রাত
দশটার নির্জনতাকে ফেঁড়ে দিয়ে অতর্কিতে উঠে এলো বোমা আর গুলির শব্দ। ধোঁয়া আর
বারুদের গন্ধে ভরে রইলো মানুষের চিৎকার। আক্রমণকারীরা নিঃশব্দেই অন্ধকারে মিলিয়ে
গেল। কয়েক
মিনিটের মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ আর ধোঁয়ার কুয়াশা কেটে যেতেই অন্ধকারের অন্তরাল থেকে
বেরিয়ে এলো দুটো মূর্তি। তারা সন্তর্পণে এসে দাঁড়ালো স্পটটায়। সেখানে শান্তি দাস
ওরফে কানা শানু প্রচন্ড আহত। জামা প্যান্ট রক্তে রক্তময়। কোন নড়ন চড়ন নেই, যেন একটা লাশ পড়ে আছে। ওদেরই
একজন কোমরের ভোজালিটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিতে নিতে বললো, ‘শালারা পালিয়েছে! শানুদাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। একদম দেরী করা চলবে না!’ অন্যজন
শানুর ক্ষতে রুমাল দিয়ে বাঁধন দিতে দিতে বললো, ‘এম এল এ-র পোষা চামচা
শালা পানু সাহাও ওই দলটায় ছিল। ঠিক চিনতে পেরেছি।’
বিরোধী
পক্ষের আক্রমণের ব্যাপারটা এতই অতর্কিত ছিল যে সাথের লোকদুজন তখনো ধাতস্ত হতে পারে নি। ভীত ভাবে লোক দু’জন এদিক ওদিক
দেখতে লাগলো, যেন আবার যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ নেমে আসতে
পারে। শান্তি দাসের পড়ে থাকা লাশটা কেঁপে উঠলো; একটা মৃদু
গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। কিছুক্ষণের
মধ্যেই আরো কয়েকজন মানুষ জড়ো হলো। কিন্তু তারা কেউই কানা শানু বিষয়ক এই রাজনৈতিক
ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে চাইলো না। আধা ঘন্টার মধ্যেই এদিক ওদিক খবর চলে গেল – কানা শানুর লাশ পড়েছে। শানুকে
নিয়ে যাওয়া হলো কাছেই জেলা হাসপাতালে। তারপর সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে শহরের বড়ো হাসপাতালে। মাথাতে রক্তক্ষরণের জন্যে
শানুর অবস্থা আশঙ্কাজনক! কিছুক্ষণ
আগে রক্তারক্তি হয়ে গেল যে অঞ্চলে, সেটা একটা মফস্বল শহর। এখানে মানুষের দিন
যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে – চাষবাস, বাজারের
দোকানপাট, কিছু চাকুরে মানুষদের লোকাল ট্রেনে চলাচল।
স্থানীয় একটা রুগ্ন কটন-মিল আছে। পাশের শহরে কয়েকটা চালু
কল-কারখানা। আর আছে একটা বিশেষ রাজনৈতিক পার্টির
কর্তৃত্ব।
একটা রাজনৈতিক পার্টির মধ্যেই আবার দলাদলি, দুটো ফ্রাকশন। এই অঞ্চলে পার্টির
দুই উল্লেখযোগ্য নেতা । একজন হচ্ছে শান্তি দাস ওরফে কানা শানু। অন্যজন হচ্ছে
প্রাণকৃষ্ণ সাহা ওরফে পানু। লোকেরা অনেকেই জানে, কানা
শানু হচ্ছে পার্টির জেলা সম্পাদকের পোষা গুন্ডা! পানু
হচ্ছে স্থানীয় এম এল এ মহাশয়ের নির্ভরযোগ্য তাঁবেদার। এই দুই নেতার মধ্যে আবার
