গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

বিনু মাহবুবা

জীবন

সেদিন কি বার ছিলো ? কি বার ছিলো...
জানালা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে চোখ মেলে ভাবছিলো জ্যোতি হুম জ্যোতি "নহন্যতে" দেখে মনে এলো কথাটা
যা থেকে যায় যা ভোলার নয় নহন্যতে তাই। আমাদের কথা গুলো টুকে রেখে যাবো যা হয়তো কোনো দিন কারো নজরে পড়বে, জানবে মানুষ এই বিংশ শতাব্দিতেও প্রেম আছে শুধু হালকা বা শেষ হয়ে যায়নি এখনো প্রেমের গভীরতা আছে, যা কোনো মানুষের বুকে এখনো একটি নামের শব্দ পাথরের মতো গেঁথে থাকে । সে পাথর আর সরে নি । অনেক ভার বয়ে বেড়ানো পাথর আর সরেনি জীবন থেকে সুখেন নাম আঁটকে গেছে আকাশের ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল আলোয়
সুখেন ,একজন মানুষ ,একজন বন্ধু,একজন নির্ভরতার নাম
এই যাহ্ , কখন বৃষ্টি এসে ঘর দোর ভিজিয়ে দিয়ে গেছে একেবারেই খেয়াল করেনি জ্যোতি ...ভাবনার জগতে ডুব সাঁতারে অতলে চলে গেছিলো এদিকে বাইরের কাপড় সব ভিজিয়ে একসার ... আর বৃষ্টির কোনো আগা মাথা নেই যখন তখন না বলে কয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে
এই শোননা ... কি করছো তুমি এখন ? সারাটা দিনে ভুল করেও মনে পড়ে একবার এই আমাকে ? সত্যি করেই বলবে কিন্তু !
আমি না খুব বাজে হয়ে গেছি বুঝলে বকা দাও খুব করে
হ্যাঁতো দেবো আসি আগে এসেই ...কি এতো করো সারা দিনমান ?
আহহা , কি করে বোঝাই তোমায় ,কতো কি কাজ আমার সাথে -কাজ আছে হাহাহা
সেকি আর আমি কম বুঝি ? গান বাজচ্ছে, কার গান শুনছো ?
আমার প্রিয় শিল্পী
কে ?
শারমিন সাথী ময়না
ওহ,ময়না ! বুলবুল ভাইয়ের স্ত্রী শোনো ,ভরিয়া পরাণ ... ছাড়ছি ফোন । ও এই শোনো ফোন দিয়ো ফ্রী হয়ে
এটা একটা কথার কথা তা জানতো জ্যোতি , ফোন সুখেন দেবেনা তাকেই দিতে হবে । এই কথা দেয়ার কথা সে ভুলে যাবে।
পৃথিবীর এক অন্যজগতের মানুষ যেন ছিটকে এসে এখানে হাবুডুবু খাচ্ছে । আর সেই মায়ায় ঘিরে রেখেছে জ্যোতির চারপাশ অনেক ভেবেও পারেনি সরে যেতে ।ভাবছিলো আর কানে চলছে " আমি নই আমার ভেতর সে অন্য কে এক কথা কয় " শ্রীকান্ত আচার্য্য । কী অদ্ভুত গায় ভদ্রলোক
একসময় খুব আকুল হয়ে গেছিলো জ্যোতি ,এই গায়কের সাথে কথা কইতে যোগাড় করেছিলো ফোন নম্বর তারপরঃ কি ভেবে আর করেনি ফোন থাকনা দূরের মানুষ দূরের দেশে শুধু শ্রবণে কাছে আসলে সব কিছু সুন্দর থাকেনা । সব কিছু কাছে আনতে নেই
জালালায় চোখ যেতেই দুটো শালিক কেমন ঠোকাঠুকি করছে একে অপরকে ... বাহ্ ,কি নিয়ে ওদের এই ঠোকাঠুকি ?
ইশ যদি পড়া যেতো ওদের ভাষা ! ওইতো মেহগনি গাছটাতে বেশ কিছু কলি এসেছে ফুটবে 'দিন পরে আর জ্যোতি তক্কে তক্কে আছে এবারে ফোটা ফুলের ছবি তুলবেই তো সেই মেহগনী গাছের ডালেই বসেছে শালিক দু'খান।
পাশ দিয়ে বেশ 'গাছি লতানো গাছ বেয়ে উঠেছে । কি ওগুলো ? পেস্তা আলু ? নাহ্ , ঠিক চিনতে পাড়ছেনা
এবার বের হতে হবে ঘরে কিচ্ছু নেই ... আজ না খেয়ে থাকতে হবে ...
