গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

       নাকছাবি

    
বোকা আর চালাক ট্রেন থেকে নামল হাওড়া ইষ্টিশনে। কলকাতা দেখতে একলা একলাই চলে এসেছে দুই বন্ধুতে। তাদের গাঁয়ের মানুষদের কলকাতা দেখার ইচ্ছে হলে মুরুব্বির পিছন ধরে আসে। তবে কি-মুরুব্বি ব্যস্ত মানুষ। গাঁয়ে যে কত লোক গুনতি করাই দায় ! কাকে ডাক্তার দেখাতে হবে,কার জমি রেজিস্টিরি করতে হবে,কার মামলার দিন পড়েছে,তো তাদের নিয়ে ছোটো-কখনও মানবাজার,কখনও পুরুলিয়া-সব দায় তো মুরুব্বিরই। বোকা-চালাককে কলকাতা দেখাবার ফুরসত তার কখন হবে কে জানে! 

   চালাকের ভয়ডরটা একটু কমই আছে। সে বলল,-দুজনেই যাই কেনে ? বোকার বিবেচনা বোধ একটু বেশি। সে বলল,-দুজনে একলাটি যাবি,হারাই গেল্যে ? চালাক বলল,-আমরা কি কচি ছেইল্যা বঠি যে হারাই যাব?কেনে মিছামিছি ডর‍্যাচ্ছু বলদেখি তুই ? বোকা কি আর সাধে ডরাচ্ছে!তাদে'গাঁয়ে কেউ কখনও মুরুব্বির সঙ্গে ছাড়া কইলকাতা গেছে ? জম্মকাল থেকে তাই-ই তো দেখ্যে আইসছে বোকা। আগে লোকে বুড়া মুরুব্বির সাথে যাইত্য। তার বড় ব্যাটা এখন মুরুব্বি হয়্যেছে,তার সঙ্গেই লোকে কইলকাতা যায়। সঙ্গে যাইয়েও বলে কত লোকে কত বিপদে পড়ে ! সেসব গপ্পো কি চালাক শুনে নাই ? কইলকাতা কি তাদের গাঁয়ের মত নাকি ? সিটা নাকি অ্যাতবড় জায়গা যে তিনদিন সমানে হাঁইটলেও শেষ হবেক নাই ! হাঁটারও কি জো আছে ? সেবারে তো হুড়রা কাকা রাস্তায় মটর চাপা হত্যে হত্যে বাঁইচল! সে মুরুব্বি সঙ্গে ছিল বল্যেই তো! তুই চাপা পইড়ল্যে কে বাঁচাবেক ? আর একবার পচাই হাওড়া ইষ্টিশেনে নাম্যে মুরুব্বির চোখ এড়াইয়্যে গঙ্গার ধারে গেল। সেখেনে হোটেলের ছোকরাগুলা তাকে খাতির কর‍্যে ডাক্যে লিয়ে মাংস-ভাত খাওয়্যাল। খাওয়ার পরে বলে,-এক কুড়ি টাকা দাও তো অত টাকা কুথায় পাবে পচাই?তার খুটায় পাঁচ টাকা আছে কি না আছে! তখন তাকে ধর‍্যে সবাই মিলে মারে আর কি! ভাইগ্‌গে হট্টগোল শুন্যে মুরুব্বির চোখ পড়ে সিদিকে ! সে কুনরকমে কিছু টাকা দিয়ে পচাইকে বাঁচায় !  চালাক তবুও বলে,-ভাবছুস কেনে তুই,আমার কি কুনো বুদ্ধি নাই ? শুন্‌ মন দিয়ে । কইলকাতার রাস্তার দুদিগে মানুষ চলার উঁচু উঁচু ডহর আছে। সেইখেন দিয়ে চইলতে হবেক। রাস্তায় নাইমলেই মটর আইস্যে গায়ে উঠে যাবেক। তাইলে নামবি কেনে তুই ? আমার হাতটি শক্ত কর‍্যে ধর‍্যে থাকবি। তাইলে আর হারাই যাবার কুনো ভয় থাইকব্যেক নাই।

