গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

অরবিন্দ দত্ত


মাতৃত্বের অহংকার

অলি আফিসে আমাকে ফোনে বলল,তিতির এখনো স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসো ফোনে খবরটা শোনা মাত্র  আমি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রায় ঝড়ের গতিতে বাইক চালিয়ে বাড়িতে পৌছালাম। জীবনে কোনদিন এতো জোরে বাইক চালাইনি।
তিতির আমাদের  একমাত্র মেয়ে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আমারই এক চেনাশোনা  রিক্সাওয়ালা গোবিন্দ ওকে নিয়মিত  স্কুলে পৌঁছে দেয়  আবার নিয়ে আসে ।  ইদানিং গোবিন্দর  সাথে তিতরের খুব  বন্ধুত্ব  হয়েছে । গোবিন্দ তিতিরকে খুব স্নেহ করে ও ভালবাসে,  সে তিতির কে ‘দিদিমণি’ বলে ডাকে। হাজারো  ঝড়- বৃষ্টিতেও গোবিন্দ তিতিরকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসে। আর তিতির,  সেও  তার গোবিন্দ কাকুর  রিক্সা ছাড়া অন্য কোন রিক্সায় স্কুলে যেতে চায়  না। প্রথম প্রথম অলি  গোবিন্দর রিক্সাতে তিতিরকে স্কুলে পৌঁছে দিত আবার নিয়ে আসতো । একদিন গোবিন্দই অলিকে বলেছিল, বৌদি আপনাকে  আসতে হবে না। আমিই ‘দিদিমণি’ কে  স্কুলে দিয়ে আসবো আবার নিয়ে আসবো।  অলি একা তিতিরকে গোবিন্দর  রিক্সায়  পাঠাতে চাইছিল না।  গোবিন্দ বুঝতে পেরে বলল,  ভাববেন না বৌদি, আমি দিদিমণিকে  ঠিক মতো নিয়ে যাব। আমারও দিদিমণির বয়সী একটা মেয়ে আছে। পরে একদিন আমি গোবিন্দর বাড়ীর ঠিকানাটা নিয়ে ওর  বাড়ীটা দেখে এসেছিলাম। এখন গোবিন্দ তিতিরকে  স্কুলে  নিয়ে যাওয়া-আসা ছাড়াও  আমাদের অন্যান্য  টুকটাক কাজকর্ম  মাঝে মধ্যে করে দেয়। ধীরে ধীরে ও আমাদের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। এমনিতে গোবিন্দ খুব কর্তব্যপরায়ণ
বাড়ীতে  ঢুকতেই অলি  কাঁদতে কাঁদতে বলল,  দেরী হচ্ছে দেখে আমি তিতির স্কুলে গিয়েছিলাম।  স্কুলের দারোয়ান বলল,  আপনাদের রিক্সাটা এসে আপনার মেয়েকে আধ ঘণ্টা আগে নিয়ে গেছে। এখনতো স্কুলে কেউই নেই । স্কুল অনেকক্ষণ আগেই ছুটি হয়ে  গেছে। তারপরই আমি তোমাকে ফোন  করি
একেতো তিতির কোন খবর নেই । তার উপর আলিও সমানে কেঁদে  চলছে । কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না । একবার মনে হল থানায় যাই। তারপরই  হটাৎ আমার গোবিন্দর বাড়ীর কথা মনে পড়ল। একবার অন্ততঃ গোবিন্দর বাড়ীতে গিয়ে দেখলে  হয়। ভাবছি সত্যিই কি গোবিন্দ আমাদের এতোবড়ো সর্বনাশ করবে! আমি তাড়াতাড়ি ড্রয়ার থেকে ডায়রি বের করে গোবিন্দর ঠিকানা লেখা পাতাটা ছিড়ে নিয়ে  পকেটে পুরলাম। অলিকে বললাম, আমি গোবিন্দর বাসায় যাচ্ছি । আমার কথা শুনে অলি বলল, ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাবো’। 
