অতীত
আমার স্মৃতির সায়েরি
সম্পর্ক হয়েছে
কালি
রং
হারিয়েছি
পৃথিবী
থেকে ,
জীবনটা মরু
বালি
,
চাঁদনীতে আজ
জ্বলছি
আমি ,
হয়েছি
চোখের
বালি
।
ব্যথিত হৃদয়ে
গাইছি
আমি
নেই
কোন ক্ষোভ চলেছি আমি
স্মৃতি তে
সাজান
ফুলের
কবিতা ,
হারিয়েছি আজ
মায়ের
মমতা
।
এই কবিতাটা এক রিক্সাওয়ালার
লেখা । নাম কৈলাস চন্দ্র পাত্র । বাডি
যাজপুর জেলার কোরেই থানা অন্তর্গত রগডিতে । আমি সেই কৈলাস পাত্র শুনবেন আমার কথা ?
হ্যাঁ শুনতেই হবে কারণ আমি স্কুলে পডার
সুযোগ পাইনি । এক অস্পৃশ্য পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা আমার মহাপাপ । তাই আমাকে জীবন যুধ্যে অবতীর্ণ হতে হয় ছোটবেলা
থেকে । বাবা মারা জান এক অজানা ব্যাধিতে । ডাক্তার খানাতে ভর্তি করার পরের দিন
মারা জান ।ঘরে দু ভাই এক বোন আর আমি । মায়ের মাথায় বাজ পডে কারন বাবার সঞ্চয় বলতে
কিছু ই ছিলনা । দিন আনতেন দিন খেতেন।
রাজমিস্ত্রি র কাজ করতেন আমার বাবা । বাবা মারা যাওয়ার পর মা কিছু সরকারি বাবুদের
বাডিতে বাসুন মাজা কাপোড কাচা ইত্যাদি কাজ করতেন । সরকারি বাবু বলতে ব্লকের বি ডি
ও , জি
পি ও , এস ই
ও । ওই তিন চার ঘরে কাজ করে যা পেতেন তাতেই বোনের বিয়ে দেন ১৪ বছর বয়েসে । হ্যাঁ
জানি ওটা আইন বহির্ভূত কিন্তু কি করবেন এক
অসহায় বিধবা নারী । শেয়াল কুকুরের তো অভাব নেই দুনিয়াতে । হায়নার মত ছিঁডে খেত
যে নাহলে আমার বোনকে । সেটা কি ভাল হত ?
তাই আইনের কথা মাথায় না রেখে আমরা ছোট
বোনকে তুলে দিলাম ১০ বছরের বড বর পাত্রর হাতে। আমাদের জাতিতে ভালো বর পাত্র পাওয়া
প্রায় অসম্ভব ।
আমার বোনের বিয়ে হয় এক
পানের দোকানির সঙ্গে । ১০ হাজার টাকা পণ দিয়ে । সঙ্গে টিভি,
খাট সোনার গয়না । যা আমার মা’র ছিল সব দিয়ে দিতে বলেছি আমি । মা’ র সখ ছিল বড বৌ কে সোনার চুডি দিয়ে মুখ দেখবেন । হা আমার পোডা কপাল রে
মায়ের বৌয়ের শখ দেখলে আমার হাঁসি পায় ।
আমি
গ্রামের
স্কুলেতে
পডতাম
ক্লাস
সেভেন
এ । ব্যাশ চুকে
গেল পডা ; বাবা মারা যাওয়ার পর
! মায়ের
একার
পক্ষে
এতোগুল
মুখে
আহার
জোগান
সম্ভব
হলনা
। আমাকে কাজে নামতে
হল । আমি যাজপুরের এক
হোটেলে
কাজ করতে যেতাম ।
সকাল
৭ টায় বেরিয়ে ফিরতাম রাত
১০ টার পর ।
সারাদিন
হাড ভাঙ্গা খাটুনির পর
পেটে
পেতাম
দুট দানা । ডাল
ভাত আর কিছু উচ্ছিষ্ট তরকারি। সপ্তাহে ৭০
টাকা
।মানে
মাসে
২৮০ টাকা ।
কি
বলছেন ? লেবার অফিসার ধরেনা
কেন হোটেলের মালিক কে
?
কি
হবে ? গুঁজে দেবে একটা
১০০ টাকার নোট আর
এক প্লেট ভালো খাসীর
মাংস
সঙ্গে
বাসমতী
চালের
ভাত । যাওয়ার সময়
একটা
ছোট বোতল । কেল্লা ফতে
! কোন ব্যাটা কমপ্লেন করবে?
