গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

মৌ দাশগুপ্তা

প্রতীক্ষা

                                               ১

আম্মি..মাম মা .. আম্মি
ঘুমের ঘোর কেটে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসে লুসি,বাইরে অন্ধকার,মানে রাত। মেয়েটা কই? বিছানা হাতড়ে পায় না।পড়ে গেল নাকি খাট থেকে? পিন্টু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কি ঘুম রে বাবা, মেয়েটা ওদিকে ডেকে ডেকে সারা হয়ে গেল, বাপের বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই। কিন্তু মেয়েটাই বা চুপ কেন।
রুনি মা, ভয় পাস না, আমি আসছি, আসছি, সাড়া দিয়ে খাট থেকে নামতে যায় লুসি।
কোথায় যাচ্ছো? ওয়াশরুম? আমায় ডাকবে তো? ঘুমজড়ানো স্বরে পিন্টু বলে।
না না ওয়াশরুম না, উফফফফ শুনতে পাচ্ছোনা, রুনিটা ডাকছে তখন থেকে। কি বাবা তুমি, মেয়েটা কাঁদছে আর তুমি নাক ডাকাচ্ছো? কখন যে খাট থেকে নেমে গেল মেয়েটা! সরো, নামতে দাও।
খট শব্দ করে সাইডল্যাম্পটার স্যূইচ টিপে আলো জ্বালায় পিন্টু, স্থির চোখে লুসির দিকে তাকিয়ে বলে,
স্বপ্ন দেখছিলে লুসি। দ্যাখো, ঘরে কেউ নেই। শুধু তুমি আর আমি।শুয়ে পড়ো, কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাও তুমি, জোর করে জাগলে শরীর খারাপ হবে।সামনে অনেক লড়াই বাকি, সুস্থ থাকতে হবে।
আলো নিভে যায়। শুয়ে পড়ে লুসি। চোখ বন্ধ করতেই চার বছরের রুনির রক্তাক্ত মুখ, বিস্ফারিত দৃষ্টি,নরপশুতে খোবলানো কচি শরীর। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধ। তবু প্রতিরাতে মায়ের কাছে রুনি আসে,আসতে চায়, তাই ঘুমহীন চোখে একপলকের জন্য হলেও ঘুম আনতে রোজ রাতে কড়া ঘুমের ওষুধ খায় লুসি। স্বপ্ন ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না। তাই আবার পরের রাতের অপেক্ষায় থাকে, আরেকবার কচি গলায় সেই আম্মি..মাম মা .. আম্মিডাকটা শোনার অপেক্ষায়।

                                           ২

জন্মকালে মরে মা তার দুঃখ ঘোচে না।ঠাকুমা মাঝে মধ্যে নাতনকে বুকে জড়িয়ে কথাটা বললেও পুরো মানেটা ঋদ্ধি সত্যিই বোঝেনা। জন্ম নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখলেও মা নামের মানুষটিকে নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি ঋদ্ধির। মামানে কিছু ফটো, ক্যাসেটে রেকর্ড করা কথা, গান, আবৃত্তি,বাবা, ঠাকুমা, দিদুন, দাদুন ,বনিপিসি, টুকি মাসী,কি সমুদাদার মুখে শোনা ছোট ছোট গল্প।  তার চারপাশে তার সমবয়সী খেলুড়ে বা সহপাঠিনীরা যখন মায়ের কথা বলত, কেবল চুপটি করে শুনত। বাড়ী ফিরে ফিরে বাবা বা ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করতো,
আচ্ছা ,আমার সব বন্ধুদেরই তো মা আছে,তুমিও তো বাবার মা, তবে আমার মা কোথায়, ঠাম্মা..
ঠাকুমা তার ছোট্ট নাতনীকে কি উত্তর দেবেন বুঝতে না পেরে জলভরা চোখে বুকে টেনে নিয়ে মিথ্যে সান্ত্বনা দেন, -
 “তোমার মা তো অনেক দূরে থাকে...তুমি বড় হও, মন দিয়ে লেখাপড়া কর, মা তখন ফিরে আসবে...
কেন আমার মা দূরে থাকে ঠাম্মা?
খুব অসুখ করেছে কিনা,তাই।
কি অসুখ?
সে ভারী খটোমটো নাম, আমি কি তো ইংরিজি জানি নাকি যে বলতে পারবো? তুমি বড় হলেই জানতে পারবে।তাই তো বলছি মন দিয়ে পড়াশুনো করো। ইংরাজিটা শিখতে হবে না?
সত্যি বলছ আমি বড় হলেই মা চলে আসবে?
বল্লাম তো। চলো এখন আর কথা নয়। খাবে চল। তোমার জন্য আজ লুচি পায়েস বানিয়েছি।
খুশিতে ছোট্ট ঋদ্ধিরর চোখের তারা জ্বলে উঠে। বলে-
...ত্যি আসবে,...ত্যি... মা আসবে তো?
 চোখ মুছতে মুছতে রান্নঘরের দিকে যেতে যেতে কান্না লুকানো কণ্ঠে ঠাকুমা বলেন,
- হ্যাঁ গো দিদিভাই বলছি তো, মা আসবে...!

