ঠাকুমা
প্রত্যেক দিন কাঁচের গ্লাসে গ্লুকোজের জল খাওয়ানোর সময় ঠাকুমার কানে
কানে ঠাকুরদা কি বলেন শুনতে ইচ্ছে হয় l ক্ষনিকের জন্য তাঁর নিষ্প্রভ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আবার পরে ফিকে হাঁসিটা
ঠোঁটের কোনে এসে অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকেন ঠাকুমা, সেই ক্ষনিকের
হাঁসিটা মিলিয়ে যায় পরক্ষনে l কিং কর্তব্য বিমূঢ় ঠাকুরদা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন
ঠাকুমার নিথর শরীরের দিকে l অশ্রুসিক্ত নেত্র থেকে টপ টপ করে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু l এই দেখে আসছে রীনা দিনের পর দিন l কেউ ডাকলে সাড়া দেন না ঠাকুমা
কিন্তু ঠাকুরদা যখন গ্লুকোজের জল গোলান কাঁচের গ্লাসে ঐ শব্দ শুনে একটু চোখ
খুলে দেখেন ঠাকুরদাকে l ঠিক সেই সময় ঠাকুমা মুখটা অনেক কষ্টে খুলে ঐ গ্লুকোজ এর জল টুকু
খান আর ঠাকুরদাকে কি যেন বলতে চেষ্টা করেন সেটা তিনিই বোঝেন l ওটাই বুঝি ঠাকুমার মৃত
সঞ্জীবনী সুধা l এই চলছে বেশ কয়েক মাস l সারাদিন চোখ বুজে ঐরকম পড়ে থাকেন ঠাকুমা l
কেউ কখনো ডাকলে সাড়াও দেন না কি ঘুরেও তাকান না l ঠাকুরদা ছাড়া কি কেউ ওনার কষ্ট বোঝার
নেই?
আশ্চর্য লাগে রীনার l ওর খুব ইচ্ছে করে কি এমন কথা ঠাকুরদা
ঠাকুমার মধ্যে হয় যা ওদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ l অন্য কেউ জানতে চাইলে ঠাকুরদা বলেন না, বরং গম্ভীর হয়ে
বলেন ওগুলো তোমরা বুঝবে না l ওসব আমাদের আমলের কথা, বলার সংগে সংগে ওনার চোখ ছল ছল করে ওঠে চোখের জলে
l
রীনাকে এই নিয়ে ঠাকুরদাকে বিরক্ত করতে মানা করেন মা l বলেন ওদের বন্ডিং
টা খুব পোক্ত l এখনকার ছেলে মেয়ে তোরা ওটা বুঝবিনা l ওটা ঐশ্বরিক প্রেম যা রাধা কৃষ্ণের
মধ্যে ছিলো l ঐ প্রেমে কোন খাদ নেইরে l ওটা দৈহিক নয় সম্পূর্ণ মানসিক বন্ধন একে অপরের প্রতি উত্তর দায়িত্ব প্রকৃত ভালোবাসা
যা এই যুগে বিরল l রীনাকে মা বলেন দেখো মা তোমার বাবা পৈ পৈ করে মানা করেছেন ঠাকুরদাকে
যেন রীনা বিরক্ত না করে l ওনার এমনিতেই মন খারাপ তার ওপর নানা প্রশ্ন করলে উনি
আরো মনে দুঃখ পাবেন তার চেয়ে ওদের একা থাকতে দাও l
কিন্তু রীনার কৌতূহল বেড়েই যায় দিন দিন l
ঠাকুরদাকে রীনা বলে, ও দাদা তুমি কি বলছো ঠাম্মির কানে কানে বলোনা
?
