গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

ত্রিভুবনজিৎ মুখোপাধ্যায়

সখের কবি রিকশাওয়ালা

অতীত আমার  স্মৃতির সায়েরি  
সম্পর্ক হয়েছে কালি
রং হারিয়েছি পৃথিবী থেকে
জীবনটা মরু বালি ,
চাঁদনীতে আজ জ্বলছি আমি ,
হয়েছি চোখের বালি
ব্যথিত হৃদয়ে গাইছি আমি
নেই কোন ক্ষোভ চলেছি আমি
স্মৃতি তে সাজান ফুলের কবিতা
হারিয়েছি আজ মায়ের মমতা

এই কবিতাটা এক রিক্সাওয়ালার লেখা ।  নাম কৈলাস চন্দ্র পাত্র । বাডি যাজপুর জেলার কোরেই থানা অন্তর্গত রগডিতে । আমি সেই কৈলাস পাত্র শুনবেন আমার কথা ? হ্যাঁ শুনতেই হবে কারণ আমি স্কুলে পডার সুযোগ পাইনি । এক অস্পৃশ্য পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা আমার মহাপাপ ।  তাই আমাকে জীবন যুধ্যে অবতীর্ণ হতে হয় ছোটবেলা থেকে । বাবা মারা জান এক অজানা ব্যাধিতে । ডাক্তার খানাতে ভর্তি করার পরের দিন মারা জান ।ঘরে দু ভাই এক বোন আর আমি । মায়ের মাথায় বাজ পডে কারন বাবার সঞ্চয় বলতে কিছু ই  ছিলনা । দিন আনতেন দিন খেতেন। রাজমিস্ত্রি র কাজ করতেন আমার বাবা । বাবা মারা যাওয়ার পর মা কিছু সরকারি বাবুদের বাডিতে বাসুন মাজা কাপোড কাচা ইত্যাদি কাজ করতেন । সরকারি বাবু বলতে ব্লকের বি ডি ও , জি পি ও , এস ই ও । ওই তিন চার ঘরে কাজ করে যা পেতেন তাতেই বোনের বিয়ে দেন ১৪ বছর বয়েসে । হ্যাঁ জানি ওটা আইন বহির্ভূত  কিন্তু কি করবেন এক অসহায় বিধবা নারী । শেয়াল কুকুরের তো অভাব নেই দুনিয়াতে । হায়নার মত ছিঁডে খেত যে  নাহলে আমার বোনকে  । সেটা কি ভাল হত ? তাই আইনের কথা মাথায় না রেখে আমরা ছোট বোনকে তুলে দিলাম ১০ বছরের বড বর পাত্রর হাতে। আমাদের জাতিতে ভালো বর পাত্র পাওয়া প্রায় অসম্ভব ।

আমার বোনের বিয়ে হয় এক পানের দোকানির সঙ্গে । ১০ হাজার টাকা পণ দিয়ে । সঙ্গে টিভি, খাট সোনার গয়না । যা আমার মার ছিল সব দিয়ে দিতে বলেছি আমি । মার সখ ছিল বড বৌ কে সোনার চুডি দিয়ে মুখ দেখবেন । হা আমার পোডা কপাল রে মায়ের বৌয়ের শখ দেখলে আমার হাঁসি পায় ।  