                                               ৩

রেশমীর মনটা আজ ভালো নেই।ধীরাজ আর নিজেকে নিয়ে বেশ মিষ্টি স্বপ্নটা দেখছিলো.আচমকা কালো একটা বিরাট গহ্বর ওকে নিচের দিকে টানতে শুরু করল রেশমী ভয়ে ছটফট করতে লাগলো আর প্রাণপণে ভয়ঙ্কর আকর্ষণ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল কিন্তু ক্রমেই আরো নিঃসীম কালোর মাঝে তলিয়ে যাচ্ছিল  আর  ঠিক তখনই অস্পষ্ট একটা ডাক স্পষ্টতর হতে লাগলো বিছানার চাদর খামচে ধরল "রেশমী উঠলি , মারব এক থাপ্পড় " মায়ের ধমকে রেশমী তড়িঘড়ি করে উঠে বসল ওর ঘোর এখনো কাটেনি ভেবেছিল স্বপ্নটাই সত্য , ওটাই বাস্তব ভূতগ্রস্থের মত বিছানায় বসে রইল ইদানিং রেশমীর দিনকাল তেমন ভালো যাচ্ছে না ভালো থাকবে কি করে , ওর স্বপ্নেরা ওকে ফাঁকি দিয়ে বোধহয় মেঘের আড়ালে পালিয়ে গেছে, যেমন ধীরাজ পালিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে। ধীরাজ ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে এখন মেতেছে সঞ্চারীকে নিয়ে, এমন ভাবটা দেখাচ্ছে যেন কোনদিন রেশমী নামের ষোল বছরের মেয়েটার নামই শোনেনি। অথচ এই কদিন আগে অবধি কি মিষ্টি মিষ্টি কথা।
তোমায় না পেলে আমি বাঁচব না রেশমী, তুমি আমার সব। প্লিজ একবার বলো তুমিও আমায় ভালোবাসো। বলো আজ দু মিনিটের জন্য হলেও আমবাগানে আসবে। আসবে তো? আমার দিব্বি রইলো।
সব ফাঁকি, মিষ্টি কথা, ছেলে ভুলানো প্রতিশ্রুতি,হাতে হাত রাখা শপথ,চুমু, উথালপাথাল আদর, সঅঅঅঅব, সব ফাঁকি, মিথ্যে, সাজানো নাটক আজকাল তাই সারাদিন সে একা একা ঘরের এক কোণে বসে থাকে আর কি যেন ভাবে রেশমীর মাও তেমন বকা দেন না ওকে , ওনার ধারণা বেশি ঝামেলা করলে নচ্ছার ছেলেটার সাথে পালিয়ে চলে যাবে নিতান্তই ভুল ধারণা ছেলেটা ওকে খালি ঠকাতেই পারে , ভালবাসতে পারে না   মা ঠিকই বলেছে , ছেলেটাই আসলে একটা নচ্ছার নইলে রেশমীর এত আবেগের ঢেউ উপেক্ষা করে কেউ এভাবে চলে যেতে পারে? রেশমী প্রথম প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেনি , ভেবেছে রাগ জমেছে মনে আস্তেই কুয়াশা কেটে যাবে কিন্তু ক্রমেই কুয়াশা গাঢ় হয়ে সবকিছু আচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল কত ঋতু বদল হল তবু ঘোলাটে ভাবটা থেকেই গেল ছেলেটার আর কি দোষ , রেশমীরই পোড়া কপালী,তবু প্রথমপ্রেমের না ফোটা স্বপ্ন বুকে বয়ে রেশমী অপেক্ষা করে হয়ত নতুন বসন্তের কিংবা বসন্তদূতের।

