মঙ্গলসূত্র
নাহ্! এবারেও হল না...,দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল মানসী।
বেশ কিছুক্ষণ শরীরটাকে ওইভাবেই ছেড়ে রাখল। আবার হুট করে কী ভেবে মোবাইলের ক্যালেণ্ডারে
বুঁদ হয়ে, দাঁতে ঠোঁটের কোণাটা চেপে হিসাব কষতে কষতে বিড়বিড়াল, ইস!এক মাস সাত দিন মাত্র...
খবরটা যদি কাল রাতের জায়গায় আরেকটু আগে জানাত, বাপন! জানতই যখন বিয়েটা করবে! ইনস্টলমেন্টটা
শেষ না হলে জিনিষটা হাতে দেবে না যে! আকাশ-পাতাল ভেবে অয়নের কাছে গেল গুটিগুটি পায়ে।
আশায় বুক বেঁধে। আর বলতে গিয়েই শুনল ভ্রু কুঁচকে অয়নের সেই ঘ্যানর ঘ্যানর─ আরে, আদ্যেখলাপনা
গুলো ছাড় তো! এই বুড়ি বয়সে আর মানাবে না...মানসীর চটপট প্রত্তুতর─ চল্লিশে আজকাল বিয়ে করছে আর আমি বুড়ি! টোটনের স্কুল গণ্ডি
এই তো সবে পার হল। গলায় আরেকটু সুর চড়িয়ে বির্তকিতে জবাব দিল─এই নিয়ে অনেকগুলো বিয়ের অনুষ্ঠান পার করলে এবারেও ভাসুরপো’র বিয়েটাও
ওই ভাবেই পার করবে? আসল কথাটা বল!
বিয়ে বাড়ি আসলেই মানসীর এই শখটা মাথায় ব্রহ্মদত্যির মত মাথায় চেপে বসে,
তারপরই আবার উধাও হয়ে যায়। গয়নার উপর যে তার বিশেষ লোভ আছে তা নয়! কিন্তু মঙ্গলসূত্রের
উপর তার বিশেষ আকর্ষণ। কেন নিজেও বুঝতে পারে না। কালো কালো পুঁতির সঙ্গে অপূর্ব মিশ্রন
যেন গোল্ডেন বলগুলোর! আর তার সঙ্গে আমেরিকাকান ডাইমণ্ডের ছোট্ট ফ্যান্সি লকেট! তার
অদ্ভূত ভাল লাগা!
সাউথের দিকে বেশ কিছু বছর বসবাসের সুবাদে তাদের এই মঙ্গলসূত্রগুলির
হরেক রীতিনীতির গল্পও শুনেছে মানসী। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশে এইগুলিকে বলে পুস্তেলু। তাতে
দুটো চাকতি থাকে। একটি বর পক্ষের, অন্যটি কন্যাপক্ষের। হলুদ সুতো অথবা সোনার চেন দিয়ে
পাকান। কালো ও প্রবালের পুঁতি দিয়ে করা থাকে আলাদা। আবার বিভিন্ন
জায়গা্য এদের ভিন্ন নামও। সেগুলি দেখতেও একটি অপরটির চেয়ে আলাদা। যেমন কর্ণাটকে পরিচিত
‘কর্থমনি’, ‘পথক’ নামে।আবার কেরালাতে হিন্দুরা একে বলে ‘থালি’ আর খ্রিষ্টানরা বলে
‘মিন্নু’। তবে মঙ্গলসূত্র সাধারণত বিবাহিত মহিলারা বিয়ের পবিত্রতার প্রতীক স্বরূপ ধারণ
করে।
মানসীর বিয়ের আগের থেকেই এই মালাগুলি খুব ভাল লাগত। নিজেরাই মন্দিরে
বিয়ে সেরে ফেলায় বিয়েতে যৌতুক কিম্বা উপহারে যে পেতে পারত সেই পথটাও নিজেই বন্ধ করেছে।
বিয়ের পর যখন মানসী, তার মেজো জা’কণিকার ফ্যান্সি ডিজাইনের মঙ্গলসূত্রগুলো গোপনে দেখে
নিত সুযোগ পেলেই। কণিকারা চলে যাবার পর অয়নকে জানিয়েছে, অনেকবার। কিন্তু লাভ হয় নি।
বরং তার উল্টে হিসেবী জবাব,
─ টাকাটা ব্যাংকে রাখলে কাজ দেবে। মেজদার ব্যাপার আলাদা।
আমি সরকারী ক্লার্ক। মাস গেলে কত আর পাই!