আমি গ্রামের স্কুলেতে পডতাম ক্লাস সেভেন ব্যাশ চুকে গেল পডা ;  বাবা মারা যাওয়ার পর ! মায়ের একার পক্ষে এতোগুল মুখে আহার জোগান সম্ভব হলনা আমাকে কাজে নামতে হল আমি যাজপুরের এক হোটেলে কাজ করতে যেতাম সকাল টায় বেরিয়ে ফিরতাম রাত ১০ টার পর সারাদিন হাড ভাঙ্গা খাটুনির পর পেটে পেতাম দুট দানা ডাল ভাত আর কিছু উচ্ছিষ্ট তরকারি। সপ্তাহে ৭০ টাকা ।মানে মাসে ২৮০ টাকা
কি বলছেন ? লেবার অফিসার ধরেনা কেন হোটেলের মালিক কে ?
কি হবে ? গুঁজে দেবে একটা ১০০ টাকার নোট আর এক প্লেট ভালো খাসীর মাংস সঙ্গে বাসমতী চালের ভাত যাওয়ার সময় একটা ছোট বোতল কেল্লা ফতে ! কোন ব্যাটা কমপ্লেন করবে? কার ঘাডে দুটো মাথা ?
মা , বি ডি সাহেবকে অনেক বলেছিলেন আমাকে একটা চাকরী দেওয়ার জন্য
হেঁসে খুন বি ডি ওর স্ত্রী বলেছিলেন মহিলা, “কি বলছিস চাকরী” ! তুই কি দিবা স্বপ্ন দেখছিস কৈলাসের মা ? সব চাকরী ফাকরী তোদের জন্য নয়রে তোরা না থাকলে আমাদের ঘরে কে কাজ করবে বলতো ? ছেলেকে বল রিক্সা চালাতে বুঝলি
মা চোখ মুছে ফিরে আসেন আমায় কিছু বলেন না

আমাদের পরিবারে টানা টানি পডে কারন বোনের বিয়ে তে মহাজনের কাছ থেকে সুধে টাকা ধার নিয়ে ছিলাম আমরা  মাব্যাটা প্রত্যেক মাসে ৩০০ টাকা সুধ বাবদ দিয়ে হাতে যা থাকতো নাম মাত্র টাকা। 
একদিন হোটেলের কাজ করতে করতে আমার খুব খিদে পায় আমি থাকতে না পেরে একটা প্লেটে ভাত আর ডাল নিয়ে খেতে সুরু করি সে দিন আমাদের ওখানে পার্টির মিটিং ছিল। অনেক বক্তা এসেছিলেন খুব গরমা গরম বক্তৃতা চলছিল। হবু এম এল অমূল্য বাবু মাইকে  বলেন  আমাদের রাজ্যতে কেউ খালি পেটে শোবে না বি পি এল কার্ড ধারিদের ১টাকা কিলো চাল মাসে ২৫ কিলো দেওয়া হবে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল দেওয়া হবে গর্ভবতী মহিলাদের জননী সুরক্ষা যোজনায় ৫০০ টাকা পাবে ।  পরে আবার পুষ্টিকর খাদ্যর জন্য টাকা দেওয়া হবে। আপনারা এসবের সুযোগ নিন আর আমাদের চিহ্নে ভোট দিন জাতে আমরা আপনাদের আরও সেবা করতে পারি বছর। হাথ তালিতে কান ফেটে জায় ।
আমি সব শুনছিলাম হঠাৎ পিঠে এক কিল আর লাথি চড এর বর্ষণ আরম্ভ হল কিছু বলার আগেই মালিক চিৎকার শুরু করলেন , শালা নিমক হারাম বেরিয়ে যা এখুনি বের
আমি অনুনয় করে বলি, মালিক সকাল থেকে কাজ করছি পেটে দানা নেই খিধে পেয়েছিল আমার মাইনে থেকে কেটে নেবেন
তুই বের এখুনি অনেক কাজের লোক পাবো