সিঁড়ি বেয়ে হাঁপিয়ে গেলো বেশ ... শ্বাস-প্রশ্বাস হছে জোরে জোরে চাবিটা হাতড়ে বেড়ায় ব্যাগের ভেতরে ,ওফ ব্যাগ তো নয় গাউছিয়া মার্কেট একটা জ্যোতির বেল বাজাতে হয়না ,কেউ নেই দরজায় বেল শুনবার খুলবার ,নিজের দরজা নিজেই রোজ খুলতে হয় কেউ অপেক্ষায় থাকেনা দুয়ারে বা খাবার টেবিলে কেউ ডাকেনা আরে কোথায় তুমি ?ক্ষুধায় পেট জ্বলে যায় জলদী এসো ...
ব্যাগটা রাখে টেবিলে, ফ্যানের সুইচটাতে হাত দেয় ধ্যাত, এই ফ্যানটাও কি যে ঘুরতেই জানেনা যেন এতো কম ঘুরিস কেনরে ? ক্লান্ত হয়ে গেছিস আমার মতো ? একটু জোরে ঘোর বাবা ,আমি ঘামছি দেখছিস না ?
বিছানায় ধাপ করে শরীরটা ফেলে দেয় কোনো তাড়া নেই , নেই তাগাদা চোখ বুজে পড়ে থাকে যতক্ষণ মন চায়
যাবে নাকি পার্লারে , মাসাজ করে আসবে একবার ? নাহ্ ,শক্তি নেই পথটুকু যাবার থাক
চুপ করে জানালার গরাদের ফাঁকে আকাশ দেখতে দেখতে কখন চোখ বুজে ঘুম এসে গেছিল টের পেলো সন্ধ্যায়
আফা আফা এই ভর সন্ধ্যায় ঘুমান আফনে্র শরীর কি খারাপ নাকি ?
ওহ বুয়া নাহ আজ এতো ক্লান্তি লাগছে ...
আসেন আফনের মাথায় একটু বিলি কাইটা দেই
দাও বুয়া দাও তো...
বুয়া এক কাপ চা করে এনে দাও না প্লিজ তারপর তোমার মাথায় হাত বুলানো আমি খুব আরাম করে চোখ বুজে উপভোগ করি ...
আইচ্ছা আফা আনতাছি
আফা নেন চা নেন
বুয়া তুমি অনেকদিন বেঁচে থেকো গো
না আফা অনেদিন বাঁচার ইচ্ছা নাই তয় ছেলেডা মানুষ হওন পর্যন্ত বাঁচলেই চলব এই দোয়া কইরেন
আচ্ছা বুইয়া সারাদিন বাসায় বাসায় কাজ করে আবার ঘরে গিয়ে সব করতে হয় তোমাকে ?
আফা রান্ধন বাড়ন সব করন লাগে কাপর ধুই রাইতের বেলা আবার হ্যায় কামে যায় সক্কালে হের লাইগা সক্কালেই উইঠা রান্ধন লাগে
তোমার স্বামী কি করে যেন ? ভ্যান চালায় ? কেমন আয় হয় ?
আফা কি কমু কন, আয় তো কম করিনা দুইজনে, যেই দাম জিনিসের হের পরে হ্যার সবাব বালা না
কেমন ?
জুয়া খেলে আফা সব ট্যাকা হাইরা আহে
আহা ...
আমার থেইক্কা জোর কইরা লইয়া যায় ,আমি এই যে কয় বাসায় কাম করি সব বাসার খবর তারে কইনা। দুইডা বাসার ট্যাকা ব্যাঙ্কে রাহি ,আমার বইনে একটা একাউন্ট খুইলা দিছে
বাহ্ ! খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছো বুয়া
আফা পোলাডা জন্ম দিছি হের চিন্তা আছে মাথায়। হেরবাদে পোলাডারে মায়ের কাছে রাইখা আইছি দ্যাশে। এইহানে একলা থাইকা কার লগে না কার লগে মিশবো হেই ডরে
ভাল করেছো খুব
বুয়া ফোন বাজছে এনে দাওনা ...
হ্যালো ---বলো এতো চিৎকার করছো কেনো তুমি তোমার না প্রেসার আছে ?
