গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৯ মার্চ, ২০১৪

গৌতম সেন


মহৌষধি


আকাশ ভেবে মরে মাটির পৃথিবী কী চায়, বৃষ্টিকে পাঠায় দেখে যেতে মানুষের এই অপদার্থতা থামবে গিয়ে কোথায়। সরেজমিন তদন্ত সেরে বৃষ্টি বাস্প শকট চেপে আকাশে ফিরে যায়। শোনা যাক সে কী বলে!

মানুষ এক স্বেচ্ছা সংকট সৃষ্টি রে তার মাঝে অহেতুক এক টানাপোড়েনে বেঁচে আছে। তারা মনের রাগ, ঈর্ষা, মাৎসর্য্য একে অন্যের পরে উগরে দেয় কতক জ্বালাময়ী শব্দের প্রকাশেতাকে ওরা গালি বলে। মজা এই যে বহুক্ষেত্রে এরজন্য ওরা বেছে নিয়েছে কিছু পশুর নাম। কখনো তাদের নাম ধরে, কখনও বা তাদের শাবকের নাম নিয়ে একে অপরকে সম্বোধন করে। এক অদ্ভুত জ্বালানী, মানুষ তার হৃদয়ে জমিয়ে রেখেছেযার নাম অহংবোধ। বড় সহজ দাহ্য সে বস্তু, সামান্য আঘাতে জেগে ওঠে বহ্নি, সে অগ্নুৎপাতে লাভা হয়ে বেরিয়ে আসে যত হিংসা, অসহিষ্ণুতা। কত সহজে তারা বেছে নিয়েছে এই সহবতহীন সংকীর্ণ জীবন।

আরও একটা মজার তথ্য জানা গেল এই আকাশদুতের কাছেপশুরাও নাকি গালিগালাজের রীতি আয়ত্ব করে নিয়েছে। তারা রেগে গেলে গালি পাড়ে –“মানুষের বাচ্চা!” আকাশের পছন্দ হয়, বলে –‘যুক্তি আছে, গালি তাদের আরও তীব্র। আরও নিকৃষ্টতাকেই তুলে ধরে।
কি ভাগ্যিস পশু মানুষ একে অন্যের ভাষা বোঝে না!

বৃষ্টির বলা শেষ হয় না। মানব সমাজ এক দূরারোগ্য কর্কট ব্যাধিতে আক্রান্ত। ভোগবাদী লোভ, কামনা-বাসনা, দূর্নীতি এমন সব পুতিগন্ধময় দগদগে ঘা নিয়ে সবাই নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন মহামারীর চেহারা নিয়েছে যে মানব সংসারে আজ জনে জনে আক্রান্ত। সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেলেও এই দূর্গন্ধ সবার সয়ে গেছে। ধর্ষণ, বলাৎকার, রাজনীতির নামে প্রতিহিংসা- এরা আজ কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েডের জায়গা অধিগ্রহণ করেছে। ওষুধ কবে বার হবে তারও কোন আসু সম্ভাবনা চোখে পড়ে নি। তবে হ্যা মোমবাতি প্রচুর জ্বলছে, নীতি নির্ধারণ সভাগুলিতে এরাই আবার কড়া দাওয়াই এর কথা ভাবছে। নারীজাতি নাগাড়ে শিকার হচ্ছে ধর্ষণের- আর কারা এই নোংরা ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যাধ? তারা পুরুষ, যাদের উদ্দেশ্যে পশুরা সমস্বরে বোধহয় চীৎকার করে গালি দেয়- মানুষের বাচ্চা!

বৃষ্টির চোখে জল দেখা যায়। আকাশকে আরও চিন্তাগ্রস্ত মনে হয়। এরপর আকাশ বৃষ্টিকে বলে – “মানুষ না বড়াই করে শ্রেষ্ট জীব তারা! তুই আর চোখের জল পাত করে কি করবি? প্রাণীজগতে সবচেয়ে হিংস্র জন্তু এখন মানুষ, প্রয়োজনের অনেক বেশী তাদের চাহিদাক্ষুধা নিবারণের পরেও তাদের মধ্যে নিত্য নতুন অনন্ত অশালীন ক্ষুধা। দ্বিধাহীন লোভ তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, এক ভোগের হাতছানি তাদের স্পর্ধা বাড়িয়ে তুলছে দিনকে দিন সভ্যতা, সংযম, শালীনতা, সহমর্মিতা সব বিসর্জণ দিয়ে তারা আজ দূর্যোধন, দূঃশাসনের চেয়েও অনেক বেশী দূর্বিনীত। কেউ গুপ্তপথে অর্থ-সম্পদ আহরণে ব্যাস্ত, কেউ বিকৃত রুচির কুৎসিত কামনা চরিতার্থ করতে ব্যাস্ত। সভ্যতাকে গ্রাস করেছে সীমাহীন অসভ্যতা, শান্তিকে ঘিরে ফেলেছে অশান্তির অন্ধকার।

