গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

ভ্রষ্টলক্ষ্য

[ আগেভাগে একটা নিবেদন করে রাখি। এই গল্পের দুটো পর্ব একসাথে লেখা হয় নি। প্রথম পর্বটা একটা অনুগল্প হিসেবেই লিখেছিলাম, তখন দ্বিতীয়টার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। তারপর ভেবে দেখলাম প্রথমটার অনুবর্তী আর একটা গল্পের সম্ভাবনা আছে। দ্বিতীয় পর্বটা তারই ফলশ্রুতি। এখন দাঁড়াল এই যে, দুটো পর্বের প্রতিটা একটা করে স্বতন্ত্র গল্প, আবার দুটো পর্ব মিলিয়ে আর একটা তৃতীয় গল্প, যার দুটো পর্ব একটা অপরের সম্পূরক। সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাখলাম, হয়তো গল্পে একটা ভিন্ন মাত্রার স্বাদ পেতে পারেন।]

অবশেষে মলয় মনস্থির করে ফেলেছে। আর নয়, এ বউকে আর পৃথিবীতে থাকতে দেওয়া নয়!

মলয় কিন্তু খুনে-গুন্ডা নয়। ছাত্রজীবনে পড়াশোনায় ভাল, বর্তমানে অধ্যাপক হিসেবেও সুনাম আছে। কিন্তু দীর্ঘ ছ'বছর ধরে সে সন্দেহের আগুনে পুড়েছে। প্রথম দিকে ছোট ছোট এলোমেলো কথা, সামান্য খটকা। ধীরে ধীরে সন্দেহ গাঢ় হওয়া, অনেক দুই আর দুইএ চার হওয়া। অবশেষে গতমাসে প্রত্যক্ষ প্রমাণ, তার বউ ভ্রষ্টা। তার জীবনে মলয়ের আর কোনও স্থান নেই। তখনই মলয় নিয়েছে এই চরম সিদ্ধান্ত।

মলয়ের বউ প্রত্যেক সপ্তাহে দুটো করে পিল খায়। যৌবন দীর্ঘায়িত করবার প্রচেষ্টায়। ঠিক ওইরকম দেখতে এক মারাত্মক বিষের বড়ির সন্ধান ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বার করেছে মলয়। তারপর তা যোগাড়ও করেছে অন্ধকার দুনিয়ার কোন নাম-না-জানা দালালের মারফৎ। বিদেশে তাকে প্রায়ই যেতে হয়। সেরকম একটা ফরেন অ্যাসাইনমেন্ট জুটিয়ে নিতেও বিশেষ বেগ পেতে হয় নি। মাস ছ'এক জার্মানিতে থাকার মাঝেই ওষুধের শিশিটা খালি হয়ে যাবে। যার মধ্যে মলয় রেখে দেবে একটি বিষের বড়ি। সবকিছু একবারে ছবির মতো প্ল্যান করে নিয়েছে মলয়। ঘটনার সময়ে সে বহুদূরে। মৃত্যুর কারণ বা অস্ত্রের কোনও চিহ্নও থাকবে না।

মনস্তাত্বিক হয়তো বলতে পারবেন, কতোখানি অন্তরদহন থেকে একজন সুস্থ, শিক্ষিত ভদ্রলোকের মানসিকতায় এমন পরিবর্তন হয়। ভিসার ব্যবস্থা করে জার্মানির টিকিট পকেটে নিয়ে সেদিন মলয় যখন বাড়ী ফিরল, তাকে বেশ খুশী লাগছিল। নিখুত ভবে করা পরিকল্পনার শেষটুকু সম্পন্ন করতে নিজেকে বেশ আত্মনির্ভর মনে হচ্ছিল তার। পরশু তাকে চলে যেতে হবে। সুতরাং কালকের মধ্যেই...। বাড়ীতে এসে দরজার কলিং বেলের দিকে হাত বাড়াল মলয়।
* * *
- স্যার, উনি এসেছেন।

কন্সটেবল নিতাইয়ের কথায় মুখ তুলে চাইলেন ইন্সপেক্টর সামন্ত। নীলিমা দেবীকে দেখে তাড়াতাড়ি বললেন, আসুন ম্যাডাম। একটা মামুলি ফরম্যালিটির জন্যে আপনাকে কষ্ট দিতে হল। আসলে অস্বাভাবিক মৃত্যু তো...অটপসির পরে ডেডবডি হ্যান্ডওভার করার আগে একটা সনাক্তকরণের ব্যাপার থাকে...। ‘আসুন, এই যে এই দিকে...’। তাঁরা মর্গের ভেতরে ঢুকলেন। নিতাই কলের পুতুলের মতো একটা ট্রে টেনে বার করে দিল। নীলিমা দেবীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, রুমাল চাপা থাকায় মুখের ভাব ঠিক বোঝা গেল না। এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর শুষ্ক কিন্তু শান্তস্বরে তিনি জানালেন, হ্যাঁ ইন্সপেক্টর। উনিই আমার স্বামী, মলয় চৌধুরী।