চালাকের মুখে এমন মুরুব্বির মত কথাবাত্তা তিতা লাগে বোকার। মুরুব্বি ইসব বইল্ল্যে সিটা একরকম, তাই বল্যে চালাকের এরম কথা মান্যে লিতে হবেক!বোকার বুকে চিরকালের দুখ্‌খুটা চাগাড় দিয়ে উঠে। তার মায়ে-বাপে কেনে যে তার নামটা বোকা রাইখল! আর চালাকের বাপমাকে দ্যাখো। কী সুন্দর নাম রাইখল -চালাক! সেজন্যেই তো উ এমন বড় বড় কথা বইলত্যে পারে । নাইলে বোকা কি আর ভালো  ভালো কথা জানে না ? কিন্তু যখনই সে সেগুলান বইলত্যে যায় লোকে শুদুমুদুই হাইস্যে মরে । যেমন, এখন যদি সে চালাককে বলে,-তুই কি হাতির পাঁচ পা  দেইখ্যেছু যে মুরুব্বির মত কথা বইলছু - অমনি চালাক খ্যাক খ্যাক কর‍্যে হাইস্যে দিবেক। বইলব্যেক,-আবার ভুলভাল বকছু -কতবার বইল্যেছি,কথাটা হইল্য সাপের পাঁচ পা দেখা, হাতির লয়।
বুঝো তাইল্যে, সাপের বলে কুনো পা-ই  নাই,তায় পাঁচ পা! আর হাতির পাঁচ পা কে না দেইখেছ্যে !ইদগে তো পেরাই আসে হাতির পাল । মরদ হাতির মস্তি হইল্যে পেছনের দু'পায়ের মাঝে আর একটা পা বেরাই যায়,সিটা কি চালাক দেখেনি ?
কিন্তুক উ কথাটা চইলব্যেকনি। একবার বইল্যেছিল পাঁজ্জনের মধ্যিখানে। অমনি কী হাসাহাসি ! চালাক বইল্যেছিল, - তোরও তো তাইলে তিনটা পা। দু'পায়ের মাঝখানের ছোট পা টা বের করাই দেখা না কেনে ?
বোকা তখন লজ্জায় মরে। আর সবাই হাইসত্যে থাকে। সেই থাক্যে যে সে যখন তখন তাকে বলে,
 - তোর তিন লম্বর পা টা কেমন আছে একবার দেখা না ?
জম্মের শোধ শিক্ষা হয়্যে গেছে বোকার ! যতই ভালো কথা মনে আসুক,তখন থাক্যে সে মনেই রাইখ্যে দ্যায়, কারোর সুমুখে প্রকাশ করে না - চালাকের সামনে তো লয়ই।
বোকাকে চুপ করে থাকতে দেখে চালাক তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে,-রাইত্যের বেলায় রেলে চাইপব,সকালে হাওড়া ইষ্টিশেনে নাইম্যে বিরিজ পেরাই যদ্দুর পারি হাঁট্যে হাঁট্যে কইলকাতা দেইখব। সঙ্গে লিব গুড়-চিঁড়া,ভোক লাইগল্যেই খাইয়্যে লিব। আর কইলকাতার রাস্তায় রাস্তায় জলের কল । বেলাবেলি বিরিজ দিয়ে ইষ্টিশেনে ফির‍্যে আস্যে রাইত্যের রেলে চাইপ্যে সটান ঘরকে। বোকা ভয়ে ভয়ে বলে,
-ফিরার সময় যদি বিরিজের রাস্তা চিনতে না পারুস ? চালাক হেসে বলে,
- দূর বোকা, হাওড়া বিরিজ কত উঁচু জানুস
-কইলকাতার সবখেন থেইকে বিরিজের মাথা দেইখত্যে পাওয়া যায়!হারাই যাবার কুনো উপায় নাই।