দাদা বলেন তুই কি বুঝবি রে মা আমাদের কথা ? ওটা আমাদের নিজস্ব l একান্তই
নিজস্ব l বেঁচে থাকার মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র l তোরা মেকি সভ্যতার আড়ালে
ভুলে যাস নর নারী ভগবানের এক অপূর্ব সৃষ্টি সেটা জৌবনের ক্ষুধা মেটানোর
জন্য নয় রে মা সেটা ঐশ্বরিক প্রেম যা হৃদয়ের কোন থেকে সৃষ্টি তাতে আবেগ আছে মাধুর্য
আছে তৃষ্ণা মেটানোর সুধা আছে l পরস্পরের আবশ্যকতাকে হৃদয় থেকে স্বীকৃতি দেয় প্রকাশ্যে
নয় l সেটা বড়ই আপনার l তোরা বুঝবিনা রে মা l তুই যা এখান থেকে l
রীনা বোঝে তাই বোধ হয় যেদিন থেকে ঠাম্মি অসুস্থ দাদা ঠাম্মির কাছ ছাড়েন
না l দাদা আগে কতো হাঁসি খুশি এক প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন l এখন উনি কেন এতো মুষড়ে পড়েছেন
রীনা বুঝে উঠতে পারছেনা l ঠাম্মির অসুস্থতা দাদাকে অস্থির করেছে l
তবুও আশার আলোক ছাড়েনি দাদা l আঁকড়ে ধরে আছে তার পুরোনো
স্মৃতি আর মাঝে মাঝে সেটাই বলেন ঠাম্মির কানে কানে l সে এক অদ্ভুত অনুভূতি দুজনের অনাবিল
প্রেমের মুহুর্ত প্রস্ফুটিত হয় স্মিত হাস্যের মাঝে l তাতেই তারা পরিতৃপ্তি l ঝরে পড়ে
অজানা অশ্রুধারা l কি সেই স্মৃতি ? রীনার কৌতূহল থেকে যায় l.........
ঠাকুমা
শেষ পর্ব
©ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী✍️
রীনার কৌতূহলের শেষ নেই l মাধ্যমিক দিয়ে বসে আছে রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায় l রীনা নাছোড় বান্দা
l দাদাকে জিজ্ঞাসা করে কি এমন কথা জমে আছে তোমাদের হৃদয়ে যা আজও প্রকাশ করতে পারোনি
ঠাম্মিকে?
দাদা এই কথায় রেগে গিয়ে মাকে ডাকেন, বৌমা তোমার মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে
যাও l বড্ড পাকা মেয়ে l
রীনা দাদাকে চুপ চুপ বলে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলে l মাকে কেন
ডাকছো? দাদার কাছে এসে হাত জোড় করে বলে, প্লিজ বলোনা দাদা ওরম কেনো করছো?
খাটের কাছে এসে দাদার মাথা টিপে দেয় l প্লিজ বলোনা দাদা, ঠাম্মির কানে তুমি কি এমন
বলছো যে ঠাম্মি এতো কষ্টের মধ্যেও হাঁসছেন l যদিও হাঁসিটা ফিকে l
ওসব কি তোদের মতন মডার্ন মেয়ে বুঝতে পারবে রে মা l ওটা মনের কথা প্রাণের
কথা সকলের জন্য নয় l ওসব আমাদের পুরোনো দিনের স্মৃতি l তুই কি বুঝবি সেসব আবেগের কথা,
সেগুলো নিতান্ত ব্যক্তিগত কথা l
আজকাল স্বামী স্ত্রী যতই ডার্লিং বলে একে অপরকে ডাকুক না কেন তাঁদের
মনের মধ্যে অনেক অমিল দ্বন্দ আবার মাঝে মাঝে একে অপরকে সন্দেহ করেন l ঐ সাহেবদের মতন
সুইট হনি বলে ডাক পরক্ষনেই মানি মানি নিয়ে গন্ডগোল প্লেট ছুঁড়তে
ছুঁড়তে মেমসাহেব তার রাগের প্রতিক্রিয়া দেখাবে আর সাহেব বলবে কুল ডাউন বেবি কুল ডাউন
l ঠিক তোদের এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ঐ সাহেব ঘেঁসা হয়েছিস l ওরে মানি ছাড়া তোরা কিছুই