         দু'পেগ হুইস্কি গলায় ঢেলে সন্দীপ মনচন্দানি তার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে দখিনা বাতাস সেবন করছিল। সে ব্যবসার কাজে এক সপ্তাহের জন্যে দিল্লি গিয়েছিল, আজ সকালেই ফিরেছে। জমা কাজগুলো শেষ করতে গিয়ে আর নীলিমার সাথে কথা বলা হয় নি। কিন্তু মন আজ তার বেজায় ফুরফুরে। অবশেষে তার মনপবনের নাওখানি পারে লাগতে চলেছে। নীলিমা এখন সম্পূর্ণ তার। এই সপ্তাহান্তিক অবসরে রেজিস্ট্রিটা করে নিলেই হল। মেয়েরা যে কত বোকা হয় ভেবে মনে মনে একটু হাসি পেল সন্দীপের। নীলিমা তার এই দীর্ঘ অভিনয় ধরতেই পারেনি। তারই পরামর্শ ও পন্থায় মলয়কে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতেও সে দ্বিধা করে নি।

বিদেশ যাত্রার দিন সকালে ইলেকট্রিক শেভারে শক লেগে মলয়ের মৃত্যু হয়। শেভারের কারচুপিটা সন্দীপের অবদান। পুলিশ সেসব কিছুই ধরতে পারে নি। পুরো তদন্তে সন্দীপের নামই কোথাও আসে নি। এক নিছকই আকস্মিক দুর্ঘটনা, তার বেশী আর কোনও তথ্যই আবিষ্কার হয় নি। প্রাথমিক তদন্তের পরে মাস খানেকের মধ্যেই পুলিশ এই কেসে ইতি টেনে দেয়। ব্যাপারটাকে অনর্থক আদালতে টেনে নিয়ে যেতে পুলিশ বা সরকার কেউই আর আগ্রহ দেখায় নি।

সন্দীপের ব্যবসার অবস্থা এখন বেশ টলমলে। ওপরের ঠাটবাট বজায় রেখেছে ধারদেনা করে। একবার নীলিমা ও মলয়ের সম্পত্তি সন্দীপের অধিকারে এসে গেলে তার অনেকটাই সুরাহা হয়। তারপর আর নীলিমাকেই বা তার কি প্রয়োজন ? অভিনয়ের পালাও সাঙ্গ। সন্দীপের ভেবে বেশ মজা লাগে, নীলিমা কি এও বুঝতে পারে নি...
সন্দীপের সুখচিন্তা ব্যাহত হল দরজায় করাঘাতে। দেখা গেল, অভ্যাগতটি এক পুলিশ অফিসার।
- সরি, আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য। আমি ইন্সপেক্টর সামন্ত, ক্রাইম ব্রাঞ্চ। আপনিই শ্রী সন্দীপ মনচন্দানি তো ?
- হ্যাঁ, কেন বলুন তো ?
- বালিগঞ্জের নীলিমা চৌধুরিকে চেনেন নিশ্চই ?
সন্দীপ একটু সন্দিগ্ধ। সরাসরি চেনে না বলাটা কি ঠিক হবে ? কতদূর খোঁজখবর নিয়ে এসেছে জানা নেই। কিন্তু মলয়ের মারা যাওয়ার কেস তো সব মিটে গেছে, আবার নতুন কোন ফ্যাকড়া এল নাকি? বেশ খানিকটা সাবধানতা নিয়ে সন্দীপ বলল, হ্যাঁ, মানে ঐ আর কি, পারিবারিক বন্ধুত্ব বলতে পারেন। কি ব্যাপার বলুন তো ?
- ব্যাপার আর কি?

কাল নীলিমা দেবীর বাড়ী তল্লাশী করে ওনার একটা ডায়রি পাওয়া গেছে। তাতেই আপনার নাম আর টেলিফোন নম্বর ছিল। ঠিকানা বার করতে অসুবিধে হয় নি। ... আমি সে ডায়রি পড়ি নি মশাই। কিন্তু আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা, তপন তালুকদার, ...জানেন বোধহয়, বড় গোঁয়ারগোবিন্দ লোক কিন্তু মাথাটা খ্যালে বেশ, বললেন, সেই ডায়রিতে নাকি এমন কিছু তথ্য আছে যা মলয় চৌধুরির মৃত্যুরহস্যে কিছু খটকা তৈরি করছে। উত্তর আপনার কাছে থাকা সম্ভব। তাই আসতে হল। ...ইয়ে, একটা নিয়মমাফিক ওয়ারেন্ট সঙ্গে এনেছি বটে, কিন্তু আপনার মতো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি পুলিশের তদন্তে সাহায্য করবে না, তা আবার হয় নাকি? কি বলেন?
পরতে পরতে রক্ত নেমে যাওয়া সন্দীপের ফ্যাকাসে মুখটা ইন্সপেক্টর সামন্ত দেখতে পেলেন না। অথবা না দেখার ভান করলেন। গলার স্বর যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রিত করে সন্দীপ জিজ্ঞেস করলো, নীলিমার ডায়রি... তা আমাকে কেন, সেই তো ভাল বলতে পারতো...? আর তার বাড়ী আবার খানাতল্লাশী হল কেন? মলয় চৌধুরির কেস তো মিটে গেছে, তাই না?
- আর বলবেন না, একটা কেস মেটে তো আর একটা গজিয়ে ওঠে...। এই পুলিশের কাজে ঘেন্না ধরে গেল স্যার...
একটা দুম দুম করে ঘা পড়ার আওয়াজ হচ্ছিল। সন্দীপ বুঝল সেটা বাইরে কোথাও নয়, তার বুকের মধ্যে। অনেক চেষ্টাতেও গলাটা একটু কেঁপে গেল, নীলিমা কিছু বলেছে...!

- ওহো, আপনি তাহলে খবর পান নি ? ইন্সপেক্টর সামন্তের কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন ঠাণ্ডা হয়ে এলো, পরশু রাতে নীলিমা দেবী মারা গেছেন... বিষক্রিয়ায়...।