গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

মাসুম বিল্লাহ

শাদা ভাতকয়েকটি আলু টুকরো এবং টেংরা মাছের ঝোল

চৈত্রের তাপে দরদর করে ঘামছে মানুষটা। আলগোছে কপালের ঘাম প্যান্টের পেছনে মুছল। আপন মনে  বিড়বিড়  করছে, এই গরমে  কাক পক্ষীরাও  কী  আমার  মতন  দরদর  কইরা ঘামে সঙ্গতই  জবাব মিলল না। কাজে মগ্ন পাশের সহকর্মীএকবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালআবার নিজ কাজে মন দিলো।  মাথার  উপরে  হেসে চলেছে সূর্য   ঘন্টার হিসেবে ঠিক মধ্য দুপুর।  কারখানার  ভেতরে  টিনের  একচালা  মসজিদের মাইক থেকে যোহরের আযানের সুর ভেসে আসছে কল্যাণের জন্যএসো... কান খাড়া হয় মানুষটির। চকিত ফিরে চায় পাশের সহকর্মীর পানেকিন্তু মুখে কিছু বলে না   আযান শেষে বিকটস্বরে  কারখানার  এ্যালার্ম যন্ত্রটি বেজে ওঠল   মধ্যাহ্নভোজের এ্যালার্ম   শ্রমিকদের  ছুটির সময়  হলে  দ্বিতীয়বারের   মতো এ্যালার্মটা আবার বেজে ওঠবে   কারখানার  প্রত্যেকটি  শ্রমিকের কাছে   এ্যালার্মটি  সুখের  ঘন্টার  মতো  মিশে গেছেঠিক স্কুলেরছুটি হওয়ার ঘন্টা পড়ার মতোই। এ্যালার্ম শুনে সবার মুখে হাসির রেখা দেখা যায়   তবে  একবার  এ্যালার্ম  শুনে  সকলের বুক ধক্  করে উঠেছিল  সেবার  ইলেক্ট্রিক  তারে আগুন লেগেছিল আর তেমন কিছু হয় নি।  সেদিনের সেই এ্যালার্ম বাজার কথা প্রায়  মনে  পড়ে  তার   ইদানিং  নতুন একটা  ভয়  জমতে  শুরু  করেছে  মানুষটার  মনেযে হারে  দালান  ভাইঙ্গা  মানুষ  মরতাছে, আল্লাগো অমুন বিপদের মইদ্যে কোনোদিন কারোরে ফালাইও না   তার  কারখানা  ভেঙ্গে পড়ার  সম্ভাবনা  নেই বললেই চলেইস্পাত    ভারি টিনের  দুইতলা  সমান  উঁচু ছাউনি   তবুও অচেনা  খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জন্য  তার  বুকের ভেতর অজানা ভয়  প্রতিনিয়ত দানা বাঁধছে
মধ্যাহ্নভোজের সময় শুরু হলো মানুষটার   ভেতরে  ভেতরে  তর সইছে না   আজ  মন  ছুটে গেছে আগে ভাগেই চোখের সামনে ভেসে  উঠছে  ফালি ফালি করে  কাটা আলু  টেংরা মাছের ঝোল সাথে এক থালা  শাদা ভাত    মুখগুহা  জলে ভরে ওঠে মানুষটারকল্পনার টেংরা  মাছের  ঝোল  সর্তকতার  সাথে  গিলে  নেয়  টুপ করে   আর দেরি নয় বেরিয়ে  পড়ে  পাখির নীড়ের মতো  ছোট্ট  বাসাটার  উদ্দেশ্যে   বড়  রাজপথটা পার হয়ে কিছুদূর হাঁটলেই তার ভাড়া বাসা   এক কামরার ঘর   দুই বছরের মেয়েকে  নিয়ে  স্বামী-স্ত্রীর আসবাবপত্রহীন সংসার। 
