সব নদী কথা বলে না
মন্টুর যাবার তাড়া ছিল না কিন্তু ওকে বিদায় দেবার তাড়া
আমারই ছিল। প্রথম যখন ওর চোখে তাকিয়েছিলাম বর্ষার নদী থেকে মাছের লাফিয়ে ওঠা একটা
চমক দেখে বলেছিলাম, ‘তোমার চোখ দু’টো খুলে
আমাকে দিয়ে দাও।‘ ও হেসে বলেছিল, ‘যতক্ষন
এগুলো আমার ভুরুর নীচে ততক্ষনই ওরা মনোরম, হাতে নিলে
দেখবে ব্যাবহার করা ফ্যাকাশে টিস্যুর মত মিলিয়ে যাচ্ছে সব।‘
আমি ভয় পেয়ে বলেছি, ‘থাক তবে।‘
এই এক রোগ ছিল ওর, যৌক্তিক
কথা কদাচিৎ বলত। বেশীর ভাগই যুক্তিহীন অথচ নিজেকে সে ভাবত খুব যুক্তিবাদী মানুষ
হিসেবে।
আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ওর ডানার নীচের উষ্ণতা এক সময়ে
প্রবল তাপ ছড়াতে শুরু করল। আমি ঘেমে, নেয়ে উঠতে উঠতে বুঝলাম আর
বেশীক্ষন এখানে থাকলে পুড়ে মরতে হবে। আমি ভুলে যেতে চাইলাম নৌকার বৈঠা বাইতে বাইতে
ওর ফুলে ওঠা পেশীদ্বয়ের কারুকাজ, রিকশা থেকে ট্রাকের নীচে
ঝাঁপিয়ে পড়তে চাওয়ার শৈল্পিক ইচ্ছা। শুধু ওর নাক চোখ মুখে কোমল আঙ্গুলে আঁকিবুকি
করতে করতে অথবা কখনো আমার চুলে ওর আঙ্গুলের কিলবিলে খেলা দেখতে দেখতে আলগোছে বলতাম, ‘আমাদের কি এখনো এই সাপ পুষবার দরকার আছে?’
তখনো ওর দরকার ফুরোয়নি বলে আরো চেপে ধরত না দেখা সেই
চুলের দড়ি, যা বেয়ে সে উপরে উঠত আর ডেকে যেত অনর্গল, ‘কেশবতী কন্যা দুয়ার খোলো, দুয়ার
খোলো।‘ আদতে সব দুয়ারই খোলা ছিল। কেবল আমি ঘুমাতে পারতাম না, রাতের পর রাত স্বপ্নে একটা মোটা অজগরের সাথে ফষ্টিনষ্টি
করতে করতে আমার ভেতরেও এক ধরনের সর্পিনী ক্ষুধা বেড়ে উঠছিল।
এসব দেখেই বোধকরি এরপর মন্টু চলে গেল।
মন্টু ফেরত এসেছিল আরো অনেক পরে। তবে ইতিমধ্যেই আমি
জীবনের অনেক গান আর ছলাকলা রপ্ত করে ফেলেছি। এই তো সেদিন খামোখাই পা’টা কেটে গেল ভাঙা কাঁচের টুকরায়। আমার বড়মামু রক্ত দেখে
তো একেবারে বিষম খাবার অবস্থায় খাবি খেতে লাগল। কাটা জায়গাটা চেপে ধরে ‘স্যাভলন কই, স্যাভলন আনো’ বলে চীৎকার করছিল আর আমি এসবের মাঝেও নটিনী মেয়েদের মত
ফিক করে হেসে বলেছিলাম,
‘মামু আগেকার দিনে মেয়েরা পায়ে আলতা দিত আজ
এই লেপ্টে থাকা রক্তে পায়ের সেই ইচ্ছাটাও পূর্ণ হল বটে।‘ মামু কেবল বলেছিল, ‘এক চড় দিয়ে
গালটা ফাটিয়ে দেয়া উচিত,
বেশী পড়ে পড়ে তোর মাথাটাই গেছে।‘
এটা ঠিক প্রয়োজনের তুলনায় আমি একটু বেশীই পড়তাম। একবার
বঙ্কিমের চন্দ্রশেখর পড়তে পড়তে শৈবলিনীর চঞ্চলমতি চপলতা এমনই ব্যাকুল ভাবনায়
ফেলেছিল যে আমার পাশে বসে খেলতে থাকা পাঁচ বছর বয়েসী ছোট ভাইটা কখন খাট থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে চিল চীৎকারে পাড়া মাথায়
তুলেছে টেরও পাইনি। সেদিন থেকে আমার মাও আমার উপর আর কোনো ভরসার জায়গা খুলে