কার ঘাডে দুটো মাথা
?
মা
, বি ডি ও সাহেবকে অনেক
বলেছিলেন
আমাকে
একটা
চাকরী
দেওয়ার
জন্য
।
হেঁসে
খুন বি ডি ওর
স্ত্রী
। বলেছিলেন মহিলা,
“কি বলছিস চাকরী”
! তুই কি দিবা স্বপ্ন দেখছিস কৈলাসের মা
? ও সব চাকরী ফাকরী
তোদের
জন্য
নয়রে
। তোরা না থাকলে
আমাদের
ঘরে কে কাজ করবে
বলতো ? ছেলেকে বল রিক্সা চালাতে ।
বুঝলি
।
মা
চোখ মুছে ফিরে আসেন
। আমায় কিছু বলেন
না ।
আমাদের পরিবারে টানা
টানি
পডে কারন বোনের বিয়ে
তে মহাজনের কাছ থেকে
সুধে
টাকা
ধার নিয়ে ছিলাম আমরা মা’
ব্যাটা
। প্রত্যেক মাসে ৩০০
টাকা
সুধ বাবদ দিয়ে হাতে
যা থাকতো নাম মাত্র
টাকা।
একদিন
হোটেলের
কাজ করতে করতে আমার
খুব খিদে পায় ।
আমি থাকতে না পেরে
একটা
প্লেটে
ভাত আর ডাল নিয়ে
খেতে
সুরু
করি । সে দিন
আমাদের
ওখানে
পার্টির
মিটিং
ছিল।
অনেক
বক্তা
এসেছিলেন
। খুব গরমা গরম
বক্তৃতা
চলছিল।
হবু এম এল এ
অমূল্য
বাবু
মাইকে বলেন
আমাদের রাজ্যতে কেউ
খালি
পেটে
শোবে
না । বি পি
এল কার্ড ধারিদের ১টাকা
কিলো
চাল মাসে ২৫ কিলো
দেওয়া
হবে । মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য
সাইকেল
দেওয়া
হবে । গর্ভবতী মহিলাদের জননী
সুরক্ষা
যোজনায়
৫০০ টাকা পাবে । পরে আবার
পুষ্টিকর
খাদ্যর
জন্য
টাকা
দেওয়া
হবে।
আপনারা
এসবের
সুযোগ
নিন আর আমাদের চিহ্নে ভোট
দিন জাতে আমরা আপনাদের আরও
সেবা
করতে
পারি
৫ বছর। হাথ তালিতে কান ফেটে জায় ।
আমি
সব শুনছিলাম হঠাৎ পিঠে
এক কিল আর লাথি
চড এর বর্ষণ আরম্ভ
হল । কিছু বলার
আগেই
মালিক
চিৎকার
শুরু
করলেন , শালা নিমক হারাম
। বেরিয়ে যা ।
এখুনি
বের ।
আমি
অনুনয়
করে বলি, মালিক সকাল
থেকে
কাজ করছি । পেটে
দানা
নেই । খিধে পেয়েছিল ।
আমার
মাইনে
থেকে
কেটে
নেবেন
।
তুই
বের এখুনি । অনেক
কাজের
লোক পাবো ।
অগত্যা মিটিংয়ে চলে যাই । সেখানে আমাদের সরপঞ্চ ছিলেন
। ওনাকে বলি সব
কথা । উনি বলেন
মিটিং
শেষ হলে শুনবো তোর
কথা । তোকে না
বলেছিলাম
আজ এখানে থাকতে ।
এখানেই
ত খেতে পেতিস সঙ্গে
২৫ টাকা । তোরা
পার্টির
কথা না বুঝলে আমরা
কি করি বল তোদের
জন্য ! বিপদে পডলে তোরা
আসিস
অন্য
সময় টিকি দেখা যায়
না। আমি
বলে রাখি ওই হোটেল
থেকে
এসে আমি প্রতিদিন রাতে লন্ঠনের আলোতে
বই পড়তাম । কবিতা
লিখতাম ।
আমার
কবিতা
লেখার
প্রবণতা
জীবনের
সব জ্বলন্ত ঘটনা নিয়ে
। তাতে অবসাদ
, দুঃখ , বেদনা ভরা কিছু
কাহিনী
যা জীবনের সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্ত কে
লিপি
বধ্য
করা । কিছু মুখোস
ধারি
রাজনৈতিক
ব্যক্তি
র আসল রূপের কথা।তাদের আসল
রুপটা
তুলে
ধরতে
। আমার লেখা