                                               ৪

রোজীকে প্রচণ্ড ভালোবাসে অ্যান্টনি আর ভালোবাসবেই না কেন? ছয় ছয়টা বছরের প্রেমপর্ব মিটিয়ে বিয়ে। শুধু ভালবেসেই ঘর পরিজন ছেড়ে, ধর্ম বদলে অ্যান্টনিকে বিয়ে করেছে রাজিয়া, এখন যার নাম রোজী। অ্যান্টনির মা ইসাবেলার একটাই দাবী ছিল মেয়ে যেন ভিনধর্মের না হয়। রোজী অ্যান্টনির দিকে চেয়ে ওর বাবামায়ের এই অন্যায় জেদটুকু অবধি মেনে নিয়েছে। এখন শ্বশুর শাশুড়ী তো বউকে পলকে হারায়। ছেলের বউ থেকে এই অল্প কদিনেই মেয়ের জায়গা নিয়ে ফেলেছে রোজী। এমন ফুলের মত বউকে ভালো না বেসে কি পারা যায়?মাঝে মাঝে অ্যান্টনির খুব গর্ব হয় রোজীর জন্য। ভালবাসা উছলে পড়ে। এমনিতেই ঘরছাড়া সৈনিকের জীবন। কদিনই বা ঘরে বসে বউকে আদর করর, বউয়র আদর পাবার সৌভাগ্য হয়? সেই মোবাইল আর মেল। মাঝে মধ্যে ঘরে ফিরলে বউয়ের চোখে চোখ রেখে আবেগি কণ্ঠে বলে
সুইটহার্ট। সত্যি আমি ভীষণ লাকি। নয়ত তোর মত বউ পাই। রিয়েলি আই লাভ ইউ। লাভ ইউ টু মাচ।
রোজী শুনে মিষ্টি হাসে। লজ্জা রাঙ্গা কণ্ঠে বলে
চুপ, আস্তে ,কি যে বলো না,মা শুনতে পাবে যে!
অ্যান্টনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সেনা। পোস্টিং বাংলার সীমান্ত ছাড়িয়ে উপদ্রুত আসামে। প্রতিবারই ডিউটিতে ফেরত যাবার সময় কান্নাকাটি করে একসা করে রোজী। বারবার মিনতি করে যেন অন্য কোন চাকরী নেয়। কিন্তু সামান্য বিকম পাশ ছেলের কাছে চাকরী পাওয়া অত সোজা নাকি? কে বোঝাবে ওর পাগলী বউটাকেআহত হরিণীর মতো স্বামীর গলা জড়িয়ে রোজী কান্নাভেজা গলায় বলে
তোমাকে ছেড়ে এতগুলো দিন কি ভাবে থাকবো বলে যাও...!
অ্যন্টনীরও কি আর ভালো লাগে তখন? নিরুপায় মুখে বউকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে
এভাবে কাঁদিস না রোজী,আমারই কি খুব ভালো লাগে নাকি তোকে ছেড়ে যেতে? মুখ তোল, শোন, আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। এই তো মাত্র হাতে গোনা কটা দিন। অপেক্ষা করিস, এবার এসেই গোয়া ট্রিপ, তারপর তোর কোলে একটা ছোট্ট অ্যন্টনি, তখন তো ভুলেই যাবি আমায়।