দলাদলি, তাই নিয়ে টেনশন।
এই
মফস্বল শহরের সাধারণ মানুষজন কর্মব্যস্ততায় মিশে থাকে, সকালে বাজার যায়। অল্প কিছু লোক
চাকরি বাকরি করে। কিছু লোক জুট মিল, পাশের শহরে কল
কারখানায় কাজ করে। বেশীর ভাগ মানুষজনই জীবিকার জন্যে দিনে কোন না কোন মেহনতের কাজ,
ব্যবসাপাতি, এটা সেটা ধান্ধা করে।
সন্ধ্যেতে চায়ের দোকানে লোকজন আড্ডা দেয়। যারা বেকার তারা রাস্তার মোড়ে চট খাটিয়ে
তাস পেটে, টিটকারি দেয়, ঝগড়া করে
আর চ্যাঁচায়। আপাতত এমন একটা অঞ্চলে উত্তেজনার চোরাস্রোত বইছে।
রাত
কাটতেই পরদিন সকালে খবরটা এই অঞ্চলে আরো ব্যপক প্রচার পেল। কানা শানুর উপর ওদেরই
পার্টির পানু সাহার লোকেরা কল্যান সংঘের মাঠে রাতের বেলা ভয়ংকর হামলা চালিয়েছে।
লোকটা মনে হচ্ছে বাঁচবে না! ওদিকে কমরেড শান্তি দাস ওরফে কানা শানু তখন শহরের হাসপাতালে মৃত্যুর
সাথে লড়ছে।
এর পরের
দিনগুলোয় হাসপাতালের বারান্দায় শান্তি দাসের সমর্থকদের অস্থায়ী অফিস ও অনুসন্ধান
কেন্দ্র বসলো। জেলা কমিটির যে ফ্রাকশনটা জেলা পার্টি-সম্পাদকের অনুগামী ও নেতা কানা
শানুর পক্ষে, তাদের উদ্যোগে বেরোলো মিছিল। শানুর এরিয়াতে
চললো হামলার প্রতিবাদ।
শানুর
অপারেশনে রক্তদানের জন্যে ভলান্টিয়ারের লম্বা লিস্ট তৈরী হলো। হাসপাতালে সব সময়ে
উপস্থিত থাকবার জন্যে কিছু জঙ্গী ক্যাডারদের নিয়ে শিফট-কোটা তৈরী হলো। এতো দিন কোথায় যে
কানা শানুর ফ্রাকশনের এতো পার্টি সমর্থক ছিল, তা বোঝা গেল
না।
ক্রমশঃ
এলাকায় একটা পার্টির আভ্যন্তরীন বিরোধ চাপা উত্তেজনার জন্ম দিল। দুটো গ্রুপের
ভেতরকার এই উত্তেজনা ক্রমশঃ আরো বেশী সংঘর্ষের দিকে এগোলো। সন্ধ্যা হতে না হতেই
বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পাড়ার রাস্তাঘাট শুনশান্ থাকে। পুলিশের ভ্যান ঘন ঘন রাস্তায়
রাস্তায় টহল দেয়।
শানু
আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মাথায় কমরেড প্রাণকৃষ্ণ সাহার বাড়ী আক্রান্ত হলো। পানু
সাহাকে ঘরে পাওয়া না। তার বাড়িঘর লন্ড ভন্ড হলো। ঘটনাটা আরো তীব্র আকার নিল।
পার্টির
ম্যানিফেস্টোতে আছে ক্লাস-স্ট্রাগল, শ্রেণী-যুদ্ধ।
তারই পরিনতি কি এমন হানাহানি? বদলা চাই! পরের
দিন গভীর রাতে প্রাণকৃষ্ণ সাহা-র পার্টি ফ্রাকশনের
অনুগামীরা তাদের সংগ্রাম তীব্র করলো। পানুর দল বদলা নিল শানুদের উপর। বোমা ফাটাতে
গিয়ে পুঁচকির ডান হাতটা জখম হলো।
কে বা কারা
ভৈরব পালের মেয়ের ইজ্জতে হাত দিল। পাড়ার লোকেরা কেউ ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলো না। বিধবা
মেয়েটার চোখে পড়লো রাস্তার পাশে নির্জন মাঠের উপর একটা বিধ্বস্ত চাঁদ আর কিছু
রক্তের ফোঁটা!
