গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

নীহার চক্রবর্তী

                                                            প্রেমে নেই হৃদে


মিতুলের একমাত্র মাসী ক্যান্সারে মারা যায় বছর তিনেক আগে তার বাচ্চা-কাচ্চা ছিল না । মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকে মিতুলের মেসোমশায় আসতে শুরু করে ওদের বাড়িতে । মাসে দুবার চল্লিশ কিমি ট্রেনে চেপে সে হাসিমুখে উপস্থিত হয় মিতুলদের বাড়িতে ।শুরুতে মন্দ লাগেনি মিতুলের বাবার । দুজন মিলে বসে মদও খেয়েছে । তার পছন্দের খাবার এনে দিয়েছে । আর মিতুলের মার তো কথাই নেই । বোনের স্মৃতি ধরে রাখে বোনের বরকে যত্ন-আত্তি করে,ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে । কিন্তু সমস্যা এলো তিনবছর পর । একদিন মিতুলের বাবা ওর মাকে একান্তে বলল,'এবার তোমার বোনের বরকে বিয়ে করে সংসার করতে বল । আমি দুবার বলেও কাজ হয়নি ।' মিতুলের মা তার মুখে এমন কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলো । কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ।

পরে মিতুলের বাবাকে ভ্রূ-কুঁচকে বলল,'তাতে তোমার সমস্যাটা কোথায় ? আবার ওকে বিয়ে করতে হবে তার কি মানে আছে ।'
শুনে বেশ রেগে উঠলো মিতুলের বাবা ।
সে গলা চড়িয়ে বলে উঠলো,'আমার বাড়িতে বারবার ওকে আসতে হবে তারই বা কি মানে আছে । এতে লোকে ভালো বলে না ।'
তার মুখে অমন কথা শুনে চমকে উঠলো মিতুলের মা । নিমেষে তার সারা মুখ ঘৃণায় ভরে গেলো ।
বলল সে,'বাড়িটা যদি তোমার একার ভাবো,তবে তোমারই । আমার এতদিনের কষ্ট স্বীকারের মূল্য বলে কিছুই নেই । আজ বুঝে গেছি । ঠিক আছে ফোনেই ওকে বলে দেবো ।'
মিতুলের মার যন্ত্রণা না বুঝে ওর বাবা 'হুম; শব্দ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো ।
তার বেরিয়ে যাওয়ার পরপর মিতুলের মা ফোন করলো বোনের বরকে ।
কোন ভূমিকা না করেই তাকে বলল,'এবার থেকে তোমার মিতুলের বাবার বাড়িতে আসা বন্ধ । ও পছন্দ করছে না আর । পছন্দ করছে না বুঝি তোমার সঙ্গে আমার অটুট ভালোবাসা । আমাদের ভালোবাসার মানে ও বোঝেইনি । এবার নতুন করে বোঝাতে হবে ।'
যারপরনাই অবাক মিতুলের মেসোমশায় ।
সে চুপ করে থেকে-থেকে বলল,'তুমি ওনাকে কীভাবে বোঝাবে,শুনি ? আমি তো তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না ।'
উত্তর দিলো মিতুলের মা বেশ স্বাভাবিক-গলায়,'যা এতদিন হয়নি এবার হবে । এখান থেকে সরে গিয়ে আমাদের দূরের কোন হোটেলে উঠতে হবে । তুমি না । আমিই তোমাকে উপভোগ করবে । তুমি শুধু মজা নেবে । তারপরে আর কি থাকে । দুজন একসাথে নতুন দিশা দেখে নেবো ।'
এমন কথা শুনে মিতুলের মেসোমশায়ের গলা যেন কেঁপে উঠলো খানিক ।
একটু কাঁপা-কাঁপা গলায় বলতে থাকলো,'এও সম্ভব ? আমি তো তোমাকে দিদি বলেই ভাবি । আমার চেয়ে তুমি বয়সে অনেকটাই বড় ।'
সাথে-সাথে ক্রুদ্ধ-স্বরে মিতুলের মা বলে উঠলো তাকে,'মহা কাপুরুষ তুমি । কীসের জন্য আমার কাছে আসতে ? ভেতরের কোন স্বপ্ন ছিল না তোমার ? ভালোবাসায় সম্পর্ক আর বয়স বলে কিছু হয় ? তুমি আর মিতুলের বাবার বাড়িতে পা-ই ফেলবে না । বোঝা গেছে তোমার দৌড় ।'
বলেই ফোন কেটে দিলো মিতুলের মা ।
সব শুনেছে মিতুলের বাবা পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে ।
সহসা সে সামনে এসে্ একচোট হেসেই মেজাজের সুরে বলতে থাকলো মিতুলের মাকে,'তাহলে দেখছি আমারই ভুল । তুমিই চেয়েছিলে ওকে । সে তোমার প্রতি অন্যকিছু ভাবেইনি । মনে-মনে তোমার এই ছিল বুঝি ? ছিঃ...'
';হুম । এই ছিল আমার মনে । যা বুঝেছ বেশ বুঝেছ । আর এ নিয়ে একটি কথা বলবে না তুমি ।'
কথা শেষে হনহন করে মিতুলের মা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো । মিতুলের বাবা পিছনে-পিছনে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো কি এক চিন্তা করে ।
আধঘণ্টা কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে মিতুলের বাবা দোতলায় উঠে গেলো বেশ চিন্তিত-মুখে । পরপর দুটো ঘরে গিয়ে সে দেখল মিতুলের মা নেই । আর একটা ঘর বাকি । প্রমাদ গুণতে থাকলো সে ।
তারপর শেষ ঘরে গিয়ে দেখল মিতুলের মা তার বড় প্রিয় আকাশী রঙের ওড়না গলায় জড়িয়ে সিলিং-ফ্যানে ঝুলছে ।
দেখেই সে কান্নায় ভেঙে পড়লো । কেউ শুনতে পেলো না তার কান্নার শব্দ ।
তখুনি ফোন এলো একটা শ্রীরামপুর থেকে । মিতুলের মেসোমশায়ের ভাই ফোন করেছে ।
সে কাঁদতে-কাঁদতে মিতুলের বাবাকে প্রায় অস্ফুটে বলল,'দাদা মিনিট পনেরো আগে কপেলে পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছে । জানি না কি হল । আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেলো ।'
এর কিছুই জানে না মিতুল । ও তখন গরমের ছুটিতে ছোটো কাকার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মনের আনন্দে কাকার ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে ।
এখানে তখন কান্না নিজেকে সাজাচ্ছে বিষাদের নানা রঙে । নিমেষে এক থেকে অন্য রঙে ।