গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাঠ প্রতিক্রিয়া


                অণুগল্প সংকলন ‘ভদ্রাসন’ / ব্রতী মখোপাধ্যায়
                                                        

ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্প সংকলন ‘ভদ্রাসন’ হাতে পেয়েছি এবং পড়েছি বেশ কিছুদিন আগে । কিন্তু গল্পগলো পাঠ করার পর আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া প্রস্তুত করতে পারিনি আমার অলসতার কারণে । অথচ এই সময় যারা গল্প লিখছেন বিশেষত অণুগল্প, তাদের মধ্যে সার্থক অণুগল্পকার হিসাবে ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের নাম বেশ আগেই থাকবে । সংকলনটিতে স্নাতক, রূপকথার দেশে ও যুদ্ধ এই তিন পর্যায়ে মোট ৫৪টি গল্প স্থান পেয়েছে । প্রতিটি গল্পই এক নিশ্বাসে পড়তে হয়, আর সেটাই অণুগল্পের বৈশিষ্ট্য । কিন্তু ব্রতীর গল্পগুলি একবার পড়ার পরও পাঠকের মনে যে রেশ রেখে যায় তা পাঠককে তাড়িত করে বারবার গল্পগুলিকে পাঠ করতে ।

বাংলা সাহিত্যে গল্প বা গদ্যকাহিনীর ক্ষেত্রে অণুগল্প ধারণাটি নিতান্তই নবীন । ওয়েব পত্রিকাগুলিই অণুগল্পের ধাত্রীগৃহ । অভিধা থেকেই স্পষ্ট এমন গল্প আকারে ছোট হবে । কিন্তু কত ছোট তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য মিমাংসা এখনও পর্যন্ত কেউ করেছেন এমন জানা নেই । অনেকে বলেন অণুগল্পের পরিধি এক হাজার শব্দের কম হবে, আবার চিনা সাহিত্যে নাকি এমন ক্ষুদ্র অবয়বের গল্পকে বলে স্মোকলং ফিকশন, ইংরাজি সাহিত্যে ফ্ল্যাস ফিকশন নামটিও বেশ পরিচিত । সে যাই হোক, তত্বকথায় আগ্রহ নেই ।প্রসঙ্গত, একটা কথা মেনে নেওয়া ভালো যে,জীবন এখন অনেক জটিল হওয়ার কারণে আমাদের পাঠাভ্যাসেও বদল এসেছে, পাঠক এখন ছোট অবয়বের লেখা পড়তেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে । অন্তর্জালের সামাজিক পরিসরে বিশেষত ফেসবুক এবং ওয়েব পত্রিকাগুলির সৌজন্যে অনেক অণুগল্প পড়ার সুযোগ হচ্ছে, অণুগল্পের সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে, বাংলা গদ্যসাহিত্যের একটা নতুনতর দিক ঔজ্বল্য ছড়াচ্ছে এটি গদ্যপাঠকদের কাছে একটা পাওনা

‘অণুগল্প’এই অভিধাটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, আছেও ।এই গল্পগুলি ছোট গল্পের থেকে কেন আলাদা এবং কেন এগুলিকে ছোট গল্পের আওতাভুক্ত করা যাবে না সেই প্রশ্নের কোন মিমাংশাও কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই ।বস্তুত, ‘অণুগল্পছোটগল্পর মধ্যে কোন প্রকরণগত প্রভেদ আছে বলেও আমি মনে করি না । নাটকীয় আকর্ষণীয়তা, উৎকন্ঠা, চরম মুহূর্ত, লিখনশৈলীর দৃঢ় সঙ্ঘবদ্ধতাই সার্থক ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য । অণুগল্পের ক্ষেত্রেও এই মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় থাকা চাই । ব্যক্তি আমি ‘অনুগল্প’ এই পৃথক অভিধাটি স্বীকার না করলেই বা কি অসুবিধা ? ক্ষুদ্র অবয়য়বের গল্পগুলি শেষ বিচারে গল্পই, আমি ব্রতীর গল্পগুলিকে এভাবেই দেখছি । এতৎসত্বেও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে এই ধরনের ক্ষুদ্র গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখকদের একটা চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন হতে হয়, তা হল শব্দ ও ভাবনার যথাযথ ব্যবহার । চরিত্র আঁকার সুযোগ সামান্যই, দু একট শব্দের মোচড় মাত্র, থাকে শুধু পরিমিত শব্দের ব্যবহারে নিংড়ে নেওয়া গল্পের নির্যাস।