কাজেই পরের দিন সন্ধেবেলায় ক্ষারে কাচা আটহাতি ধুতি ও গেঞ্জিতে সেজেগুজে গুড়-চিঁড়ের পুটলি হাতে দুজনে পুরুলিয়া স্টেশনে এসে টিকিট কেটে হাওড়ার ট্রেনে উঠে পড়েছিল।  সকালবেলায় হাওড়া স্টেশনে নেমেই চালাকের হাতটি শক্ত করে ধরে নিল বোকা । কিন্তু চালাক যে চালাক -সেও প্লাটফর্মে নেমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মানুষের ভিড়ে এগোনই দায় । চাদ্দিক থেকে লোক আসছে যাচ্ছে,পা বাড়ালেই ধাক্কা আর গালাগালি-গেঁয়োভূত,উজবুক,আহাম্মক -কত কী ! লোকের এইরকম গালি আর ধাক্কা খেতে খেতে,পড়ে যেতে যেতে একসময় আপনা থেকেই তারা একটু ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল । বোকাকে বাহাদুর বলতেই হয়-এত ধাক্কাধাক্কির মধ্যেও সে চালাকের হাত ছাড়েনি। ফাঁকা জায়গায় এসে চালাক এদিক ওদিক নজর দেওয়ার ফুরসত পেল। দেখল,কিছু লোক সিঁড়ি দিয়ে পাতালে নেমে যাচ্ছে,কিছু লোক সমতলে হাঁটতে হাঁটতে বড় বড় দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
পাতালে নামার সাহস হল না চালাকের। সে সমতলের দরজার দিকে অন্য লোকের পিছন পিছন পা বাড়াল,তার হাতে ধরা বোকার হাত। তারা দরজার কাছাকাছি গেছে,এমন সময় কোত্থেকে একটা কালো কোট পরা লোক এসে চালাকের সামনে হাত বাড়াল,
-টিকিট
বোকা ভয় পেয়ে গেলেও চালাক দিব্যি তার ধুতির খুঁট খুলে টিকিট দুখানা লোকটার হাতে তুলে দেয় । লোকটাও টিকিট দেখছে, মওকা পেয়ে বোকাও তখন চালাকের হাত ছেড়ে লোকটার  জমকালো পোশাকটা মন দিয়ে দেখছে । এমন সময় একটা সিড়িঙ্গে পানা লোক বোকার হাতে একখানি রঙিন-চকচকে ছবিআলা কাগজ ধরিয়ে দিল। বোকা সভয়ে সেটা ঝটিতি লোকটার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে শক্ত করে চালাকের হাতটা ধরে ফেলল আবার
সব্বোনাশ হতে যাচ্ছিল এখ্‌খুনি ! লোকটা নিঘ্‌ঘাত কাগজ দিয়ে পয়সা চায়্যে বইসত। আর পয়সা না পাল্যে তাকে কী না কী কইরত কে জানে ? সে যে বুদ্ধি কইর‍্যে পয়সা চাওয়ার আগেই কাগজটা ঘুরাই দিতে পার‍্যেছে সে জন্যে মনে মনে বেশ গরব হল তার।
কালো কোট পরা লোকটা টিকিট দেখে ফেরত দেবে সেই আশায় চালাক দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু টিকিট ফেরত দেওয়ার বদলে তাকে কষে একটা দাবড়ানি দিতেই সে তাড়াতাড়ি বোকার হাত ধরে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। বোকা তখন চালাককে তার বাহাদুরির গপ্পোটা যেই না বলেছে অমনি সে পিছন ঘুরে লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল। সত্যিই তো! মানুষজন বেরাই আইসছে আর  লোকটা সেই চকচকে রঙিন কাগজ একখান কর‍্যে ধরাই দিচ্ছে সবাইকার হাতে। কিন্তুক টাকা-পয়সা তো লিচ্ছে নাই কারোর থেক্যে ! সে ভেবেচিন্তে বোকাকে বলল,-যা না, চাইয়্যে লিয়েআয় একটা । টাকা খুঁইজব্যেক নাই, দেইখছুস নি মাগ্‌নাই দিচ্ছে সব্‌বাইকে !
বোকাকে বোকা বানানো অত সস্তা লয়,শেষকালে কী হইত্যে কী হব্যেক -বোকা কিছুতেই তার জায়গা থেকে নড়ল না । চালাক আর কী করে,বোকার হাত ছাড়িয়ে নিজেই গেল লোকটার কাছে আশ্চজ্জ ব্যাপার,চালাক হাত বাড়াতেই দিব্যি তার হাতে একখান ছবির কাগজ ধরাই দিল লোকটা !