বুঝলিনা l জীবনকে সুন্দর ভাবে উপভোগ করতে তোরা জানিস? কি করে জানবি বল বৌ গেল চাকরি করে টাকা রোজগার
করতে বর গেল এঁটো বাসুন মাজতে... ঘরে যদি বাবা মা আসেন তখন বুড়ি মাকে দিয়ে
বাসুন মাযাবে রান্না করাবে l এইতো তোদের ব্যক্তি চরিত্র ! তোরা জানিস জীবনকে উপভোগ
করতে l পারবি তোরা অসুস্থ স্বামীর জন্য রাতের পর রাত জেগে থাকতে l তখন বাপের বাড়ি পালাবি
নয় বাড়িতে সেন্টারের নার্স কে দিয়ে সেবা সুশ্রূষা করাবি l তার খরচ স্বামী দেবে l আসলে
এই পৃথিবীতে মানুষের হৃদয় বলে বস্তু কমে যাচ্ছে l চারিদিকে পাপের আঁধার নেইকো কোথাউ
আলো...... আর বলবোনা l
রীনা বলে দেখলে দাদা তুমি কেমন কায়দা করে আমার প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে গেলে
l পারো বটে তুমি l আচ্ছা আমি তোমার কেউ নই ! বলে কেঁদে ফেলে l
- এই এই মোট্টে কাঁদবিনা মা l তা কেন মা তুই তো আমার ঘর আলো করা লক্ষী
মা l তবে কি জানিস মা ঐ তোদের বয়েসের ছেলে মেয়েদের বেহায়া পনা রাস্তায় শপিং মলে ছেলে
মেয়েদের বেলেল্লাপনা দেখে আমরা ভাবি... মনে হয়রে আমার অন্ধ হওয়া ছিলো ভালো l তোরা বলবি
সময়ের সাথে এগোও ঐ পুরোনো দিনের স্মৃতি নিয়ে বসে থাকো তোমরা l না রে মা ওতেই আছে মাদকতা,আছে
স্নেহের পরশ, আছে অব্যর্থ প্রেম যার তুলনা হয়না l তোর ঠাম্মি যখন আমার ঘরে আসে তখন
আমি 400 টাকা মাইনে পেতাম l তারপর তোর বাবা আমাদের কোলে এলো l খুবই কষ্টে সংসার চলত
কিন্তু তোর ঠাম্মি সব দুঃখ মাথা পেতে নিয়ে কি সুন্দর ঘর চালাতো l অবশ্য আমার শাশুড়ি
মাতা অনেক করেছেন আমার সংসারের জন্য l তাঁর অবদান আমি কখনো ভুলবো না l তোর বাবা তো
তার মামার বাড়িতেই বেশি সময় থাকতো l
আমি শশুর বাড়ি ঐ জামাইষষ্ঠীতে যেতাম l এক পাল শালী l সবাই বলতো সিনেমা
যাবো l কি করি বল অগত্যা প্রায় দেড়শো টাকা খরচ করে আমার শশুর বাড়ির কাছের সিনেমা হলে
যেতাম l তখন এন্টার দি ড্ৰেগন সিনেমাটা আমার দেখার ইচ্ছে ছিলো l ব্রুশ লী র ছবি l খুবই
চলে ছিলো সিনেমাটা l সিনেমার পর মৌচাকে কবিরাজি খাওয়া l সে তুই বুঝবিনারে মা বড় জ্বালা
আমার পকেট গডের মাঠ l কিচ্ছুটি বলার উপায় নেই তাহলেই বিপদ l সংগে আমার অবশ্য স্টেট্
ব্যাংকের ট্রাভেলার্স চেক থাকতো l তখন তো আর এ. টি. এম. ছিলোনা তাই ওটাই ভরসা ছিলো
l আমি জানি পকেটে টাকা থাকলে শালীদের নেক নজরে কর্পূরের মতন টাকা উবে যাবে l তাই কম
টাকা রাখতাম l
এখন তোর ঠাম্মিকে দেখছিস এই রকম কিন্তু ও খুব সুন্দরী ছিলো l স্কটিশে
পড়তো l আমরা খুব ঘুরতাম l আজ ভিক্টরিয়া কাল বোটানিক্যাল গার্ডেন পরশু বেলুড় মঠ, মা
ভবতারিনীর মন্দির l সব ই ঐ বাসে ট্রামে l তোর ঠাম্মির শরীর খারাপ হতে আমি
সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছি রে মা l তুই বলছিলিসনা কি বলি বলে !
