গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সুধাংশু চক্রবর্তী


আতঙ্কের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে

এখন রাত দশটা । রাস্তার টিউব লাইটের আলোর নীচে অসংখ্য শ্যামাপোকা এসে জুটেছে । দুটো কুকুর, নিজেদের শরীরটাকে বৃত্তাকারে গুটিয়ে নিয়ে, মুখ গুঁজে পড়ে আছে লাইটপোস্টের নীচে ।  সহসা ছোট্ট একটা মারুতি ভ্যান, প্রায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো গলির ভিতরেই ছোট্ট একটা বাড়ির সামনে । বাড়িতে ঢোকানো হলো চিরঘুমে শায়িত বছর তিরিশেকের একটি যুবককে । কুকুরদুটো নিমেষেই বৃত্তাকার ভেঙে দ্রুত সরলরেখায় । পরক্ষণেই গলির বাতাস নড়েচড়ে বসলো এক বৃদ্ধা মায়ের সন্তান হারানোর বুক ভাঙা হাহাকারে । জেগে থাকা কিছু প্রতিবেশীর চোখেমুখে ফুটে উঠলো আতঙ্কের ছায়া ।

যে মহামারীর যাদুস্পর্শে বিশ্বের লাখো লাখো মানুষ লাগাতার যোগ দিয়ে চলেছে মৃত্যুর মিছিলে, সেই মহামারী যে এই যুবকটিকেও সামিল করে নিয়েছে ওই মৃতু মিছিলে । গোটাবিশ্ব জড়িয়ে গেছে আতঙ্কের বিছোনো জালে । মানুষ ঘরের বাইরে পা রাখার সাহস পাচ্ছে না । সকলেই আরও বেশী সতর্ক হয়েছে । একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে । মাসের পর মাস কলকারখানা, দোকানপাট, কাজকারবার বন্ধ হয়েছে মহামারীর শৃঙ্খল ভেঙে দেবার জন্য । সকলের মনে একই ভাবনা । আজ তবুও এক মুঠো জুটলো, কাল কি হবে ? ক্ষুধার তাড়নয় নিরুপায় হয়ে কেউ পথে নামলেই, বাধা পাচ্ছে প্রশাসনের তরফ থেকে । ঝোড়োবাতাসের মতো চতুর্দিকে ভেসে চলেছে একই কথা, ঘরে থাকো – ঘরে থাকো । না খেয়ে মরো, তবু ঘরে থাকো ।

সাময়িক অসুস্থ এবং গম্ভীর রোগে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে প্রায় সর্বত্রই চলছে ঠেলাঠেলির খেলা । সরকারী বেসরকারি হাসপাতাল কতৃপক্ষ রোগীদের কুকুরের মত দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে । চিকিৎসার অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে । সংবাদপত্র, সংবাদ চ্যানেল খুললে চোখের সামনে ভেসে উঠছে মৃত্যুর পরিসংখ্যান । জনসাধারণ মরছে, ডাক্তার মরছে, নার্স মরছে, পুলিস মরছে... এর মাঝেই মারামারি করেও মরছে কিছু রাজনৈতিক নেশাগ্রস্ত মানুষ ।

অজানা রোগের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য অনেক ডাক্তারই রোগী দেখা বন্ধ করেছেন । একবারও ভেবে দেখছেন না, যেসব মুমুর্ষ রোগী তাঁদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে, বিনা তত্ত্বাবধানে কিভাবে তাদের দিন কাটছে । অনেক নামী ডাক্তারই হোয়াটসঅ্যাপে রোগী দেখে, কিম্বা ফোনে অসুস্থতার বিবরণ শুনে ওষুধ লিখে দিচ্ছেন । কিন্তু তাতেও একটা নির্দেশ মেনে চলতে হচ্ছে রোগীদের । বর্ধিত ফিজের টাকাটা অনলাইনে পেমেন্ট করে ডাক্তারের ডেট নিতে হচ্ছে । এই মারণ রোগকে তেমন করে চিনে উঠতে না পারলেও, অনেক শহরেই বেশ কিছু উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতালে, আক্রান্ত রোগীদের পরিষেবা প্রদান করা হচ্ছে আকাশ ছোঁয়া আর্থিক প্যাকেজের বিনিময়ে । যে-রোগের প্রতিষেধক আজও আবিষ্কৃত হয়নি, আকাশচুম্বী আর্থিক প্যাকেজের বিনিময়ে সেই রোগের পরিষেবা কিভাবে দেওয়া হচ্ছে, কে জানে ?    
উদ্ভব স্যান্যাল টিভির সামনে বসে এতশত ভাবনায় ডুবে থাকলেও, ঠিক শুনতে পেলেন সন্তানহারা বৃদ্ধার করুণ হাহাকার । দ্রুত জানালায় এসে দেখেন, গলির ভিতর কিছু কৌতূহলী মানুষ নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে বাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে । বৃদ্ধার হাহাকারের সঙ্গে যুক্ত হলো আরও কিছু গলা । উদ্বিগ্ন হয়ে সরে এলেন জানালা থেকে । বৃদ্ধা মাকে সদ্য ঘুম পাড়িয়েছেন ঘুমের ওষুধ দিয়ে । বাবা মারা যাবার পর থেকে, মা’কে রোজই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হচ্ছে । একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলেন মা ঘুমোচ্ছেন । 
উদ্ভব স্যান্যালের রাতের ঘুম উবে গেছে । সন্তানহারা বৃদ্ধার বুকভাঙা হাহাকার শোনার পর থেকে, সেদিনের সেই ভয়াবহ মুহূর্তগুলো যে, ভেসে উঠেছে তাঁর চোখের সামনে । শহরের সর্বত্র যখন অদ্ভুত একটা আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে, তখনই বাবার কিডনির সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায় । তারসাথে যুক্ত হয়েছিলো সর্দিকাশি । বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডেকে এনে, তিনি যখন প্রেসক্রিপশন এবং টেস্ট রিপোর্টগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন, মা তখনই কেন যে নিজেই অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে গেছিলেন বাবাকে । মায়ের হাত ফসকে পড়ে গিয়ে, মাথায় গুরুতর চোট পেয়েছিলেন বাবা । সেসব দেখেও প্রতিবেশীদের কেউই এসে সাহায্য করেননি মাকে ! এমনকি এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারটিও না ! 
দু’চারজন মিলে ধরেকরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতো যদি, সেদিন বাবাকে হয়তো বেঘোরে প্রাণ হারাতে হতো না । ওরা আতঙ্কিত হয়েছিলো এই ভেবে যে, বাবা নিশ্চয়ই সংক্রামিত হয়েছেন সেই অপ্রতিরোধ্য মহামারীতে । বাবাকে না ছুঁয়ে তারা যেন নিস্কৃতি পেয়েছেন মারণ রোগে সংক্রমণের হাত থেকে । বৃদ্ধা মা যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, পথচারীরা উদাস চোখে মৃত বাবার পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে, নিশ্চয়ই মনে মনে হিসেব কষেছিলেন, এই বৃদ্ধকে নিয়ে মৃতের তালিকায় আরও একটা সংখ্যা যুক্ত হলো ।

