নীল,দেওয়াল,আকাশ
নিস্তব্ধতার আঁধার ভেদ করে
তনিমা বলে ,
তুমিই বল পলাশ , কি চাও ? আমি
তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই ।
বুকের ভেতর তারসানাই মোচড় দেয় । দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া নিজেকে
খাটের একধারে গুটিয়ে নিতে থাকে পলাশ । কিন্তু গুটিয়ে নিলেই বা নিজেকে কোথায়
লুকোবে সে ?
চারপাশের সুদৃশ্য দেওয়ালে
পলেস্তারা খসে পরার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত । যে কোনেই আশ্রয় খোঁজে না কেন , সেখানেই দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ার আশংকা , রক্তাক্ত হবার সম্ভাবনা ।
রক্তাক্ত হতে আপত্তি নেই পলাশের , কিন্তু দেওয়ালে পলেস্তারা খসাতে ঘোর অনীহা তার । বড় মায়াবী এই
চারপাশ , বড় সযত্নে বাছা দেওয়ালের এই প্রিয় আকাশ নীল রং ।
শোবার ঘরের রং আকাশী নীল
করার প্রস্তাবে প্রবল আপত্তি জানায় তনিমা ।
- শোবার
ঘর বড় ব্যক্তিগত জায়গা , এ ঘরের রং একটু বেশি গভীর
হোক । একটু বেশি ঘন , নিবিড় ! একে অপরকে দেখতে
গেলে যেন খুব ,
খুব কাছে আসতে হয় ।
তনিমার আপত্তিকে পলাশ
যুক্তি দিয়ে বোঝায় ।
- ঘন রঙ
বড় বেশি রহস্যময় তন্নি । তার চেয়ে এস না একটা খোলা আকাশের নিচে বাঁচি । অনেকটা
আকাশের একফালি এই চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী করে নি ।
এই যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তনিমা , রহস্যময়তার চিরন্তন ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে । আর সেই
নীল রঙের দেওয়াল , টুকরো মেঘ , ঝিরঝিরে বৃষ্টি , লুকোনো
পাখি আর নিজস্ব নারী - এই সবই পলাশের অস্তিত্বের ফুসফুস । পালিয়ে যাবে , তবু এই দেয়ালের বিকৃতি সে হতে দেবে না ।
- তোমার
অসুবিধেটা বুঝতে পারছি । একদিকে আমি আর পাপান , অন্যদিকে
তোমার আগত সন্তান । অনেক খারাপ লাগার মধ্যেও আমার এটা ভেবে ভালো লাগছে যে তুমি
আমার মুখোমুখি হয়েছ । হয়ত এই কারণেই তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারতাম । কিন্তু অনেক
ভেবে দেখলাম সারাজীবন এটা মেনে নিয়ে চলতে পারব না । আসলে আমি দেবী নই পলাশ , স্রেফ রক্তমাংসের মানুষ ।
- বিশ্বাস
কর , আমি চাই না তোমার আর তনিমার মাঝে আসতে । এই খবরটা
তোমায় দিলাম স্রেফ তুমি এই সন্তানের পিতা বলে । ব্যাস , এর বেশি আর কিছু চাই না । তুমি স্বচ্ছন্দে ফিরে যাও
তোমার বউ ছেলের কাছে , আই উইল নেভার বদার ইউ ।
গঙ্গার ধারে আনমনা পলাশের
চুলে বিলি কাটতে কাটতে সেঁজুতি খুব প্রত্যয়ের সাথে কথাগুলো বলেছিল ।
- পাগলামি
কোরো না পলাশ ,
আমাদের মধ্যে যেটা হয়েছে সেটা
ভুলে যাও । টেক ইট এজ এন এক্সিডেন্ট । আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব । সিঙ্গল মাদারহুড
এখন আকছার হচ্ছে ।
এক্সিডেন্ট হিসেবেই নিত পলাশ । সেঁজুতির সাথে সম্ভোগের মুহুর্তগুলো
চোরা পাপের কুঠুরিতেই ভরে রাখত হয়তো , স্বচ্ছন্দেই
অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারত ঘর এবং বাইরের দ্বৈত স্বত্তার লুকোচুরিতে । কিন্তু যে
প্রানের বীজ সেঁজুতির শরীরে পুঁতে দিয়েছে অজান্তেই , তার কাছ থেকে সরে আসতে নারাজ সে ।
- নারীর
প্রথমে ভালবাসায় অধিকার । সে অধিকার থেকেই ধীরে ধীরে জন্মায় দায়িত্ববোধ । অথচ
দায়িত্ববোধের জন্য কি ভালবাসার প্রয়োজন হয় সারাজীবন ? কিন্তু পাপান এবং যে আসছে , তারা দুজনেই আমার কাছে সত্যি । এদের দুজনের মাঝে না
দাঁড়ালে আমি বড় ছোটো হয়ে যাব ।
