গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দীপলেখা মুখার্জি

 লক্ষীবাই
 ঘটনা ১
প্রচণ্ড ব্যস্ত লেবার রুম, রাত প্রায় ১টা। তিনজন ডাক্তার,দুজন ইন্টার্ন হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। পরপর পৃথিবীর আলো দেখচ্ছে, দেবশিশুরা।তাদের অস্তিত্বের জনান দিয়ে প্রথম চিৎকারে লেবার রুম মুখরিত। ৭টা ডেলিভারি বেড ফাঁকা নেই একটাও। আগে প্রায়ই বাচ্চা পাল্টানোর অভিযোগ করতো হাসপাতালের রুগীর দল। অদ্ভুতভাবে সবাই বলত, সে পুত্র সন্তান প্রসব করেছিল, কিন্তু তাকে কন্যা সন্তান দেওয়া হয়েছে। এই ঝামেলার হাত থেকে বাঁচতে, সরকারি হাস্পাতালে নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে, বাচ্চার এমবিরিলিকাল কর্ড বা নাড়ী কাটার আগে মা নিজে আইডেন্টিটি নোট দেবে," আমি, একটা জীবিত পুত্র বা কন্যা সন্তান প্রসব করলাম।" 
ডাক্তার তমালি, খুব নিম্নমধ্যবিত্ত সাজিদা বানুর প্রসবের পর দেখল, বাচ্চাটি কাঁদল না, প্রোটকল অনুযায়ী বাচ্চাটির পিঠে আস্তে করে চাপড় দিল সে, "তবু কাঁদল না। স্যার বাচ্চা কাঁদছে না!" সিনিয়ার ডাক্তার অতনুদা এগিয়ে এসে বলল, "আইডেন্টিটি করিয়ে, মুখ হা করিয়ে আস্তে আস্তে ফুঃ দে। বিট(হার্ট) চলে আসবে।"
আইডেন্টিটির জন্য তাড়াতাড়ি বাচ্চার সদ্য হওয়া মা কে তমালি জিজ্ঞেস করল, "বলো তোমার ছেলে না মেয়ে হয়েছে?"মা চুপ। তমালি তাড়া দিল, "দিদি তুমি তাড়াতাড়ি বলো, ছেলে না মেয়ে? কি জন্ম দিলে? কুইক, বাচ্চাকে না হলে বাঁচানো যাবে না।" মা তবু চুপ। ডাক্তার আতনু এসে জোরে সাজিদাবানু ঝাঁকিয়ে কে বলল, "কি হল, চুপ করে আছো কেন?" পাশের বেডের রুগি বলল, "মেয়ে হয়েছে তাই বলছে না।" সাজেদাবানু বলল, "মরে যাক, গুনিন বলেছিল,এবার আমার ছেলেই হবে, আমি এবারও মেয়ে নিয়ে ঢুকলে, আমায় তাড়িয়ে দেবে বাড়ির লোক।" "পোড় খাওয়া ডাক্তার অতনু ততক্ষণে জোর করে, ' আমার একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে' বয়ানে লিখে, আংগুলের ছাপ নিয়ে নিয়েছে। বাচ্চাটিকে মায়ের থেকে আলাদা করে, তমালি মুখে ফুঃ দিতে দিতে বলল, কোনদিন এই মা কে মাপ করবি না। তোর বাঁচাটা জরুরী। কেঁদে ওঠ আমার লক্ষীবাই,কেঁদে ওঠ্। ভোর ৩.৫৫, মা আর বাচ্চা দুজনেই একসাথে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
ঘটনা ২
ঝকঝকে ইঞ্জিনিয়ার ৩২ বছরের অর্ক ও অর্কের মা উদ্বেগ মুখে নিয়ে বসে আছে এম্বুলেন্সে।সামনে শুয়ে আছে অর্কের স্ত্রী বছর ২৬এর পারমিতা। সে নিজেও সফটওয়্যারে কাজ করে। প্রসব যন্ত্রনায় ছটফট করছে সে। ঘনঘন আইফোনে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করছে অর্ক। এখনো আধ ঘন্টার পথ বাকি। ডাক্তার অভয় দিচ্ছেন। মিস্টার রায়, "এটা একদম ন্যাচারাল পদ্ধতি, ভয় পাবেন না। প্রসব হয়ে গেলেও বাচ্চা বা মায়ের কিচ্ছু হবে না। কালই তো চেকয়াপ করলাম, সব এবসুলুটলি রাইট আছে।ডোন্ট প্যানিক"। হাসপাতাল অবধি যাওয়া হলনা, পারমিতা রাস্তায় একটি ফুটফুটে সন্তান প্রসব করল। 
ডাক্তার ফোনে বলেন, "বাচ্চা কেঁদেছে?" 
অর্ক" না "। 
"বাচ্চাটিকে পিঠে আলতো করে চাপড় দিন,এই স্টিমুলেশনটা লাগে।ভয় পাবেন না।"
অর্কের মা, হাতটা চেপে ধরল, চাপা গলায় বলল, "মেয়ে।"
পারমিতার দিকে তাকাতেই, সে বলল," যা তুমি ভাল বোঝো। "
"ডাক্তারবাবু পিঠ চাপড়ালাম, তবু কাঁদছে না। " অর্ক ফোন কেটে দিল। 
ডাক্তার অতনু ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছেন। 
আর শুনছেন ‘দিস নাম্বার ইস নট রিচেবল’ ।