বোকা দূর থেকে দেখছিল আর তার বুক ধড়াস ধড়াস করছিল -এবেরে কী হয়! কিন্তুক কিছুই হলনি, চালাক কাগজখান লিয়ে গট্‌গট্‌ কর‍্যে ফির‍্যে আইল্য বোকার কাছে । কী সুন্দর কাগজ! রঙের বাহারে চইখ ঝইলস্যে যায়!ছবির আধ-ন্যাংটা মেয়্যাটা কী সুন্দর ! নীচে কী সব লেখা আছে! হলে কী হয়, তাদের দুজনার কুনোদিন পাঠশালে যাওয়া হয়নি গোরু-বাগালি করতেই দিন চল্যে যায়,অতদূরের পাঠশালে কে আর যায় ! তাতে ক্ষতি কিছু নাই,গাঁয়ে গেলে মুরুব্বি গড়গড় কর‍্যে পইড়্যে দিবেক কী লেখা আছে । তা ও বোকার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় । কাগজটা চালাকই বাগাইল্য !
নিজের বুদ্ধির দোষে হাতে পাইয়্যেও সে হারাইল্য। এখন একটাই তো কাগজ । চালাক সিটা নিজের ঘরের কপাটে সাঁইটব্যেক। সবাই বুইজব্যেক চালাক কইলকাতা-ফেরত। বোকাও যে কইলকাতা ঘুইর‍্যেছে সিটা কেউ পেত্যয় যাবেনি । মরিয়া হয়ে সে চালাককে বলে
,-চাইল্যে আমাকে আর একটা দিবেনি ? চালাক বলে,
- মনে হয় দিবেক।

ভয়ে ভয়ে পা বাড়িয়ে উড়তে উড়তে ফিরল বোকা। কী ভালো কইলকাতার লোকগুলান! এমন সুন্দর ছবিআলা কাগজ মাগনাই দিয়ে দিচ্ছে সব্‌বাইকে! যত্ন করে কাগজটা গোল করে পাকিয়ে ধুতির খুঁটে বাঁধল বোকা । তারপর দুজনে ফুরফুরে মনে হাওড়া ব্রিজের রাস্তা ধরল । অন্য লোকের পিছন পিছন চালাকের হাত ধরে উঁচু শান বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বোকা তাজ্জবের পর তাজ্জব হতে থাকে। কত উঁচু বিরিজ!নীচে মা গঙ্গা,তার বুকে ছোট-বড় কলের নৌকা ইদিগ উদিগ ভাইস্যে বেড়্যাচ্ছে। রাস্তায় কত যে মটর ছুইটছ্যে, একসঙ্গে অ্যাতো মটর বাপের কালে কুনোদিন দেইখত্যে পাবে ভাবেনি বোকা । সবচে' আশ্চজ্জি ব্যাপার,সব রাস্তাই শান দিয়ে বাঁধানো ! যেদিগেই নজর দাও,অ্যাক ফোঁটা মাটি নাই কুথাও ! বোকা ভাবল, কইলকাতার মানুষরা তাইলে কত বড়লোক ! চালাককে সেকথা বলতে সে বলল,
- বঠেই তো, ই কি
আমাদে' গাঁ যেখেনে রাস্তা তো রাস্তা,কারোর বাড়িতে অ্যাক ফোঁটা শান মিলব্যেক নি!
    
কথা বলতে বলতে আর হাঁটতে হাঁটতে আর হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে একবার করে হাওড়ার ব্রিজ দেখতে দেখতে চালাক-বোকা ঘুরতে লাগল রাস্তায় রাস্তায়। কিন্তু ব্রিজ হারিয়ে ফেলার ভয়ে খুববেশিদূর যেতে পারল না। উঁচু উঁচু পাকা বাড়ি, শান-বাঁধানো রাস্তা, চেনা-অচেনা জিনিসপত্তরের ছোট-বড় দোকান,হরেক রকমের মোটরগাড়ি আর মা-গঙ্গাকে দর্শন করেই শেষ করতে হল কোলকাতা-ভ্রমণ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুটলি খুলে গুড়-চিঁড়ে আর রাস্তার কলের জল খেয়ে ইষ্টিশেনে যখন তারা ফিরল, তখন তাদের সাহস অনেক বেড়ে গেছে । লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ফেরার টিকিট কেটে যখন তারা নিজেদের ট্রেনে চেপে বসল সন্ধেবেলা, তখন বোকা আর চালাক দুজনেরই মন আনন্দে ভরপুর । কেননা, দুজনের কাউকেই খালি হাতে ফিরতে হয়নি । তাদের ধুতির খুঁটায় বাঁধা আছে দু-টুকরো কইলকাতা । বাড়ি ফিরেই যে যার কপাটে সাঁটিয়ে দেবে চকচকে কাগজে ঝলমলে চেহারার আধন্যাংটো মেয়েছেলের ছবি - যেন তাদের হাড্ডিসার মলিন গাঁয়ের নাকে হীরের নাকছাবিটি !