গোবিন্দ শহর থেকে কিছুটা দূরে এক বস্তিতে থাকে। প্রায় এক বছর আগে গোবিন্দর দেওয়া ঠিকানার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমি  গোবিন্দর বাড়ীতে এসেছিলাম।  বাড়ী বলতে দরমার বেড়া দেওয়া একটা  টিনের চালের ঘর। গোবিন্দ আমার সাথে ওর বউ এর পরিচয়  করিয়ে দিয়েছিল।  সেদিন  গোবিন্দর মেয়েটাকে দেখে ছিলাম। তিতির বয়সি হবে। দেখতেরবেশ সুন্দর । নাম জিজ্ঞেস করাতে মেয়েটি বলেছিল, পিউ দাস। বাবার নাম গোবিন্দ দাস। এইতো আট মাস আগে তিতির জন্মদিনে বউ-মেয়েকে নিয়ে গোবিন্দ আমার বাড়ীতে এসেছিল ।  গোবিন্দর মেয়ে পিউ  গুটি গুটি পায়ে  এগিয়ে এসে তিতিরে হাতে  একটা পুতুল দিয়ে বলেছিল,’এটা তোমার’।  অলি,  গোবিন্দকে ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘এটা কেন তুমি তিতির জন্য আনতে গেলে?’  উত্তরে গোবিন্দ বলেছিল, দিদিমণিতো আমার মেয়ের  মতোই। এটা তো সামান্য একটা পুতুল। এর চেয়ে বেশী কিছু দেবার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি না বলবেন না বৌদি। সেই গোবিন্দই কিনা  শেষে আমাদের  এমন বিপদে ফেলবে। আগে গোবিন্দকে হাতে পাই, তার পর .....। এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বস্তির বিভিন্ন গলি-গুপচি ঘুরে গোবিন্দর বাড়ীর গলির মুখে আসতেই দেখি, গোবিন্দ  ওর মেয়ে পিউ আর তিতিরকে রিক্সায় বসিয়ে গলি দিয়ে বেড়িয়ে আসছে। বাইকটা  থামাতেই  অলি বাইক থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে রিক্সায় বসে থাকা তিতিরকে কোলে তুলে  নিলো। আমাদের দেখে গোবিন্দ অবাক হয়ে গিয়েছিল। আমি বাইকটা  দাঁড় করিয়েই  ওর দিকে  ধেয়ে  গেলাম।  ইতিমধ্যে আমাদের চারপাশে বস্তির লোকজন জমতে শুরু করে দিয়েছে। আমি গোবিন্দর জামার কলারটা ধরে  জিজ্ঞেস করলাম, এটা তুই কেন করলি  গোবিন্দ ? কেন তুই তিতিরকে তোর বাড়ীতে নিয়ে এসেছিস ? তিতিরের জন্য আমাদের  দু’জনকে  আজ এক দুর্বিসহ মানসিক  দুশ্চিন্তার  মধ্যে কাটাতে হয়েছে । দেখলাম গোবিন্দর চোখদিয়ে জল পড়ছে। অলি বলল, ওকে মেরো না, ছেড়ে দাও। আমরা তিতিরকে পেয়ে গেছি।  আমি গোবিন্দর জামার কলারটা ছেড়ে দিলাম ।
হঠাৎ গোবিন্দ আমার পা  জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি  বাধ্যহয়েই দিদিমণিকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমার বৌ টা আজ মারা গেছে । কয়েক দিন থেকে জ্বরে ভুগছিল।  গতকাল রাত্রে জ্বর আরও বেড়ে যাওয়ায় আজ  ভোর বেলায় হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। স্কুল ছুটির পর দিদিমণিকে  নিয়ে আপনার বাড়ীর দিকেই যাচ্ছিলাম।  পথে  আমাদের  বস্তির একজনের  সাথে  দেখা হল। যাকে আমি হাসপাতালে রেখে  দিদিমণির স্কুলে এসেছিলাম। সে   বলল, ‘তোকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে। তোর  বৌ এর অবস্থা  খারাপ।‘ বিশ্বাস করুন, খবরটা শোনার পর আমার মাথার ঠিক ছিল না। আমি রিক্সা ঘুড়িয়ে সোজা হাসপাতালে যাই। গিয়ে দেখি সব শেষ। আমার বৌ আর নেই।  তার পর  দিদিমণিকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। ঠিক করলাম  দিদিমণিকে আগে ওর বাড়ীতে পৌঁছে দেবো । তারপর  মেয়েকে নিয়ে  হাসপাতালে যাব। দিদিমণিকে  নিয়ে  এখন আমি আপনদের বাড়ীর দিকেই যাচ্ছিলাম। 