বৃষ্টিকে বাস্পরূদ্ধ কণ্ঠে বলতে শোনা গেল –“মানুষের আজ সবচেয়ে নগ্ন বিপদধর্ষণ। নারী আজ সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত, পথেঘাটে বলাৎকারের শিকার।আকাশের মুখ ঢেকে গেল দুশ্চিন্তার কালো মেঘে  সে বৃষ্টিকে বলে – “ আবার যেতে হবে তোকে। বিপন্ন ওই নারীজাতির কানে কানে মন্ত্র দিতে হবে। আত্মরক্ষার উপায় তাদের নিজেদের বেছে নিতে হবে মাঝাভাঙ্গা সমাজ বিচারের প্রহসন চালিয়ে যাবে, পাশাপাশি ঘৃণ্য অপরাধের অবাধ পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে মহা সমারোহে। ধর্ষিতা নারীর মৃত্যু তো একের পর এক ঘটেই চলেছে, তবে কেন ওরা মিছেমিছি শুধু একাই মৃত্যুবরণ করবে শয়তানের লোলুপ নির্যাতনে! চুপিচুপি বলে আসিস ওদের, দেহের মধ্যে লুকিয়ে রাখুক আধুনিক মারণ অস্ত্ররাসায়নিক বিষ্ফোরক। সাজিয়ে তুলুক নিজেকে মানব বোমার মোড়কে। বাকি টা ওদের বুঝতে কোনও অসুবিধা হবে না। বড়জোড় আর একটা কি দুটো আত্মদান ধ্বংস করে দেবে ধর্ষকামী লম্পটের অস্তিত্ব চিরতরে। ধর্ষিতার হাতে হবে ধর্ষকের তাৎক্ষণিক শাস্তি বিধান। 

খুব খুশি হল মনে মনে বৃষ্টি। সত্যি তো এত সহজ একটা সমাধান কেন ওদের মাথায় আসেনি ওদের দামিনীকে তো শেষমেষ কি করুণভাবে মরতে হয়েছিল, সেদিন যদি অস্ত্র থাকত ওর কাছে! ঠিকই তো আতঙ্কবাদী, মৌলবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী এমন নামে ভূষিত মানুষের দল তো কবে থেকেই ব্যবহার করছে অস্ত্র অন্য উদ্দেশ্যেআর এবার না হয় এক মহামারী দূষণের হাত থেকে মানব সমাজকে চিরতরে মুক্ত করতে ব্যবহৃত হবে এই অমোঘ অস্ত্র নিঃসন্দেহে এক মহান কৌশল। কারণ বৃষ্টি জানে মানুষ সবচেয়ে ভালবাসে নিজের প্রাণ আর একটা কাপুরুষও নিজের ধর্ষণ বিলাসকে চরিতার্থ করতে সাহস করবে না এত বড় প্রাণ সংকটকে উপেক্ষা করে!

বৃষ্টি আবার নামল এমন এক অমোঘাস্ত্রের হদিস বিপন্ন মেয়েগুলোর মগজে ঢুকিয়ে দিতে। এবার থেকে ওরা রাস্তা-ঘাটে নিরাপদ হবে। নারীকণ্ঠে সেই ঘোষণাটা হতে যতটুকু দেরী – “পৃথিবীর যত ধর্ষকামী কীট, সাবধানে এগিও। আমরা আগুন, আগুনে খেলার শখ দেখালে মৃত্যু অনিবার্য!”

এমন সুন্দর এক সম্ভাবনার স্বপ্নে মাতোয়ারা বৃষ্টি গাইতে গাইতে ধেয়ে নেমে এল মর্তধাম অভিমুখেব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুরিয়ে ফেলে আগুন জ্বালো...