয়ে ছিল--সুজনের
দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলেছিল,হ্যাঁ,জল আনছি।
জল দিয়ে ছিল। জল দিতে গিয়ে হাতে হাত ছুঁয়ে ছিল। আনন্দের শিহর জেগে উঠেছিল উভয়ের শরীরে। পান খাওয়া লাল ঠোঁটের ফাঁকের সিগারেটে টান দিয়ে সুজন স্টার্ট দিয়ে ছিল তার বাইক। মুখে লম্বা রেখার হাসি ছেড়ে সে হুস করে সেদিন চলে গিয়েছিল।
তারপর থেকে সুজন প্রায়ই আসত মন্দাদের ঝুপড়ি ঘরে। সত্যি স্বপ্ন সাকার করে সুজন বিয়ে করে নিলো মন্দাকে। কটা বছর সুখে দুখে কাটল। সুজনের বাবা মা ভাইরা কেউ বিয়েটা ভাল চোখে দেখে নি। মন্দাকে সব সময় খোটা শুনতে হত ওদের সবার কাছ থেকে।
সুজন বাড়ি থাকত কম। ঠিকাদারির কাজ করত--ঘরে আসলে মন্দা তার সুখ দুঃখের কথা বলত সুজনকে--সুজন শুনত কিন্তু তার প্রতিকার কিছুই করতে পারত না। তবু মন্দা ভাল ছিল--কিছু না হলেও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সে চেষ্টা তো করত। চেষ্টা করত সুজনকে আরও ভালবাসার,আরও আদরে সোহাগে ভরিয়ে দেবার। কিন্তু সুজন ঘরে থাকে কত সময় ! মাঝ রাতে আসে,সকাল দশটায় ঘুম থেকে ওঠে আবার তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায় কাজে।
জল দিয়ে ছিল। জল দিতে গিয়ে হাতে হাত ছুঁয়ে ছিল। আনন্দের শিহর জেগে উঠেছিল উভয়ের শরীরে। পান খাওয়া লাল ঠোঁটের ফাঁকের সিগারেটে টান দিয়ে সুজন স্টার্ট দিয়ে ছিল তার বাইক। মুখে লম্বা রেখার হাসি ছেড়ে সে হুস করে সেদিন চলে গিয়েছিল।
তারপর থেকে সুজন প্রায়ই আসত মন্দাদের ঝুপড়ি ঘরে। সত্যি স্বপ্ন সাকার করে সুজন বিয়ে করে নিলো মন্দাকে। কটা বছর সুখে দুখে কাটল। সুজনের বাবা মা ভাইরা কেউ বিয়েটা ভাল চোখে দেখে নি। মন্দাকে সব সময় খোটা শুনতে হত ওদের সবার কাছ থেকে।
সুজন বাড়ি থাকত কম। ঠিকাদারির কাজ করত--ঘরে আসলে মন্দা তার সুখ দুঃখের কথা বলত সুজনকে--সুজন শুনত কিন্তু তার প্রতিকার কিছুই করতে পারত না। তবু মন্দা ভাল ছিল--কিছু না হলেও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সে চেষ্টা তো করত। চেষ্টা করত সুজনকে আরও ভালবাসার,আরও আদরে সোহাগে ভরিয়ে দেবার। কিন্তু সুজন ঘরে থাকে কত সময় ! মাঝ রাতে আসে,সকাল দশটায় ঘুম থেকে ওঠে আবার তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায় কাজে।
আরও তিনটে বছর এমনি ভাবে কেটে গেল। মন্দার কোলে কোন সন্তানও এলো না।
এমনি এক দিনের কথা—হঠাৎ পাড়ার কজন এসে
খবর দিল,সুজনের এক্সিডেন্ট হয়েছে--খুব খারাপ অবস্থা। ছুটে গেল বাড়ির সবাই। মন্দাও গেল। সাদা কাপড়ে জড়ানো সুজনের
দেহ তখন হসপিটালের এক কোণে পড়ে ছিল। তখন কেঁদে ছিল মন্দা--বুক নিংড়ে তার কান্না বেরিয়ে এসে ছিল--এক সময় চীৎকার করে কেঁদে উঠে ছিল
ও। তারপর স্তব্ধতা নেমে এসেছিল--চুপ করে গিয়েছিল মন্দা।
ধীরে ধীরে সমস্ত ব্যথার ওপরে আলতো প্রলেপ
জমে উঠছিল। কিন্তু ঘরের যন্ত্রণা বেড়ে যাচ্ছিল। শাশুড়ির গঞ্জনা চরমে উঠেছিল, আমার ছেলেকে খেয়েছিস
তুই,মুখ পুড়ি ! আর কেন এ ঘরে পড়ে আছিস ? নিজের ঝুপড়ি ঘরে যা না ! সেখানে গিয়ে মর
!