কথাটা পলাশ প্রথমে বলেছিল সেঁজুতিকে , পরে তনিমাকেও । এটুকু দৃঢ়তাই দেখাতে পেরেছিল । বাকিটা
নিজের ভেতরে ভেঙ্গেচুরে খানখান ।
এখন তো স্রেফ ফলাফলের প্রত্যাশা । তনিমার কাছে সব স্বীকার করার পর
তিনদিন ধরে থমথমে পরিবেশ । কিছু যে একটা ঘটেছে , ছোট্ট পাপানও বুঝেছে হয়ত । বুঝেছে যে মা কোনো কারণে বাবার ওপর
রেগে আছে । তাই ভয়ে সে বাবার খুব একটা ধার ঘেঁসছে না । পলাশও অবশ্য ছেলের থেকে
খানিক দুরে দুরেই থাকছে ।
অবশেষে তিনদিন পরে গভীর রাতে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকা পলাশকে বিনা
ভূমিকায় বলে তনিমা ।
-
আমি তোমার সাথে থাকতে পারব না ।
উত্তরটা অপ্রত্যাশিত নয় , বিগত
কদিন এই কথাটা শোনার পর নিজের অভিব্যক্তি কি হতে পারে মাপার চেষ্টা করেছে মনে মনে
। আসল সময়ে হঠাত কেমন বুকের ভেতর চোরা ভয় , হুট
করে সামনে খাদ ,
শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায়
হিমস্রোত । তবে কি পরোয়ানা এসেই গেল ?
- আমি
সেপারেশন চাইছি , কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতের
দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে অবভিয়াসলি । আমি চাকরি করি না । অতএব স্রেফ এইজন্য সব
মেনে নিয়ে তোমার সাথে থাকতে হবে , এ
ভাবা ভুল । আমি সেপারেশন চাই , এবং
সেটা সম্পূর্ণ আমার শর্তে ।
খানিক চুপ থেকে পলাশ বলে , " সেপারেশন পেপার পাঠিয়ে দেব । আমি কালই ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ।
"
পাল্টা প্রস্তাব দেয় তনিমা , ইচ্ছে
করলে তুমি আমাদের অন্যত্র রেখে এখানে ওকে আনতে পারো ।
-
নাহ , তোমরা এখানেই থাকবে ।
- ডুপ্লিকেট
চাবিটা সঙ্গে রেখো । ছেলের সাথে দেখা করতে হলে আগে থেকে খবর দিও । আমি চলে যাব ।
নিশ্চুপ পলাশকে শেষ কথা বলে
তনিমা ।
এর পর কেটে গেছে তিন মাস ।
সেঁজুতির ঘরের দেয়ালের নিজের আবছা হয়ে ফুটে ওঠা প্রতিচ্ছবিতে
খানিক অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে । এরকমই এক দিন এলো তনিমার এস এম এস ।
- পাপানের
গত তিনদিন ধরে ধুম জ্বর পলাশ । আজকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব । তুমি কখন আসতে
পারবে ?
দ্বিধা নেই , অভিমানের
মোড়কে জড়তাও নেই সেই আহ্বানে । কোনো এক চোরা অধিকারবোধ বয়ে নিয়ে এলো যেন সেই
টুকরো এস এম এস ।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটল পলাশ । ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে ট্যাক্সিতে আসতে আসতেই ফোন করলো সেঁজুতিকে
, আজকে রাতটা আমি এখানেই থাকছি ।
ওপ্রান্তে খানিক নীরবতা , প্রানপনে
চাপতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাসের ছোট্ট টুকরোটা পলাশের কান এড়ালো না ।
-
ঠিক আছে ।
আজকাল নেটয়ার্ক-এর ভীষণ
গন্ডগোল । হুটহাট করে ফোন কেটে যায় বড্ড ।
রাতে পাপনের জ্বর অনেকটা
কমেছে ।
-
তুমি চলে যেতে পার , তেমন দরকার হলে ফোন করে নেব ।
খানিক দ্বিধাজড়িত স্বরে
পলাশ বলে ,
নাহ ! থাকি ।
-
তোমার ঘর তুমি থাকতেই পারো , কিন্তু আমি আজকে ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না । তাই
বললাম ।
খোঁচাটার কোনো উত্তর না
দিয়ে পলাশ একমনে পেপার পড়তে লাগে ।
পাপানকে রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বহুদিন পর ডাইনিং
টেবিলের সেই অভ্যস্ত কোন । অভ্যস্ত কোনায় তনিমা , পরিচিত ক্যাসারলের ঢাকনা খুলে রুটি , বাঁ হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাস , আর
বহুদিন পর সেই টুকরো টুকরো কথা ।
সেঁজুতি ভালো আছে ? পাপন হবার সময় যে ডাক্তার দেখাতাম , তাকেই দেখাচ্ছ কি ?