সংসারে স্বামীর দায়-দায়িত্ব, অনীহা বুঝে বেচারা হাউসওয়াইপ মানসীর চুপ
করা ছাড়া কি-বা করার থাকে! তার উপর নিজের অল্পহাত খরচের টাকাটাও জমিয়ে না রাখার বদ
অভ্যাসো আছে। যদিও নিজের শখের পিছনে এক পয়সাও খরচ করে না।সর্বভুক সংসারের পেটেই ঢুকে
যায়।
বিয়ের পর থেকে শখটা ক্রমশ বিস্তারলাভ করেই চলেছে। আজ তার খুব অভিমানও
হচ্ছে! এমন বিশেষ কিছু চাহিদা না যে, অয়নের সাধ্যের বাইরে! এবারে সে হাল না ছেড়ে একটা
হেস্তনেস্তে রফা করেই ছাড়ল বেচারা অয়্নের কাছ থেকে! নিজেকে মনে বাহবাও দিল বেশ কয়েকবার।
তারপর কোনদিকে না থাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করে সোজা অঞ্জলী জুয়েলার্সে। নেড়েচেড়ে দেখলও খান
কতক। পছন্দ-ও হল। কিন্তু বিল মেটানোর আগে সোজা দোকান থেকে পাণ্ডুর মুখে বেরিয়ে এল।
এরকম অয়নের সঙ্গে গিয়েও অনেকবার-ই করেছে।তারপর দুজনের গুস্ সা গুস্ সি বাড়ি ফিরে। আজও
বেমক্কা তার মনে হল থাক আর কিনবে না। আর ক-বার-ই বা পরব! এতগুলো টাকা! সোনার দাম ত
এখন মধ্যবিত্তের আকাশ ছোঁয়া! টাকাটা টোটনের লেখাপড়ায় লাগতে পারে!
অয়নকে বাড়িতে এসে টাকার থোকটা নর্মালভাবেই ফেরত দিতেই অয়নের চক্ষু চড়ক
গাছ! এত দিনের শখ! হাতে পেয়েও নিল না! রাগ দেখিয়ে নিজেই বাজার গেল! বিস্মিত গলায় জানতে
চাইল─ আজ
আবার কি হল? আমি ম্যানেজ করে দিলাম কিনবার জন্যই তো! অসুবিধা নে-ই বল্লামও! কিন্তু
তার মনে ইতিউতি সন্দেহরা খোঁচা দিতে লাগল। কিছু একটা কারণসূত্র সন্ধান করতে লাগল অয়ন
মনের ভেতরে।
মানসী মাঝরাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে ভাগ্যিস মোহের বশে কিনে ফেলে নি! মুখে
যাই বলুক, অয়নের মুখটা বেশ হাল্কা দেখাচ্ছিল!ইস! অনেক চাপই রাগ করে দিয়ে ফেলেছিলাম!
এই তো পুরো বাড়ি রঙ হল! দুর্গাপুজো যেতে না যেতেই আবার বিয়েবাড়ি। ওর উপরেই ত এত বড়
সংসারের দায়িত্ব! আমার আর গয়নার সামান্য শখে কাজ নেই!
মানসী সিলিং ফ্যানটার ঘোরার দিকে আনমনা চোখে চেয়ে ভাবতে থাকল অনেক মহিলাই
তো তাদের কালো-গোল্ডেন ইচ্ছের পুঁতিগুলিকে গেঁথেই চলে সংসারর মঙ্গল সুতোয়। একটা ইমিটেশানের
চেন-ও জুটে না তাদের অভাগা কপালে। আমরা তাদের ক’জনকেইবা চিনি! নীরবে গেঁথে যাওয়াই তাদের
একমাত্র পবিত্র কাজ।
©বর্ণালি বিশী (২৮/৮/২০)