আমি কি বলি জানিস:
কাঁচের গ্লাসে ঢালি পানি
খাবে আমার রাধা রাণী
ভালো হবে ওষুধ খেলে
যাবো অনেক দূরে চলে
কেউ পাবেনা মোদের টিকি
ভালো হয়ে উঠে পড় দিকি
- এ কেমন বোকা বোকা কথা l বড্ড সেকেলে l বৌকে কেউ রাণী
বলে ?
- তবে কি বলে?
- সুইট হার্ট l
- দেখ মা হার্ট টা যদি সুইট হয় তবে তাতে পিঁপড়ে লেগে যাবে l ঐসব সুইট ফুইট নয় l ও আবার
ডায়াবিটিস এর লক্ষণ l তুই যা তো আমাকে একা থাকতে দে l
- দাদা তুমি কি সবদিন ঠাম্মিকে কবিতা শুনিয়ে খাওয়াও l
- না সে কবিতার বড় ভক্ত আমার এই ছেঁদো কবিতায় তার মন ভরেনা
l তবুও আমার কথার সম্মান দেয় যাতে আমি মনে দুঃখ না পাই l ওটাই আমার কাছে বড় পাওয়ারে
মা l
তোদের কাছে যা কবিতা আমাদের কাছে সেটা মনের এক তারা l ঐ এক তারার তান
শুনলে ও ফিরে তাকায় l ও জানে আমি কোনদিন কবিতা লিখতে পারিনা তাও কিন্তু ও কোন প্রতিবাদ
করেনা l আমাকে উৎসাহ দেয় মাথা নাড়িয়ে l এই বলে দাদার চোখ থেকে জল পড়ে l
গান শুনতে ও খুবই ভালোবাসে কিন্তু সেগুলো প্রায় রবীন্দ্র সংগীত l আমিতো
কচু পোড়া জানি l আমি তাই শচীন কর্তার গান শোনালাম l
মন দিলোনা বধূ
মন নিল শুধু
আমি কি নিয়ে থাকি?
অনেকদিন পর ঠাম্মির মুখে একটু কথা বেরুলো l অভিযোগের সংগে দাদাকে বললেন,
একি তুমি এসব কি বলছো বাচ্চা মেয়েটাকে ? এগুলো আমাদের ব্যক্তিগত কথা ওকে বলোনা l ও
বাচ্চা মেয়ে এসব কি ওকে বলা উচিৎ l
দাদা খুশিতে নেচে ওঠেন ঐটুকু কথা শুনেই বলেন তোর ঠাম্মি কথা বলছে তোর
ঠাম্মি ভালো হয়ে গিয়েছেন l
এতদিন হোল ও আমার সংগে আছে কিন্তু কোন দিন কোন প্রতিবাদ করেনি কি ওর
কোন চাহিদা রাখেনি l আমার সংগে তাল মিলিয়ে চলেছে l এই প্রথম ওর মুখে প্রতিবাদের সুর
শুনলাম l আমি কিন্তু খুব খুশি ও সেরে গিয়েছে এবারে উঠে বসবে কি বলো ? তাইতো?
ওষুধ ঠিক কাজ করেছে l দাদা খুশিতে সারা ঘর নেচে বেড়ান আর ঠাম্মি মুখে
হাত দিয়ে উঠে বসেন l
রীনা লাফ মেরে মায়ের কাছে যায় খবরটা দিতে l ঠাম্মি সেরে উঠেছেন l দেখবে
এসো মা l...........
*************