তনিমার কথাবার্তায় যেন
অস্বাভাবিকতার স্বাভাবিকতা ।
রাতে খানিক চোখ জুড়িয়ে এসেছে, হঠাত
পাশে সেই বহু পরিচিত ঘ্রাণে ঘুম ভেঙ্গে যায় পলাশের ।
- খুব
দেখতে ইচ্ছে করলো ঘুমলে তোমায় এখনো আগের মত লাগে কিনা ।
তনিমার গলায় নিয়ম ভাঙ্গার
ইঙ্গিত ?
-
খুব তোমার গায়ের গন্ধ পেতে ইচ্ছে
করলো । তাই তোমার পাশে এসে শুলাম । প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড ।
পলাশ কি একটু সাহসী হবে ? নিয়ম ভাঙ্গার অবশিষ্ট সিঁড়িগুলো কি তবে সেইই ভাঙবে ?
কাছে টেনে নেয় তনিমাকে । তনিমার আগ্রাসী ঠোঁট টেনে নেয় পলাশের
চুম্বন । বহুদিনের অভ্যাসে বিরতির পর ফের ভাঙ্গে অনভ্যাসের জড়তা । মুহুর্তে পলাশ
নগ্ন করে তনিমাকে ।
আহ ! তনিমা তৃষ্ণার্ত । শরীর বেঁধে রেখেছে তার অনুপস্থিতিতেও । এই
তো পলাশ দেখতে পাচ্ছে স্তনে তারই দেওয়া কামড়ের দাগ এখনও মিলিয়ে যায় নি । সারা
শরীরে আতিপাতি খুঁজেও পাচ্ছে না কোনো অন্য উপস্থিতি । তনিমার ঘামে , ইষৎ ঝাঁঝালো শ্বাসে ,শীতকারে ,পিচ্ছিল পথে - সর্বত্রই
পলাশ খুঁজে পাচ্ছে নিজের ফেলে যাওয়া উপস্থিতি । ঠিক যেমন ফেলে গিয়েছিল , ঠিক তেমনি আছে ।
টদীর্ঘ রমনের পর বহুদিনের অভ্যাসমত উপুর হয়ে শুয়ে আছে তনিমা ।
জানলার ফাঁক দিয়ে চোরা উঁকি মারার জন্য কাড়াকাড়ি করে নিয়ন আর চাঁদের আলো ।
পলাশ একটু কাছে ঘেঁসে এলো
তনিমার ।
-
আই এম সরি তন্নি ।
নিশ্চুপ তনিমা । খানিক পরে
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে । বিছানার এপাশ ওপাশ থেকে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা
রাত্রিবাসের বিভিন্ন খন্ড তুলে নিতে নিতে বলল ।
চ- ইটস ওকে পলাশ । আই এম ফাইন
! আসলে কি বল তো ? গেটিং এ জিগলো
ফ্রিকুয়েন্টলি ইজ ভেরি কস্টলি । এখানে তো আনা যাবে না । পাপন থাকে । সো হোটেল বুক
করা , দালালকে টাকা দেওয়া ........ ইয়ু নো দেয়ার ইজ লট অফ
কস্ট ইনভলভড ইন এন আওয়ার অফ প্লেজার । আই লাইকড ইট ।
হঠাত পলাশ আবিষ্কার করে , তার
দেওয়ালের একটুকরো আকাশের শুন্যতা যেন তাকে গিলতে আসছে । ওঘরে শুনতে পাচ্ছে তনিমার
গলা , এই তো বাবা । আমি তো তোমার পাশেই আছি । কোত্থাও যাই নি
। তুমি ঘুমোও ।