ছিঃ এ আমি কি করলাম,যে মানুষটার এখন তার বউ-এর মৃত দেহের  কাছে থাকার কথা, সে কিনা আমার মেয়েকেই তো পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল আর আমি তাকেই  মারতে যাচ্ছিলাম।  অলি আমাকে না থামালে আমিতো গোবিন্দকে মেরেই দিতাম। আমি  গোবিন্দকে দু’হাত দিয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলাম। বললাম, আমাকে ক্ষমা করো গোবিন্দ । আমি বুঝতে পারিনি যে, তোমার এতোবড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে ।  পিউ বাবাকে কাঁদতে  দেখে সেও কাঁদতে লাগলো । অলিকে দেখলাম, তিতিরকে কোল থেকে নামিয়ে রিক্সায় বসা  পিউকে কোলে তুলে নিল। তারপর গোবিন্দর কাছে এসে বলল, আর দেরি কোর না গোবিন্দ। এবার  মেয়েকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাও । শেষবারের  মতো  ওকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি পকেট থেকে দুটো হাজার টাকার নোট বের করে গোবিন্দর হাতে দিয়ে বললাম, এই টাকাটা রাখো গোবিন্দ। সে কিছুতেই টাকাটা নিতে চাইছিল না। আমি জোর করে ওর  পকেটে টাকাটা গুজে দিয়ে বললাম , এখন আমরা যাচ্ছি । পরে আমার সাথে দেখা  করো ।
সেদিন আমি আর অলি, কেউই আমরা সারারাত ঘুমোতে পারি নি।  চোখ বন্ধ করলেই, চোখের সামনে গোবিন্দ আর ওর মেয়ের কান্না দেখতে পাচ্ছিলাম । ঠিক মতো আফিসের কাজেও মন বসাতে পারছিলাম না।
এর  দিন পনেরো পর  একদিন অফিসে  যাবার আগে অলি  আমাকে বলল, আজ তোমাকে একটা  সারপ্রাইজ দেবো। আমি বললাম সারপ্রাইজটা কি, জিজ্ঞাসা করলাম । অলি বলল, সেটা তুমি আফিস থেকে  ফিরে এসেই দেখতে   পাবে। যথারীতি আফিস থেকে ফিরে  ড্রয়িং রুমের সোফায় সবেমাত্র দেহটা এলিয়ে দিয়েছি, তিতির বাবা বলে দৌড়ে  এসে আমার কোলে বসল। সঙ্গে সঙ্গে  দেখি  গোবিন্দর মেয়ে পিউও দৌড়ে এসে আমার থেকে কিছুটা দূরে থমকে দাঁড়িয়ে  গেল। এই সময় এখানে পিউকে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম’।  কথাটা শুনে তাকিয়ে  দেখি অলি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে । অলি বলল, আমি আজ পিউ কে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছি । এখন থেকে ও আমাদের সাথে এখানেই থাকবে এবং তিতিরের সাথে স্কুলে যাবে। আসলে, এই কয়দিন আমি কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না।  চোঁখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই, পিউ মা-মা  করে কাঁদছে। তাই  ঠিক করলাম, পিউকে আমার কাছে এনে রাখবো।  ওকে আমি মানুষ করবো।  গোবিন্দও রাজি হয়েছে। তুমি  খুশী হয়েছো? আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কোন কথা বলতে পারলাম না। গত কয়েকদিন  থেকে যে কথাটা আমি মনে মনে ভাবছিলাম এবং যেটা অলিকে পর্যন্তবলতে পারিনি, সেটাই আজ অলি করে দেখিয়ে দিল। একেই বলে মায়ের মন। এটাই বুঝি মাতৃত্বের  অহংকার।  আজ আরও একবার  সেই অহংকার  জিতে গেল। এই অহংকার করা যে  অলির অধিকার। অলির মুখমণ্ডলে মাতৃত্বের এক নতুন আনন্দচ্ছটা লক্ষ্য করলাম।
আমি  পিউকেও  কোলে তুলে নিলাম। অজান্তে আমার দু’চোঁখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।তিতির আর পিউ দুজনেই তাদের  কোমলদুটো হাত দিয়ে আমার দু’ চোখের জল মুছে দিতে লাগল.....