কত স্বল্প পরিসরে পরিমিত বাক্যবিন্যাস ও সংলাপ রচনায় মেদহীন গল্পের নির্মাণ করেছেন ব্রতী অবাক হতে হয় ! ব্রতী তাঁর গল্পগুলিকে নির্মাণ করেছেন একক খন্ড দৃশ্যের আশ্রয়ে এবং গল্পের উপকরণ সংগ্রহ করেছেন আমাদের চেনা-জানা চারপাশ থেকে ।আমাদের মধ্যবিত্ত যাপনের নানান বিসঙ্গতি আর তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভিঘাত থেকে । কখনো বা ব্রাত্য প্রান্তিক মানুষজন, কোন চেনা চরিত্র তাঁর গল্প রচনার সহায়ক হয়েছে । আমাদের চারপাশের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষনে উঠে এসেছে আমাদের বিষন্ন জিজ্ঞাসা,  দ্বিচারিতা, ভন্ডামি, মাটিমাখা মানুষের ঘাম-গন্ধ এবং জীবনের স্বপ্নও  এ সবই ব্রতীর গল্পগুলির ভাববীজ । আবার গল্পগুলি যেন আমাদের সামনে ধরা আয়না ।‘কুকুরের লেজ’ গল্পটিতে নদীর কাছে যাওয়া  যুবকটি – তার দুটি হাত দিয়ে কখনো কাঊকে ঘুসি মারেনি,লাঠি বা রাইফেল ধরেনি, তবু হাতদুটি হাড়হীন কার্টিলেজ সম্বল ঝুলে পড়েছে । ডাক্তার বদ্যি কোন নিদান দিতে অক্ষম । কেন এমন ? যুবকটি বলে এখন গর্তে থাকা দাদাদের হুকুমে সে শুধু হাততালি দিত আর “হাততালির গুঁতোয় খুন, জখম,লাশ পাচার এমনকি গণহত্যাও বৈধ হয়ে যেত” ।সেই আয়নাতে দেখি হতদরিদ্র শেতলা বুড়িকে, যার দেওয়ালের সাইত্রিশটা ঘুঁটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিন্নিভিন্ন করে লেখা হয়েছে ‘মেহনতি জনগণের সার্থে বিরাট জনসভা’(শেতলা বুড়ির গল্প) ।

আসলে ব্রতী কতকগুলি ছবি লিখেছেন – যেন তুলির পরিমিত আঁচড়ে জীবনের, যাপনের বিশ্বাসযোগ্য স্কেচ । সেখানে আছে হাজার চেষ্টা করেও কাঠবেকার যুবক যে বেকারত্বের গ্লানিতে স্বগতোক্তি করে’তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে, আমাদের এই শহর এত ছোট, এখানে এখনো ছেলে বেশ্যার রেওয়াজ হয় নি” (দেয়াল)।একটি অমোঘ বাক্যে বেকার যুবকটির বেকারত্বের গ্লানি আঁকলেন ব্রতী । আছে প্রান্তিক মানুষ নারান ছুতার – বউ যার এক কবির সাথে পালিয়ে গেলেও তার অগাধ বিশ্বাস, বউ তার ঠিক ফিরে আসবে, কেননা সে তাকে ভালোবাসে, নারানও । আছে ডুংরি পাড়ার রিক্সাওয়ালা, দিনমাগা বাকু, মঙ্গলার কথা ।সুবিধাবঞ্চিত ভেঙ্গেপড়া মানুষের বাঁকাচোরা জীবনের ও যাপনের কথা  ব্রতীর সংবেদনশীল কলমে উঠে এসেছে ।গল্পগুলির নির্যাস পাঠকের কাছে একটা স্থায়ী রেশ রেখে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস ।যারা গদ্য পড়তে ভালোবাসেন তাদের ব্রতীর গল্প সংকলনটি সংগ্রহ করবেন আশা করি ।

অঙ্কন মাইতির প্রচ্ছদে ও মুদ্রন পারিপাট্যে সংকলনটি বেশ যত্নশীল প্রকাশনা, পাঠক সমাদ্রিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস ।

                                                                     -  ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়