কয়েকটা
দিন মফস্বল শহরটা রোগগ্রস্তের উন্মাদনায় দাপাতে লাগলো। বাজারটায় বসলো পুলিশের ক্যাম্প।
শানু-পানু আর ভৈরব
পালের মেয়ের খবর নামী দৈনিকে বেশ ফলাউ করে ছাড়া হলো। স্থানীয় জুট মিলের
ক্যান্টিনেও আলোচনার বিষয়বস্তু হলো এলাকার গুন্ডারাজ, ভৈরব
পালের মেয়ে আর শানু-পানু বৃত্তান্ত।
একদিন
তিনটে পুলিশ ভ্যান এসে এলাকার পার্কের পাশে থামলো। বিকেলের পার্কে শিশু ও কিশোরেরা
হৈ চৈ করছিল। তখন শীতের সূর্য ডুবুডুবু। পুলিশ পার্কের এদিক সেদিকে তল্লাসী চালালো, যেন এই পার্কের কোথাও গোপন কিছু
লুকানো আছে। পুলিশ কোন কিছু খুঁজে না পেয়ে উপস্থিত বাচ্চাগুলোকে একে একে জেরা
করলো। অমুকে কোথায় থাকে, তমুককে দেখেছে কিনা? জেরার হাত থেকে শিশুরাও বাদ পড়লো না। শিশুরা ঘরে ফিরলো ভয়ে কাঁদতে
কাঁদতে। কিশোরেরা ফিরলো গালাগালি আর কিছু অশ্লীল প্রশ্নের মানে কি হয়, তা বুঝতে না পারার অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে। যে সব কিশোরেরা একটু লম্বা
চওড়া, তাদের কারো কারো পোঁদে লেগে রইলো পুলিশের লাঠির
স্মৃতি।
এলাকা গিজ্ গিজ্ করছে
পুলিশে। সেদিন রাতেই পানু সাহাকে সশস্ত্র অবস্থায় গ্রেপ্তার করে লক আপে পোরা হলো। চারপাশটা
এতো আতঙ্কময় হয়ে উঠলো, সে বছর পাড়ায় কোন সরস্বতী পূজা হলো না। পার্টির জেলা কমিটির সম্পাদক
সোচ্চার হলো। পার্টিতে তার একান্ত অনুগামী কমরেড শানু। সম্পাদক মশায় এই প্রাণঘাতী
হামলার তীব্র নিন্দা করলো। তার নির্দেশে তদন্তের জন্যে কিছু লোককে নিয়ে একটা
নাগরিক কমিটি গঠিত হলো। এই নাগরিক কমিটিতে শানুর কিছু সমর্থকও ছিল। পার্টির এম এল
এ মহাশয় এক বিবৃতি দিয়ে জানালো, এই নাগরিক কমিটির লোকেরা
সমাজবিরোধী আর জেলা-সম্পাদকের ধামাধরা। তাই নাগরিক কমিটির
এই তদন্ত অবৈধ ও পক্ষপাত-পূর্ণ ।
অন্য
দিকে কানা শানুর স্বপক্ষে নাগরিক কমিটির কিছু লোকজন বাজারে স্ট্রীট কর্ণারের আয়োজন
করলো। তাতে পার্টির একটা গুটের কয়েকজন নেতাও হাজির ছিল। তারা সাধারণ মানুষকে
আহ্বান জানালো, সবাই
যেন শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখে। সেই স্ট্রীট কর্ণারে একজন মহিলা মাউথ পীসের
সামনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইলো – ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা
আমাদের এই বসুন্ধরা …… সকল দেশের সেরা! স্ট্রীট কর্ণার ভেঙে যেতেই জটলায় জড়ো হওয়া মানুষজন যে যার ঘরে ফিরে
গেল। এতো করেও এ সমাবেশ দিনের শীতার্ত হাওয়ায় তেমন কিছু উত্তাপ যোগ করতে পারলো না।
অথচ বাম
জামানার সেই দিনগুলোয় খবর কাগজে রিপোর্ট বের হলো, এক বন্ধ জুটমিলের শ্রমিক উন্মাদ হয়ে তার স্ত্রী
আর দুই শিশু সন্তানকে খুন করেছে। অনেকগুলো কল কারখানা বন্ধ! সেসময়ে জনৈক তরুন নির্দেশক শহরের থিয়েটারে মঞ্চস্থ করলো ‘দুঃস্বপ্নের গ্রাম’ নাটক। পরবর্তী ইলেকশনে