সহসা উদ্ভব স্যান্যাল অনুভব করলেন, তিনি কিছুতেই প্রতিবেশীদের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়তে পারছেন না ! কেন পারছেন না ? তাহলে কি বাবার মৃত্যুর জন্য অন্য কেউ দায়ী ? ভেবে ভেবে প্রশ্নের সমাধানও খুঁজে পেলেন । বাবার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী হলো ওই আতঙ্ক । যে-আতঙ্কের সাগরে প্রতিনয়ত ঢেউ তুলে চলেছে সংবাদমাধ্যমগুলি এবং বেশ কিছু স্বার্থলোভী মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সেই আতঙ্কের ঢেউই আজ বিশ্বব্যাপী মানবকুলকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে মানবিকতার সীমানার বাইরে ।

আরও একটা ব্যাপার অনুভব করলেন তিনি । সেদিন বেঘোরে মারা গেলেও, এই অসামাজিক পরিস্থিতিতে অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করার হাত থেকে অন্তত নিষ্কৃতি পেয়েছেন বাবা । তিনি হয়তো অলক্ষ্যে বসে মনেমনে বলছেন, ‘ঘেন্না করি এই সমাজকে । এখানে মুমুর্ষ রোগীদের বিপদের মুখে পড়ে থাকতে দেখেও চিকিৎসকেরা হাত গুটিয়ে নেন । জীবনদায়ী ওষুধ নিয়ে, খাদ্যবস্তু নিয়ে চলে কাড়াকাড়ি এবং কালোবাজারি । আমি অন্তত নিষ্কৃতি পেলাম এদের হাত থেকে । কি লাভ হতো যদি অ্যাম্বুলেন্স থেকে পড়ে না গিয়ে, অসুস্থ শরীরে বিছানায় পড়ে থেকে, বিনা চিকিৎসায় বুকভরা বাতাসের জন্য হাহাকার করতে করতে আরও কিছুকাল আমাকে বেঁচে থাকতে হতো ?’ 

ভাবনার হাত থেকে  নিষ্কৃতি পাবার জন্য, উদ্ভব স্যান্যাল হাতে তুলে নিলেন আজকের সংবাদপত্রটা । সকালে তেমন করে পড়ার সময় পাননি । প্রথম পাতায় চোখ বুলোতে বুলোতে, এক জায়গায় এসে মানুষের পাশবিক আচরণের বিবরণ পড়ে, ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে ফেললেন । ‘কেভিড আক্রান্তকে সাহায্যের খেসারত দিতে হলো এক হৃদয়বান ব্যক্তিকে । সেই ব্যাক্তিটি নাকি সুস্থ হয়ে ফিরে এসে হাসপাতালের অব্যবস্থার জন্য দায়ী করে ভাঙচুর চালিয়েছেন হৃদয়বান ব্যক্তিটির বাড়িতে !

সংবাদপত্র সরিয়ে রেখে, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন উদ্ভব স্যান্যাল । এই মুহূর্তে তিনি খুব চাইছেন, অহেতুক এই আতঙ্কের সাগরতীরে পড়ে না থেকে, এখুনি বাবার কাছে চলে গিয়ে, তাঁরই মতো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন । পরক্ষণেই মায়ের কথা মনে পড়ায়, দ্রুত উঠে এলেন মায়ের ঘরে । ঘুমোচ্ছেন না জেগে গেছেন, এখুনি একবার দেখে নেওয়া দরকার ।
**