রাখেনি। কষে দড়িদড়া বেঁধে পরিবারের অন্য সবার চারপাশে এমন এক বাউন্ডারী রচনা করে
দিয়েছিল যে চাইলেও আমি আর সেটা ডিঙ্গাতে পারিনি। মজার ব্যাপার হল, এই কারনে এক সময়ে আমি অনেক স্বস্তিও পেতে শুরু করলাম আর
মা’কে ধন্যবাদ জানাবার সুযোগ খুঁজতাম। সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন
মেয়ের উপরই মন্টু ভরসা করে বসেছিল। এটাই দুঃখের।
ও চলে যাবার পর আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম কিন্তু অজানা এক
শূন্যতা আমাকে গ্রাস করতে চাইল। সব সময় দেখতাম একজোড়া চোখ আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি
করছে। কখন যে চোখ দুটো ওকে ছেড়ে আমার সাথেই চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। আমি তাড়া
খাওয়া বুনো মহিষের মত হড়বড় করে আবার হায়েনার গুহার সামনে বসেই রোদ পোহাতে শুরু
করলাম। এসময়ে আমার সাথে বসবাস করবার জন্যে আমার আরেক প্রেমিক চলে এল। তিন বছর সে
আমার টিটকিরি সহ্য করেছিল। আর বারবার চেষ্টা করত শেকল ছিঁড়ে বেরুতে। কখনো মনিমালা, কখনো কাঞ্চনবালা অথবা সর্বদাসুন্দরীদের নিয়ে ছিল ওর সুদের
কারবার। কিনতু মূল বাজারটা ছিল আমাকে ঘিরেই। আমি সব বুঝেও না বোঝার ভান করতাম।
একদিন আমাকে ঘুমের ঘোরে রেখে সে পালিয়ে যেতে চাইল তার
আরেক প্রেমিকার কাছে। সে মূহুর্তে আমি ঘুমের ভান করলেও পারতাম। তা না করে ওর
শার্টের একপ্রান্ত টেনে ধরে বললাম, ‘এভাবে না।‘ সে বেচারা তখন লজ্জায় ম্রিয়মান হয়ে হাতের মুঠো খুলে আমাকে
একটা ঝিনুক দেখালো যেটা সে সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কি মনে করে ওটা আমার হাতেই
তুলে দিল। ঝিনুকের ভেতর মুক্তো থাকাটা স্বাভাবিক কিন্তু এই ঝিনুকটার বুকে দেখলাম
বিশাল একটা পোখরাজ মাথা উঁচু করে হাসছে। আমি আজো পারলাম না তাচ্ছিল্যের সেই হাসিটা
হেসে ফেলা রোধ করতে। তার বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে পুরো একটা
পারফিউমের বোতল ঢেলে দিলাম ওর শার্টের পকেটে। বললাম, ‘মেয়েরা
মূলতঃ প্রেমিকের পকেটের ভেতর থাকতে চায়। আমি চাই এই সুগন্ধি তোমার প্রেমিকাকে
বেঁধে রাখুক।‘ আমার এ কথা শুনবার পর ওর মুখের রেখাগুলোও আর একটা
ক্লান্তির ভাষায় বাঙ্ময় হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আমার কপালে শিশিরযুক্ত
একফোঁটা চুমু এঁকে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল। আমি পেছন থেকে চুপ করে দাঁড়িয়ে ওর চলে
যাওয়া দেখতে লাগলাম। যেতে যেতে ও যখন একবার ঘুরে তাকালো তখনই আমার বুক চিরে
দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে গিয়ে বাতাসে মেলালো। কেননা আমি জেনে গেছি, ও ফিরে আসবে। আমি বলতে চাইলাম, ‘আর যেন ফিরে এসো না......।‘ কথাটা