কবিতা
ক্রমশ
উডিশ্যার
বিখ্যাত
খবরের
কাগজ ‘সমাজে’ প্রকাশ পায়
। রবিবাসরীয় তে । আমার
আনন্দের
সীমা থাকেনা সেদিন। মা’কে বলি , মা আমার
লেখা বেরিয়েছে সমাজে । তিন টাকা দিয়ে আমি প্রতি রবিবারের ‘সমাজ’ কাগজ কিনি । মা বলেন লেখা নিয়ে কি হবে পেটের
ভাত জুটবে তোর ? একটা রিক্সা কেন । বী ডি
ও বলেছেন লোন করিয়ে দেবেন । উদ্যেশ্য টা মোটেই মহৎ নয় । বি ডি ওর মেয়েকে কলেজে
নিয়ে জেতে হবে নিয়ে আস্তে হবে বিনে পয়সায় ।
লোন
শোধ না হওয়া অভধি । তবুও রাজি হলাম কারণ নিজের স্বাধিন রোজগারে চলবো । কেউ লাথি
মারার লোক থাকবেনা। আমি বি পি এল কার্ডের
জন্য সরপঞ্চ কে বলি । উনি বলেন তোর মা ,
বি ডি ও র বাডিতে কাজ করে এটুকু করাতে পারে না ! আমায় বলছিস কেন ? অগত্যা
মা কে বলি । মা বহু কষ্টে কার্ড পেয়ে জান । এবার আমাদের দুঃখ ঘুঁচবে বোধ হয় ।
ভগবান কে আমি বিশ্বাস করি না যেদিন আমার
বাবা মারা যান বিনা চিকিৎসাতে । কিন্তু আমার মা করেন । তাই বোধ হয় একটু সদয় হলেন
ভগবান ।
কিন্তু আমার মা’ ? তাকেও তো
হারাতে হল এক অশুভ দিনে । মাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তার খানায় । ডাক্তার বললেন তোমার
মায়ের ক্যানসার হয়েছে । পেটেতে । আমার মাথায় বজ্রাঘাৎ হল যেন। মা বললেন কিছু হবে
না আমি ঠিক হয়ে জাবো । কটকে নিয়ে গেলাম ক্যানসার হাঁসপাতালে । আমাদের এম এল এ
মহাশয় একটা বেড ঠিক করে দিলেন । আমি
‘সমাজে’ আমার মার জন্য আবেদন করেছিলাম কিছু সাহাজ্যের জন্য । সেই সুবাদে হয়তো বেড
টা পেলাম । কিন্তু মা’কে বাঁচাতে পারলাম
না ।
আরম্ভ হল আমার জীবন যুদ্ধ ।
আমি একা । আমার বোন ছোট ভাই কে নিয়ে রাখে তার কাছে।
আমি লিখতে লাগলাম একটার পর
একটা কবিতা । আমাকে কবিতা পাঠ উৎসবে ডাকা হল। আমার কবিতা পডে শোনালাম । হাততালি পেলাম আর কিছু বাহবা । মঞ্চে ঘোষণা হল “রিক্সা
বালা কৈলাস চন্দ্র পাত্র” র লেখা কবিতা । মন্ত্র
মুগধ হয়ে শুনছিল সবাই
। সেটাই আমার প্রেরণা । সেটাই আমার
পুরস্কার । আমি রিক্সা চালিয়ে কম পডাশুন করে যদি আমার লেখা কে পৌঁছে দিতে পারি
লোকেদের কাছে সেটাই আমার সব পাওয়া । একদিন
শুনলাম আমার সেই হোটেল বালা যার কাছে আমি কাজ করতাম সে মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে
। দুঃখ হল আবার মনে হল বোধ হয় ভগবান আছেন
। এখন আমি স্বাধীন এক রিকশাওয়ালা যার
দুখের সাথি একটা রেডিও আর কাগজ কলম । মা
সরস্বতী বিদ্যে বুদ্ধি যা দিয়েছেন তাই দিয়ে লডতে হবে অন্যায়ের বিরুধ্যে । আমার তো কোন বাঁধন নেই । আমি একা আর আমার কলম
সাথী ।