--কোথায় যাবে মন্দা ? এক
মাত্র মা—সেও তো ক বছর আগেই মরে গেছে। আর তখন থেকেই নাকি তাদের
ঝুপড়ি ঘর কেউ দখল করে নিয়েছে। ঝুপড়ি বস্তির দলু,গুণ্ডা প্রকৃতির
লোক। ওর কবল থেকে ঘর উদ্ধার করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
তারপর এলো মন্দার জীবনের চরম দুর্ভাগ্যের
দিন। পরিকল্পনা হয়তো আগে থেকেই করা ছিল,শাশুড়ি এসে বলল,তুমি আমাদের
ঘর ছেড়ে দেও--ছেলে আমার মরেছে--আর
কিসের সম্পর্ক তোমার সাথে ?
--না,মা,আমি এখানেই থাকবো।
শাশুড়ি
চীৎকার দিয়ে উঠলেন,মামা বাড়ির আবদার নাকি ! তুমি এখনই এ বাড়ি থেকে
বের হও !
মন্দা
এবার শ্বশুরের পায়ে গিয়ে পড়ল,না বাবা আমি যাব না--আমি
এই বাড়ির বৌ !
--না কোন সম্পর্ক নেই--বেরো
এ বাড়ি থেকে--এখুনি বেরো তুই! শাশুড়ি
তেড়ে উঠলো। জবরদস্তি শ্বশুর শাশুড়ি দেওর মিলে মন্দাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল ঘরের
বাইরে। ঘরের বাইরে থেকে মন্দা অনেক সময় ধরে দরজা ধাক্কা দিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করে ছিল।
সব বৃথা হয়ে ছিল। কারো মনে এতটুকু দয়ার ভাব উদয় হয় নি।
শেষ রাতের দিকে মন্দা হাঁটতে হাঁটতে
ওদের বস্তির ঝুপড়িতে গিয়ে পৌঁছল। এখানে দলু গুণ্ডা থাকে। সঙ্গে একজন মেয়েছেলেও আছে। তখন ভোর হয়েছে--মন্দা ঝুপড়ি ঘরের
দরজায় ধাক্কা দিল। কয়েকবার ধাক্কার
পর ঘর থেকে মেয়ে ছেলের গলা ভেসে এলো,কে গো এত্ত সকালে ?
মন্দা কিছু বলল না,দরজায় আবার ধাক্কা
দিল। দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালো ঝুমনি,দলু গুণ্ডার রাখেল।
প্রথমটা আশ্চর্য চোখে মন্দার দিকে তাকাল,ওর বেশভূষা পরখ করে
বলে উঠলো,তুমি কে গা,এই সাত সকালে
?
--আমি মন্দা--এই ঝুপড়ি আমাগ ছিল।
--কোন রাম রাজত্বে গো--ঝুমনি সব জানে। তাই আরও জোর
গলায় বলে ওঠে।
--কে রে ঝুমনি ? গম্ভীর কাঠফাটা আওয়াজে দলু ঘরের
ভিতর থেকে বলে উঠলো।
--দেখো কে এসেছে--বলে কিনা আমাদের
এই ঝুপড়ি নাকি অগো ! ঝুমনি কোমর দুলিয়ে বলে ওঠে।
চোখ কচলাতে কচলাতে এক রাশ বিরক্তির
ভাব নিয়ে দলু বিছানা ছেড়ে উঠে আসে,মন্দার দিকে তাকিয়ে গলা ফেড়ে বলে উঠে,কে তুই ?
--আমি মন্দা,দলু দা,তুমি তো জানো এ ঘর আমাগ ছিল। মন্দা অনুনয়ের সুর মাখিয়ে বলে ওঠে।
আবার চোখ কচলে দলু তাকাল মন্দার দিকে।
মন্দা,সেই মন্দা,যাকে দেখেছে দলু,তার চোখ তো এই ঝুপড়ির সমস্ত মেয়েদের
না দেখে পারে না--তবে তখন বয়সটা তার তত পরিণত ছিল না। মন্দাকে
সে চেনে--এখন মোটামুটি ফিটফাট চেহারা,দলু বলে ওঠে,আমি থাকি এখানে--যে থাকে তার অধিকার--তুই জানিস সেটা ?