পার্টি তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করলো, সিদ্ধান্ত
নিল – বর্তমান এম এল এ’কে ভোটে
লড়বার টিকিট দেয়া হবে না। রাজ্যস্তরের সভায় এও আলোচিত হলো, আগামী ইলেকশনে পার্টির সবগুলো সীট কি ভাবে ধরে রাখা যায়। এই
মফস্বল শহরে মানুষজন তাদের দিনানুদিনের সমস্যার চাপে অনেক কিছু ভুলে গেল। তবুও
তাদের মধ্যে একটা চাপা উদ্বেগ। কখন আবার নতুন করে খুনোখুনি শুরু হয়ে যায়! ওদিকে
ভালো হাসপাতালে ডাক্তারদের অসামান্য তৎপরতায় কানা শানু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে।
কানা
শানু আক্রান্ত হওয়ার পরে চার চারটে মাস কেটে গেছে। তখনই এলাকার মানুষজন বিস্ময়ে
দেখলো, বিশাল উৎসবের
আয়োজন চলছে। রাস্তার পাশে কয়েকটা বড়ো বড়ো গেট ও তোরণ বানানো হচ্ছে। ডেকরেটরের কাপড়
দিয়ে সুসজ্জিত হচ্ছে সেসব। আজকে
বিকেলে সেই বিশাল উৎসব। কমরেড শান্তি দাসের পুনঃ আবির্ভাব দিবস। বিকেলে
পার্টির মিছিল বেরিয়েছে। মিছিলে শ’চারেক লোক। তারা সবাই স্যোসাল কি
অ্যান্টিস্যোসাল, তা বলা মুস্কিল। মিছিলের লোকেরা বেশীর
ভাগই অন্য অঞ্চলের, হায়ার করা। মিছিলের মাঝামাঝি একটা
অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান। ভাড়া করে আনা হয়েছে ব্যান্ডপার্টি। রাস্তার পাশে স্বাগতম
লেখা কাপড়ের তোরণ। পার্টির জেলা কমিটির সম্পাদক মিছিলের আগে আগে।
মিছিল
এগোচ্ছে। এই মিছিল মোটেই নিরস্ত্র নয়। মুহূর্মুহূ ধ্বনি উঠছে – ‘সংগ্রামী নেতা কমরেড শান্তি দাস
যুগ যুগ জীও!’ মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স
ভ্যানটা। মাঝামাঝি ধীরগতিতে মিছিলের সাথে তাল রেখে এগিয়ে আসছে ভ্যানটি।
অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে আধাশোয়া অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে কানা শানু। ক্ষমতাসীন
পার্টির এক ফ্রাকশনের নেতা শান্তি দাস ওরফে কানা শানু তার দুর্বল শরীরটাকে একটু
তুলে ধরে অ্যাম্বুলেন্সের নীলাভ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখে নিল। সামনেই তার
পরিচিত পোষ্ট অফিসের একচালা ঘরটা। চেনা দোকান পাট, পীচের রাস্তা। কিছু মানুষ জন মিছিলটা দেখবার
জন্যে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়েছে। ব্যাঙ্কের সামনেই চওড়া
রাস্তাটা জুড়ে কাপড়ের তোরণ। তাতে জ্বলজ্বল করে লেখা হয়েছে – ‘জননেতা কমরেড শান্তি দাস স্বাগতম’! মিছিলে
আওয়াজ উঠছে ‘চক্রান্তকারী প্রাণকৃষ্ণ সাহা মুর্দাবাদ
মুর্দাবাদ!’
রাস্তায়
দাঁড়ানো একজন লোক পাশের লোকটাকে নীচু গলায় বলছে - ‘কানা শানু গুন্ডাটা আবার এলাকায় ফিরলো তাহলে?’ জখমের
ডেঞ্জার কাটিয়ে সসম্মানে সশরীরে মিছিল করে নিজের এলাকায় ফেরত আসছে কানা শানু ওরফে
কমরেড শান্তি দাস। এমনটা
লাগছে, কানা শানুর
এই মিছিলের মধ্য দিয়েই দেশের একটা বিপ্লবী দল তাদের শ্রেনীযুদ্ধের বিজয় উৎসবটি
সমাপ্ত করতে চাইছে!