আপা আপনি আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেই বুঝতে পারবেন কি দুর্বিষহ জীবন আমি যাপন করেছি এই ২১ বছর নিশিতের সাথে। শুধু একটু সময় দিয়ে শুনে দেখেন
বলো আমি শুনবো বলেই ডেকেছি তোমায় ,মন খুলে বলো যা যা বলার
আপা ,আমার বিয়ে হয়েছে ২১ বছর আমার নিশিতের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলোনা মানে পরিচয় ছিলোনা
বাবা মায়ের কাছে প্রস্তাব এসেছিলো বাবা মা দেখলো ছেলে শিক্ষিত রাজী হয়ে বিয়ে দিয়েদিলো
তারপর বিয়ে হয়ে গেলো ?
বিয়ে হলো , কিন্তু আমার ছোট বোনের সাথে ওর জানাশুনা ছিলো সেই সুবাদে আমাদের বাড়িতে এসেছিলো দু একবার আমি দেখেছিবিয়ের আগেও
আচ্ছা ,তারপর ...
বিয়ের দুদিন পরে আমি কেমন যেন অসাভাবিক একটা ধাক্কা খেলাম ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি । আমার তখন মাত্র ১৭ ...
আবার ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, কেমন অসস্থিতে ভুগেছি ,কাকে বলবো তেমন কেউ ছিলোনা ...
কেনো কি বুঝেছিলে বা দেখেছিলে ..
মাকে বলেছিলাম,বাবাকেও
ওরা কি বললো ?
ওরা বললো ওখানেই ফিরে যেতে ,আমার তখন মাত্র ১৭ ,কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি কি করবো
তো ,তুমি ফিরে এলে ?
হুম, ফিরেই এসেছিলাম মা বাবা বলেছিলো সব ঠিক হয়ে যাবে ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেলেই
মানে ? ছোট বোন ? সেকি তাকে নিয়ে কি আবার ?
ঘটনাটা তাকে নিয়েই আর তাই আমার জীবনের সব চেয়ে লজ্জা আমি চেপে রেখেছিলাম ২১ বছর
বলো কি মেয়ে ? ঘটনার সূত্রপাত সেই বিয়ের আগে থেকেই ? তারপর থেকে এইসব চেপে রেখেছিলে ?
আর সন্তান জন্ম দিলে ? ওই মানুষটির বাহুলগ্না হতে খারাপ লাগেনি ?
সাহস ছিলোনা আমার
না সাহস না থাকা আর বাহুলগ্না হতে পারা এক নয় তাহলে এই ২১ বছর পরে কেন অসহ্য লাগছে ? আরো কটাদিন মানিয়েই নাও
আপনিও ? আমার আত্মীয়দের মতো বলছেন কিন্তু এখন তো আমি আর পা্রছিনা ...
পারতেই হবে কারণ তোমার কি আছে যে একা চলবে ? টাকা, শক্তি সাহস কি আছে বলো ? পারো তো কেবল ঘুমের বড়ি গিলে গিলে শুয়ে থাকতে নিজেকে সরিয়ে নেবার এক কৌশল শিখেছো আর মানুষটা যাকে টেনে এনেছো অনিচ্ছা আর ঘৃণার স্তুপ ঠেলে তার কি হয় ভেবে দেখেছো ? ওর কি দোষ ? যদি এখন প্রশ্ন করে " মা তুমি বাবাকে কেমন করে তুলে দিয়েছিলে  সব জেনে শুনে " কি উত্তর আছে দেবার তোমার ?
কিন্তুঃ আমি তো চেষ্টা করেছিলাম ভালবাসতে তাকেই
তাকেই; কি করে সম্ভব তাকে ভালোবাসা, নিজের চোখে দেখেছো কুৎসিত কদাচার রূপ যার ? তুমি কি নিজেকে দেবী প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলে ? তবে দেবীর চোখে জল মানায় না বুঝলে । তুমি তাকে মোটেও ভালোবাসোনি আমি বলছি শোনো__
তোমার শরীরের ক্ষুধায় তুমি নিজের ছোট বোনকে হার মানাতে চেয়েছিলে যদি এমন বলি ? দেখাতে চেয়েছিলে তুমি পারো এবং তোমার নারীত্ব আছে আর তা সম্পূর্ণ
না না না আপনি কি বলছেন ? আমি তা করিনি
তাহলে কি বলতে চাইছো তুমি ? তোমার শারীরিক তৃষ্ণা নেই বা ছিলোনা ? নিশিতকে দেখলে তা জেগে উঠতোনা ?