--বাড়ি থেকে আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে--আমি কোথায় যাই বল --দলু দা ? মন্দার সুরে কান্নার অনুনয় বিনয়ের প্রার্থনা। তাকিয়ে ছিল দলু মন্দার দিকে--মনে মনে অঙ্ক কষছিল।
চলবে, দুটোর একটাকে রেখে অন্যটাকে যদি পাচার করা যায় ? তবে একটা বছর হেসে খেলে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে চলে যাবে দলুর,ও বলে,ঠিক আছে দু দিন থেকে যা--তারপর নিজের জাগা দেখে নিবি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝুমনি আপত্তি করে ছিল।
কিন্তু দলুর লাল চাহনির কাছে ঝুমনি কুপোকাত তা ভাল ভাবে সে জানে।
শেষে একদিন ঝুমনিকে বেচে দিল দলু। দশ
হাজার টাকায়। কোন শেঠ ব্যবসায়ী কিনে নিলো নিজের জন্যে অথবা আরও মুনাফার জন্যে। দলুর খুব একটা বাইরে বের হতে হয় না।
মন্দা ও দলু স্বামী স্ত্রীর মত থাকে। কিছু করার নেই--বেঁচে থাকতে হলে সমস্ত সতীপনা ধুয়ে মুছে
যায়--মন্দা তার ঝুপড়ি জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছে । কিন্তু সেটুকু
ভাগ্যও কি বিধাতা মন্দার জন্যে লিখেছেন !
আরও দশটা বছর কেটে গেল। দলু এর মধ্যে কয়েক বার জেলে গেছে। তারই মাঝে লড়খড়িয়ে উভয়ের একসাথের জীবন চলছিল। দলু অসুস্থ। ওর রোজগার পাতি নেই বললেই চলে। ঘর চলার মত অবস্থা নেই। সে দিন দলু খেতে বসে ছিল। থালায় অল্প ভাত,সঙ্গে এক হাতা ডাল।
আরও দশটা বছর কেটে গেল। দলু এর মধ্যে কয়েক বার জেলে গেছে। তারই মাঝে লড়খড়িয়ে উভয়ের একসাথের জীবন চলছিল। দলু অসুস্থ। ওর রোজগার পাতি নেই বললেই চলে। ঘর চলার মত অবস্থা নেই। সে দিন দলু খেতে বসে ছিল। থালায় অল্প ভাত,সঙ্গে এক হাতা ডাল।
আর কত সহ্য হয়--ভাতের থালা ছুঁড়ে
মারল সে মন্দার গায়ে,সঙ্গে মুখে খিস্তি খেউর চলল। আজকাল এমনি চলছিল,কথায় কথায় ভয়ঙ্কর রেগে যাচ্ছিল দলু,আজ সে আরও রাগে
জ্বলে উঠলো,ছুটে গিয়ে মন্দার গলা টিপে ধরল। আর সে চেপে ধরা
হাত যখন ছাড়ল--মন্দা তখন কোথায় ? মরে গেছে মন্দা। দলু দেখল
মন্দার প্রাণহীন শরীর ঘরের মেঝেতে ঢলে পড়েছে।
না,আর না,এখানে
আর থাকা চলবে না--দলু ঠিক করল এ ঝুপড়ি ছেড়ে যাবে--পালাবে। সে খুনি,সকালেই পুলিশ আসবে,ওকে ধরে নিয়ে যাবে। আর নির্ঘাত এবার
তার ফাঁসি হবে। তারপর অসুস্থ বয়োভার দলু তার ঝুপড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল।
তখন শেষ রাত হয়ে এসেছে,মন্দার জ্ঞান
ফিরছিল। কালো অন্ধকার চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। চোখ মেলল মন্দা। অন্ধকার
ঘর--মনে পড়ে
গেল কালো রাতের সব ঘটনা।
খিদে পেয়েছে খুব--বেঁচে থাকার কি
যে জালা--সবচে আগে নিজের শরীরকে পালন করা--তারপর শরীর ঢেকে রাখা--এত সব কেন--কেন--কেন ? অন্ধকার ঘরের
মেঝেতে তেমনি ভাবে চোখ বুজে পড়ে রইলো সে।
কিছু দিন চেনাজানা ঝুপড়ি ঘর থেকে দু
মুঠো খেতে পেয়ে ছিল--কত দিন কে কাকে খেতে দেয় ! এর পর থেকেই তাকে ভিক্ষা করতে শুরু করতে হল । দলু আর কোন দিন ফিরে আসে নি।
দেহের রূপ তো তার ঝরে গেছে--অভাব আর বয়সের ভারে তার আসল বয়স ঢাকা পড়ে গেছে। মন্দার আটচল্লিশ বছর বয়সে
তাকে ষাট বছর ছুঁই ছুঁই মনে হচ্ছিল।
--একটু ভিক্ষা দেও মা !
--কেন খেটে খেতে পার না গো--দেখলে তো অত অসমর্থ বলে মনে হয় না--ঘরের গিন্নী
মা মন্দার আঁচলে দু মুঠো চাল ঢেলে দিয়ে ছিল।
টলতে টলতে মন্দা হেঁটে চল ছিল। ভোঁতা
মনে স্মৃতিরা আর বেশী তাকে নাড়ায় না। যত দিন বেঁচে থাকা এমনি করে ধুঁকে ধুঁকে শরীরটাকে বয়ে নিয়ে হেঁটে
চলতে হবে তাকে...