অগত্যা মিটিংয়ে চলে যা সেখানে আমাদের সরপঞ্চ ছিলেন ওনাকে বলি সব কথা উনি বলেন মিটিং শেষ হলে শুনবো তোর কথা তোকে না বলেছিলাম আজ এখানে থাকতে এখানেই খেতে পেতিস সঙ্গে ২৫ টাকা তোরা পার্টির কথা না বুঝলে আমরা কি করি বল তোদের জন্য ! বিপদে পডলে তোরা আসিস অন্য সময় টিকি দেখা যায় না। আমি বলে রাখি ওই হোটেল থেকে এসে আমি প্রতিদিন  রাতে লন্ঠনের আলোতে বই পড়তাম কবিতা  লিখতাম আমার কবিতা লেখার প্রবণতা জীবনের সব জ্বলন্ত ঘটনা নিয়ে তাতে অবসাদ , দুঃখ , বেদনা ভরা কিছু কাহিনী যা জীবনের সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্ত কে লিপি বধ্য করা কিছু মুখোস ধারি রাজনৈতিক ব্যক্তি আসল রূপের কথা।তাদের আসল রুপটা তুলে ধরতে  আমার লেখা কবিতা ক্রমশ উডিশ্যার বিখ্যাত খবরের কাগজসমাজেপ্রকাশ পায় রবিবাসরীয় তে আমার আনন্দের সীমা থাকেনা সেদিন। মা’কে বলি , মা আমার লেখা বেরিয়েছে সমাজে । তিন টাকা দিয়ে আমি প্রতি রবিবারের ‘সমাজ’  কাগজ কিনি । মা বলেন লেখা নিয়ে কি হবে পেটের ভাত জুটবে তোর ? একটা  রিক্সা কেন । বী ডি ও বলেছেন লোন করিয়ে দেবেন । উদ্যেশ্য টা মোটেই মহৎ নয় । বি ডি ওর মেয়েকে কলেজে নিয়ে জেতে হবে নিয়ে আস্তে হবে  বিনে পয়সায় ।   লোন শোধ না হওয়া অভধি । তবুও রাজি হলাম কারণ নিজের স্বাধিন রোজগারে চলবো । কেউ লাথি মারার লোক থাকবেনা। আমি বি পি এল  কার্ডের  জন্য সরপঞ্চ কে বলি । উনি বলেন তোর মা ,  বি ডি ও র বাডিতে কাজ করে এটুকু করাতে পারে না ! আমায় বলছিস কেন ? অগত্যা মা কে বলি । মা বহু কষ্টে কার্ড পেয়ে জান । এবার আমাদের দুঃখ ঘুঁচবে বোধ হয় । ভগবান কে আমি বিশ্বাস  করি না যেদিন আমার বাবা মারা যান বিনা চিকিৎসাতে । কিন্তু আমার মা করেন । তাই বোধ হয় একটু সদয় হলেন ভগবান ।

কিন্তু আমার মা’ ? তাকেও তো হারাতে হল এক অশুভ দিনে । মাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তার খানায় । ডাক্তার বললেন তোমার মায়ের ক্যানসার হয়েছে । পেটেতে । আমার মাথায় বজ্রাঘাৎ হল যেন। মা বললেন কিছু হবে না আমি ঠিক হয়ে জাবো । কটকে নিয়ে গেলাম ক্যানসার হাঁসপাতালে । আমাদের এম এল এ মহাশয় একটা বেড ঠিক করে দিলেন ।  আমি ‘সমাজে’ আমার মার জন্য আবেদন করেছিলাম কিছু সাহাজ্যের জন্য । সেই সুবাদে হয়তো বেড টা পেলাম । কিন্তু মা’কে  বাঁচাতে পারলাম না ।

আরম্ভ হল আমার জীবন যুদ্ধ । আমি একা । আমার বোন ছোট ভাই কে নিয়ে রাখে তার কাছে।
আমি লিখতে লাগলাম একটার পর একটা কবিতা । আমাকে কবিতা পাঠ উৎসবে ডাকা হল। আমার কবিতা পডে শোনালাম ।  হাততালি পেলাম আর কিছু বাহবা । মঞ্চে ঘোষণা হল “রিক্সা বালা কৈলাস চন্দ্র পাত্র” র লেখা কবিতা ।  মন্ত্র মুগধ হয়ে শুনছিল সবাই ।  সেটাই আমার প্রেরণা । সেটাই আমার পুরস্কার । আমি রিক্সা চালিয়ে কম পডাশুন করে যদি আমার লেখা কে পৌঁছে দিতে পারি লোকেদের কাছে সেটাই আমার সব পাওয়া  । একদিন শুনলাম আমার সেই হোটেল বালা যার কাছে আমি কাজ করতাম সে মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে । দুঃখ হল আবার মনে হল  বোধ হয় ভগবান আছেন ।  এখন আমি স্বাধীন এক রিকশাওয়ালা যার দুখের সাথি একটা  রেডিও আর কাগজ কলম । মা সরস্বতী বিদ্যে বুদ্ধি যা দিয়েছেন তাই দিয়ে লডতে হবে অন্যায়ের বিরুধ্যে ।  আমার তো কোন বাঁধন নেই । আমি একা আর আমার কলম সাথী ।