                                              ৫

বন্যা রহমান, পাঁচ পাঁচটা বছর যাপন করেছেন যৌথ একাকীত্বের জীবন। আত্মীয় বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই নানা ছুতোয় সরাসরি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছিল যে তার স্বামী আরেকটা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেননি।এক দুই নয়, টানা পনেরো বছরের বিবাহিত সংসার তার। এমন নয় যে, তারা একে অপরকে ভালোবাসেননি। এমন নয় যে তারা ঝগড়া করেননি। তাদের অনেক বিষয়েই মনোমালিন্য হয়েছে। কত অভিমান করেছেন স্বামীর ওপর। তার ভালোবাসার মানুষটিও তাকে নিরাশ করেননি- আদরে সোহাগে তার অভিমান ভাঙ্গিয়েছেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি শপথ করে বলতে পারেন, তাদের ঝগড়া, মনোমালিন্য, মতের অমিল ছিল খুব সামান্যই। সুতরাং বন্যা রহমানকে তার স্বামী সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বিশ্বাস করানো খুব মুস্কিল। তিনি স্বামীকে জিজ্ঞাসা করতেও যথেষ্ট লজ্জা পেয়েছেন। কি করে জিজ্ঞাসা করবেন তিনি। তাই গত পাঁচ বছরে সন্দেহের ঘুণপোকা মনের ভিতরটা কুড়ে কুড়ে খেয়ে রক্তাক্ত করে দিলেও একটা ছোট্ট প্রশ্ন তিনি করে উঠতে পারেননি। অথচ এই কটা বছর তিনি স্বামীর সাথে ছাদের নীচে কাটিয়েছেন একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। একেই বোধ হয় দুজন মিলে একা হয়ে যাওয়া বলে। তিনি বিশ্বাস করেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি তার একমাত্র সন্তান আজমিরার মুখ চেয়ে ভুলে থেকেছেন- তার স্বামীকে হারানোর যন্ত্রণা। তিনি তার চোখের সামনে একটু একটু করে বদলে যেতে দেখেছেন তার স্বামীকে। স্বামী তার কাজের অজুহাতে প্রায় রাতে বাড়িতে ফেরেন না। তবু বন্যা আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব ভুলে থাকতে চেয়েছেন, স্বামীর সঙ্গে শারিরীক মানসিক সব সম্পর্ক রেখেছেন, ভেবেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে সংসার সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে গেছেন আবু রহমান। ঘনঘন অফিসিয়ল ট্যুর আর দেশের বাড়ী যাবার অজুহাতে ঘরে ফেরত আসাটাও কমিয়ে দিয়েছেন দৃষ্টিকটুভাবে। ছোট্ট মেয়ে আজমিরা বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করলে গুটিয়ে গেছেন বন্যা, উত্তর দিতে পারননি আত্মীয় বন্ধুদের সহানুভূতি আর দয়ার্দ্রতায় ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেলেও তিনি অপেক্ষা করেছেন, স্বামী তার নিশ্চিত ফিরে আসবে।

খন্ড খন্ড চিত্র, খন্ডিত জীবনের চালচিত্র। একের সাথে অপরের কোন মিল নেই তবু এরা একে অপরের সাথে বিনি সুতোয় গাথা। ঘটনাগুলো ঘটার পর অনেকদিন পার হয়েছে। অনেকবার সুর্য উদিত অস্তমিত হয়েছে। ঋতু পরিবর্তন হয়েছে অনেকবার।