আমার মন থেকে ইথারে ভাসতে ভাসতে সোজা ওর কানের ভেতর গিয়ে ঘুরতে লাগল, ও শুনতে থাকল আমি বলছি, ‘আবার যেন
ফিরে এসো, হ্যাঁ!’ ও এক কদম পিছিয়ে এসে বলে গেল, ‘আমি চলে আসব। তোমার কাছে আমাকে ফিরতেই হবে। ঝিনুকটা যত্নে
রেখো।‘
এবার থেকে শুরু হলো আমার অবসর যাপনের যোলোকলা পূর্ণ হবার
দিন। আমি মিশে গেলাম অনেক মানুষের সাথে। ভিড়ে গেলাম জীবনের যেসব স্বাদ অজানা তার
আস্বাদ নিতে। এত এত মানুষ দেখতে অনভ্যস্ত আমার দুই চোখ একটু শঙ্কিত হলো। কিন্তু
এদের ভেতরেই আমি খুঁজে বেড়াতে লাগলাম একজন মানুষ। জীবনেও মানুষ না দেখা দুই চোখ
আমার এতটাই ব্যাকুল হল যে সাঁতারের ক্লাসে পরিচয় হওয়া সুদানের সেই ছেলেটার
প্রশংসায় বেশ গলে গেলাম। কালো এই ছেলেটার দাঁত আমাকে দারুন প্রলোভিত করলেও বুঝলাম
এটা শুধুমাত্র একটা অংশ। মানুষের পুরো অবয়ব এমন নয়। যেমন ইয়োগার ক্লাসে মিসেস
মুস্তাফিজের গ্রীক পুরানের নায়কের মত অসম্ভব সুন্দর স্বামীটি আমাকে দেখে কুলকুল
করে হাসতে থাকে আর তার ঠোঁট থেকে লোভের তেল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে তখন এত সুপুরুষ
লোকটাকেও আমার মানুষ বলেই মনে হয় না। তবু একটু ঢং করেই জিজ্ঞেস করি, ‘কি চান আপনি?’
সে ফিসফিস করে বলে, ‘তোমাকে।‘ আমি, ধ্যুত্তেরি ছাই বলে পাশ বদল করি।
একবার মা আমাকে একটা জলপূর্ণ গেলাস দেখিয়ে বলেছিল, ‘মেয়েরা হল এই পানির গ্লাস যতক্ষন না তুমি কারো তৃষ্ণা
মেটাতে পুরো জলই শেষ করে ফেলতে পারবে ততক্ষন কাউকে সুখী করাও তোমার হবে না। আর
অন্যকে সুখী না করতে পারলে নিজে কি করে সুখী হবে?’ আমি
অনেককাল মায়ের দেয়া এই ভ্রান্তি নিয়ে গ্লাসের পর গ্লাস জল সিঞ্চন করে গেছি অন্যের
হা এর ভেতর। আসলে তো জল দেয়া নেয়া নয়, আমি নিজেই
যমুনার ঘাট চিনিনি এ পর্যন্ত। মা’র উচিত ছিল আমাকে সেই ঘাটটা
চেনানো। কিংবা মা নিজেই জানতো কিনা একটা শ্বেত পাথরের ঘাটের কথা সেটাও সন্দেহ।
ইদানীং ইচ্ছে করে এই কথাগুলোই মার কাছ থেকে জেনে আসি। অথচ মার সামনে গেলে আমার
মুখে কথা যোগায় না। এত সৌম্য, এত শুভ্র মানুষ দেখলে যে কেউ
নিজেই নিজের কাছে আরো ছোট হয়ে আসে অথবা কমপ্লেক্সে পড়ে ভাবে, আমিও আসলে এরই মতন। আমিও কি আমার ভেতরে মায়ের ঐ মনটাই বহন
করছি না? করছি তো। তবে কি আমিও মা’র মত? আমি যে কার মত এটাই ভাবতে গেলে হোঁচট খাই। নটরডামের
এসমেরালডা তখন আমার বুকের ভেতর থেকে সেই তাচ্ছিল্যের রিনরিনে হাসিটি হেসে ওঠে যা
আমি নিজেও অজান্তেই ছুঁড়ে দিয়ে এসেছি এ যাবত দেখা আমার দু’চারজন প্রেমিকের দিকে। আমার কানের ভেতর এসমেরালডা তখনো
গুঁজে দিতে থাকে ওর মোহাচ্ছন্ন যাদুকরী কন্ঠের ওঠানামা, ফিসফিস। আর একটানা বলে যেতে থাকে; ‘নাউ ইউ লুক এট মি, ডু ইউ
থিঙ্ক আই এম ইভল?’