ভদ্রসমাজ যে  ঘরকে গোনায় ধরে না  কিন্তু মানুষটা বাসাটাকে নিয়ে বাবুই পাখির মতো বড়াই করে   রাত-বিরাতে  চাঁদের আলো ছোট্ট ঘরের জানালার ফাঁক গলে  উঁকিঝুকি মারে। মুগ্ধতা  ঘিরে ধরে মানুষটাকে  কিন্তু  রাতের খাওয়ার পর্ব শেষ হলে স্ত্রী আইরিন ব্যস্ত হয়ে পড়ে মশারী টানানোর জন্য   স্ত্রীর  আর কি দোষমশার  অত্যাচার নামী-দামী  কোনো  সন্ত্রাসীর চেয়ে কম নয়ঢাকা  শহরের  মশা  তাড়ানোর  দায়িত্বে  যিনি আছেন তিনি হয়তো নাক ঢেকে ঘুমাচ্ছেন। এই সুযোগে মশারা একটু বেয়াড়া হয়ে উঠেছে !
 মানুষটা  মশারী  টানাতে  নিষেধ করে  বউ আর একটু দেরি করোন যায় না স্বামীর  কথা  শুনে  খানিকটা  বিরক্ত  হয় মুহূর্তের জন্য  চোখে রাগ  পুষে বলে  যাইব না ক্যানযাইব।  স্ত্রীর কথা শুনে  মানুষটা ভেতরে  ভেতরে খুশি হয়যা স্ত্রীরও চোখ এড়ায়না   তারপর  সটান  বিছানায়  শরীর এলিয়ে  দেয় মানুষটা   পায়ের  উপর  পা  তুলে  দোলাতে থাকে   হাতদুটি  ভাঁজ  করা  থাকে মাথার নিচে   খোলা জানালার  ফাঁক গলে  চোখ  দুটি  নিবন্ধ গভীর রাত্রির আকাশে। আকাশে জ্যোৎস্নার সমুদ্র   মেঘের দল নাচছে যেনো   পূর্ণিমার  আলোয়  ভেসে যাচ্ছে বাতায়ন   বহু মানুষের  প্রেমিকারূপী  চাঁদ  একা  রাণী  হয়ে শাসন  করছে  পুরোআকাশ।  মানুষটা  একমনে  চাঁদের পানে  তাকিয়ে  আছে   রাত গভীর হচ্ছেমুগ্ধতার মাত্রা ছাড়াচ্ছে   রাতের  শরীরে  জ্যোৎস্নার চাদর   মানুষটার  শরীরে  মাখছে  জ্যোৎস্না   এসময়  নদীর বুকে  জেগে  ওঠা  চরের মতো  একটা  দুঃখবোধ  মানুষটার  মনেও জেগে ওঠে, সংসার চালাইতে বউয়ের কেমুন কষ্ট অয় সবই  বোঝে  মানুষটা।  যথারীতি  পাশের  বালিশে  স্বামীর শরীরের সাথে আষ্ঠেপিষ্ঠে  ঘুমজড়ানো চোখে  জেগে থাকে স্ত্রী   আঙ্গুলের  ঢগায়  স্বামীর মাথায়  বিলি কাটতে  কাটতে  মিহি গলায় জানতে চায়  আর কতো  সময় জাইগা থাকবেনঘুমাইবেন না নিশ্চুপ রাতের  করিডোর  ভেঙ্গে মানুষটা হু বলে স্ত্রীর দিকে  পাশ ফেরে  এবং  তাদের  মধ্যে আর  কোনো ভাষার  বিনিময় শোনা যায় না প্রতিদিনের  মতো  আজও  আপন মনে  রাজপথ  পার হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ  বিপরীত মুখ  থেকে  আসা  এক রিক্সার  সাথে মৃদু ধাক্কা খেয়ে পুরোপুরি হচকিয়ে গেল মানুষটা   নির্বাক  হয়ে  চোখ  তুলে  চাইল রিক্সাওয়ালার চোখে   স্পষ্ট  দেখতে  পেল-সে চোখে শিয়ালের  ধূর্ততা  খেলা করছে অথচ  কপাল  ঘামে ভেজা  মানুষটা