লুসি এখন টুনি মুনি দুই যমজ মেয়ের মা। পক্ষীমাতা সুলভ সাবধানতায় দুই মেয়েকে আগলে রাখে। কোথাও যাবার হলে একা ছাড়ে না। তবু রুনিকে ভুলতে পেরেছে কি? আজও প্রতিরাতে ঘুমের ওষুধ, প্রতিরাতে সেই মেয়ের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা।

ঋদ্ধি আজ অনেক বড় হয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে হয়েছে তার। স্বামী- সন্তান নিয়ে সুখী সংসার তার। নিজে মা হয়ে বোঝে মা হারার যন্ত্রণা। মারা যাওয়ার সম্যক অর্থটা বুঝেও অকলপ্রয়াতা মায়ের জন্য আজও অনন্ত প্রতীক্ষায় মেয়ে।

রেশমী এখন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রিন্সিপাল।খুব রাগী রাশভারী ইমেজ।চিরকুমারী রেশমী এখনও না পাওয়া প্রেমের , অদেখা এক স্বপ্নের রাজকুমারের জন্য প্রতীক্ষায় থাকে, হয়তবা আরেক ধীরাজের জন্য অপেক্ষা করে।

সময়ের চক্রে রোজীর যৌবন নদীতে আজ মরা গাঙের স্রোত। শ্বশুর  মারা গেছেন অনেকদিন। শাশুড়ী বয়সের ভারে শয্যাশায়ী। ছোট্ট অ্যান্টনির আসাও হয়ে ওঠে নি ভাগ্যের ফেরে। রুগ্ন শরীরে একটা সেলাইমেশিন সম্বল করে যুঝে যাচ্ছে বাঁচার লড়াই। অভাব তার নিত্যসঙ্গী। না, অ্যান্টনি আর ফিরে আসেনি যুদ্ধ থেকে।মৃত্যুর খবরটাই এসেছে।দেহটা অবধি শত্রুদেশ থেকে ফেরত আনা যায়নি। রোজী আর ওর অন্ধপ্রায় বৃদ্ধা শাশুড়ী, অ্যান্টনির মা ইসাবেলা আজও বিশ্বাস করে না যে অ্যান্টনি আর কোনদিন ফিরবে না। দরজায় আওয়াজ হলেই দুজনে ভাবে বুঝি সে এলো, আসবে বলে কথা দিয়েই তো বেরিয়েছিল সে।

বন্যার জীবনে রোজই রাতের পরে আরো একটা নিঃসঙ্গ ভোর আসে। সূর্যের আলো বন্যা রহমানের ঘরে ঢুকে আর ভালোবাসার কথা বলে না। ভোরের আলো কেবল ভাঙ্গনের গান শুনিয়ে যায়। সময়ের সাথে বন্যা একটু একটু করে বুঝেছেন, একটা সম্পর্ক ছিঁড়ে যাওয়া এত সহজ নয়। মানুষের ঘর তো শুধু ইট কাঠের চার দেওয়াল নয়- এই চার দেওয়ালের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার কত আনন্দ-বেদনা। সেই ঘর আগলে বুড়ো বয়সেও তাই অহেতুক স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় দিন গোনা। আজমিরাও বড় হয়েছে। কলেজের পাট চুকিয়ে এখন নিজেই কলেজে পড়ায়।সেও ভাবে কোন না কোনদিন আব্বু ফিরবেই ফিরবে। ভালোবাসার টান রক্তের টন এত সহজে ভোলা যায় নাকি। অতএব মায়ের সাথে আজমিরাও অপেক্ষার প্রহর গোনে।

এভাবেই লুসি,ঋদ্ধি রেশমী, রোজী , ইসাবেলা , আজমিরা কি বন্যা, এবং ওদের মত আরো অনেক মানুষ অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে তীর্থের কাকের মতো প্রিয়জনের প্রিয়মানুষটার অপেক্ষায় প্রহর কাটায়, আর প্রতীক্ষায় থাকে সারাজীবন। জীবন তবে কি? জীবন মানে যন্ত্রণা নাকি জীবন মানে কেবলই প্রতীক্ষা ...?