‘নাউ ইউ লুক এট মি, ডু ইউ
থিঙ্ক আই এম ইভল?’
‘নাউ ইউ লুক এট মি, ডু ইউ
থিঙ্ক আই এম ইভল?’.....................
আগে দেখা একটা কিশোর মুখ এইবার আমার আশেপাশে বেশ ঘুরঘুর করতে
লাগল। আমি বুঝতে পারছিলাম না এ আবার নতুন করে কি চায় আমার কাছে! আমি যে একটা মানুষ
খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত এই ছেলেটা বুঝি সেটা বুঝতে পেরেছিল। কিনতু ওর চাওয়া ছিল আরো
গভীরের কিছু। আমি সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। বুঝলাম যখন তখন বেশ দেরী হয়ে গেছে। ওর
দিকে তাকিয়েও আমি হাসতে চেয়েছিলাম তাচ্ছিল্যের হাসি। কিনতু শরীরময় ক্লান্তি থাকাতে
আমার হাসিটা ক্লিষ্ট হয়ে এল, অনেকটা ভাঙ্গাচোরা মানুষের মত।
কিংবা আমি নিজেও চাইছিলাম নিজেকে মুক্ত করতে। তাই বুঝি অনেকগুলো তারার মধ্য থেকে
আমার ভেতরকার একটা তারা অসতর্কাবস্থায় টুপ করে খসে পড়ল ওর পায়ের কাছে। আমি কিছু
বুঝে উঠবার আগেই কিশোর তারা নিয়ে ছুটে চলে যেতে লাগল মাঠ ঘাট ডিঙ্গিয়ে কোন দূরের
দিকে। আমি পিছু পিছু দৌঁড়ে গিয়ে ওর হাতটা চপে ধরে বললাম, ‘এভাবে না।‘
আমি আরেকটা তারাও ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘নিয়ে যাও। আমার অনেক আছে, আমি কক্ষণো
ফুরোব না।‘
ওর চোখ থেকে বেদনাগুলো ছিটকে
ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিতে লাগল আমার আমিকে। আমি আরো নিবিড় হলাম, আরো ঘণ হয়ে ওর মুখটা নিজের হৃৎপিন্ডে ঠেসে ধরে বললাম, ‘ঘ্রাণ পাচ্ছ ?’
এবার সে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আতরদান এখন দেখছি তোমার পুরোটাই
মাংসপোড়া গন্ধ। কিভাবে এতটা পুড়লে ?
আহা!’
আমাকে ক্রন্দনরত রেখে এক
কিশোরের প্রস্থান কোত্থেকে যেন আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাসের আলো বাতাসে ভরপুর করে
দিয়ে গেল।
এবার আমি নাক কুঁচকে এই বাতাসেই মন্টুর ফিরে আসবার ঘ্রাণ
পেলাম। মন্টুর ফিরে আসবার সময় হয়েছে। আমি চুলগুলো খুলে দিলাম যেন অনেকগুলো জটা
বেরোয় তিন চার দিক থেকে। সে যেন অবলীলায় উঠে আসতে পারে আবার আমার শোবার ঘরে।
এবার মন্টুর চোখ জোড়া খুঁজে বের করলাম দেরাজ থেকে। ওগুলো
বেরিয়েই মাছের মতন গোত্তা খেলো মাটিতে। আমি দেখলাম সামনেই নদী আর নদী থেকে হঠাৎ
ছলকে ওঠা মাছের ঝিলিক। আমি বুঝলাম, অপেক্ষার ফল পাকে ঠিকই কিনতু
অসময়ে। আমি বুঝলাম, অপেক্ষা মানেই অযথা কালক্ষেপণ।