তুমি কি সন্যাসিনী ছিলে ?
উঁহু, তবে কখনো কখনো মনে হতো নিশিত আমাকেও চায়, বিশ্বাস করে ।
হাহাহাহা , সে তো চাইবেই কারণ ওর তো ক্ষুধার জাহাজ ভর্তি । চাইবেনা হাতের কাছে নারী থাকবে আর সে চাইবে না এমন ঋষি তো সে নয় তা বোঝা গেছে আগেই । কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে তোমার কাছে ___এই যে বললে সে আগে থেকেই তোমার বোনকে জানতো , তবে তাকে কেনো বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো না ? তাহলেই তো লেঠা চুকেযেতো । আচ্ছা শোনো বন্যা, আমার বাসায় চলে এসো সামনে বসে শুনবো কেমন ? এসো এক্ষুনি
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলো জ্যোতি । মনে পড়ে যায় নিজের আগুনজ্বলা দিনের কথা কি বলবে সে বন্যাকে ! নিজেই কিছু কাউকে বলতে পারেনি অসহায়ত্বের কথা
এতো তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে যায় উফ... দরজা খুলেই কৃষ্ণচুড়া ভোর ...
টকটকে লাল আকাশের রঙ আর গাছের ফুলের রঙ আহা ... চারপাশে কিচির মিচির কতো পাখি 
পাশের বাড়ির পায়রাগুলো বাকুম বাকু করেই যাচ্ছে জ্যোতি ছাদে দাঁড়ালো প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো । একেই কি বিমুঢ় সকাল বলে ? বিমুঢ় ভোর বিমুঢ় মায়া মনে হয় কত সুন্দর পৃথিবী
আকাশ আমায় ভরলো আলোয় আকাশ আমি ভরবো গানে
সুরের আবীর হানব হাওয়ায় নাচের আবীর হাওয়ায় হানে
একচক্কর ঘুরলো জ্যোতি ... এখন নাস্তা বানাতে হবে ,অফিসের লাঞ্চ বাক্স গুছিয়ে নিতে হবে । তারপর স্নানঘরে জলের কাছে নিজেকে সমর্পণ কাপর আয়রনের ঝামেলা নেই বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ভয়ে রাতেই করে রাখে জ্যোতি ।এখন ঝরঝরে শরীর সারাদিনের জন্য এক্কেবারে ফিট বেরিয়ে পরতে হবে এখুনি কারণ আজ গাড়ি আসবেনা
এই ড্রাইভার সাহেব যাবেন গুলাশান ?
গুলশান কতো নম্বর আপা ?
নম্বর গোলচক্কর ,মিটার আছে ?
আপা মিটারে গিয়া পোষায় না ২৫০ টাকা দিয়েন চলেন
কি ? ২৫০ না না এতো আপনি মিটারের চেয়ে ২০ টাকা বেশী নেন
না আপা , পোষায় না গেলে এই রেট দিতে হবে
কি করা যেতে তো হবেই চলেন ।
কিছুদুর যেতেই ড্রাইভার বললো
আপা রাস্তায় ট্রাফিক ধরলে আপনে বলবেন মিটারে যাচ্ছেন
না ! আমি মিথ্যে কেনো বলবো ? আপনি এমনিতেই বেশী নিচ্ছেন । তাছাড়া আমি মিথ্যে বলিনা
আপা, ট্রাফিক ধরলে ২০০০ টাকা জরিমানা কইরা দেবে ।
আমি কি করবো বলেন ? আমি মিথ্যে বলবো না ।
তাইলে আফা নাইমা যান আপনে অন্য গাড়ি নেন ।
কি বলেন আপনি এই বৃষ্টিতে আমি নেমে যাব কোথায় ? আমি এখনই ট্রাফিক ডাকছি দাঁড়ান । তাকিয়ে দেখো বেশ খানিকটা দূরে একজন ট্রাফিক দাঁড়িয়ে মাথায় ছায়া পাতা । ডাকলে শুনবে বলে মনে হয়না , যদিও এর আগে অনেকবার এমন ডেকে বলছে রাস্তার রাজাদের কিছু ওনারা করেন নি আজ আর কি করবেন ।নিজের সাথে নিজেকে সমঝোতা করেই দাঁত কিট মিত করে অফিস এই সি এন জি নিয়েই যেতে যেতে বিড় বিড় করে জ্যোতি কিচ্ছু হবেনা এখানে দেশে ...