গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শান্তিময় কর

 সন্দেহের জ্বালা  

এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাত ! হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়লো শুভময়। তার চোখের সামনে সমগ্র পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো। মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করে উঠলো। অনেক কষ্টে কোন প্রকারে নিজেকে সামলে সে আর্তনাদ করে উঠলো, “কী বলছো কি সুমনা” “ঠিকই বলছি,”আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নাই। তোমার জীবনে সুমনা নামে কেঊ কোনদিন ছিল বা আছে, ভুলে যাও। এখন থেকে তোমার আমার পথ আলাদা”। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শুভময় কে কিছু বলার সুযোগ বা সময় না দিয়েই ঝড়ের বেগে চলে গেল সুমনা। 

কেন যে হঠাৎ দুম করে ঐ কথাগুলো বলে সে চলে গেল শুভময় বুঝতে পারে না। এত দিনের ভালবাসার সম্পর্ক কেমন করে শেষ হয়ে যেতে পারে, ভেবে বিভ্রান্ত, হতবাক,দিশেহারা সে । বাল্যকালের খেলার সাথী, যৌবনে মন দেওয়া নেওয়া শেষ করে, ভবিষ্যতে একান্তনীড় গড়ার স্বপ্নে মশগুল ওরা দুজনই। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি আর উভয়ের বাড়ীর আপত্তি সত্ত্বেও এতটুকু নড়াতে পারেনি কেউ ওদের সংকল্প থেকে। অথচ কী এমন কারণ হল যে সুমনা তাকে ছেড়ে চলে যেতে চায়? কী অন্যায়, কোথায় অন্যায় তার মাথায় আসে না । এই  মুহূর্তে কত স্মৃতি, কত কথাই না ভিড় করে আসছে শুভময়ের মনে। কথায় কথায় সুমনাই তো বলতো ‘তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, তাই না’ ? ‘সে কথা কি বলে দিতে হবে ? তোমার মন কী বলে’ ? সুমনা বলে, ‘হ্যাঁ মশাই হ্যাঁ, আমি জানি তুমি আমায় খুউব ভালোবাসো। এমনি এমনিই বলছিলাম। সত্যিই আমি ভাগ্যবান, তাই তুমি এলে আমার জীবনে। আমার মন, প্রাণ কানায় কানায় ভর্তি তোমার ভালবাসায়। তোমাকে ছাড়া আর কিছুই, কোন কথাই ভাবতে পারি না আমি, আমাকে ছাড়া অন্য কারও কথা ভাবলে তোমায় মেরে ফেলবো না ! একটি বারের জন্যও যদি মনে হয় তুমি  আমাকে ভালবাসো না, আমি মরে যাব সত্যি বলছি”। আমি বলেছিলাম, “তুমি মরে গেলে আমি খুব সুখে থাকবো ,তাই না ? তোমাকে ছাড়া আমিও কি বেঁচে থাকবো” ? সুমনা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি তোমার কে’? বলেছিলাম, ‘তুমি আমার মন, মানসিকতা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা। তুমি আমার ধমনীর রক্ত স্রোত, আমার মনের মণি, চোখের আলো। তুমি আমার সব, সব কিছু’। গভীর আবেগে সুমনা বলেছিল, ‘জানি, জানি, আমি সব জানি। তবে আমার ভীষণ ভয় হয় যদি কোনদিন তুমি আমাকে আর না ভালোবাসো, যদি আমায় ছেড়ে চলে যাও ? আমি বলেছিলাম, ‘তেমন দিন আসার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়’। সুমনা বলেছিল ‘না,না, প্লিজ ওকথা বলে আমায় কষ্ট দিওনা। এই পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশী ভালবাসি তোমাকেই।  তোমাকে ভালবেসে বেঁচে আছি আর তোমাকে ভাল বাসতে বাসতেই মরে যেতে চাই আমি’ বলেছিল সুমনা। এটাই হল শুভময় আর সুমনার মনের সত্যিকারের গতি প্রকৃতি। ওরা ভালবাসার আদর্শ প্রতীক। এমন সুন্দর একটা বোঝাপড়া ওদের দুজনের মধ্যে যে কেউ কোনদিন একে অপরক কোন কাজে বাধা দিত না । নিজেদের স্বকীয়তা বিসর্জন না দিয়েও ওরা পরস্পরকে অবলম্বন করেই ভবিষ্যৎ জীবনে সুখের, শান্তির নীড় গড়ে তুলতে চেয়েছিল। লোকে বলে, ‘মেইড ফর ইচ আদার’। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পরস্পরকে সঙ্গী করেই ওদের পথচলা, মন দেয়া-নেয়া কবেই শেষ -- আর কদিন পরেই ওরা বিয়ে করছে ঠিক হয়ে আছে। ওরা দুজন ভীষণ খুশী । সুখ যেন উপচে পড়ছে ওদের চোখে মুখে । ওদের সব ইচ্ছা, বাসনা কামনা, আকাঙ্ক্ষা আর কদিনের মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সফল হতে যাচ্ছে তাদের স্বপ্ন। সমস্ত ব্যাপারটা যখন এতদূর গড়িয়েছে তখন এমন কী ঘটনা ঘটলো যে সুমনা শুভময়কে এমন ভাবে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেল ? শুভময় তো ভেবে আকুল -- মনটা তার হুহ করে উঠছে । সুমনাকে হারাতে হবে ভেবেই তার দু চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। সে সুমনার কাছে গিয়ে এর কারণটা জানতে চাইলে সে তাকে কৌশলে এড়িয়ে যেতে থাকে।একদিন একা পেয়ে সে সুমনাকে চেপে  ধরে –“কেন তুমি এ রকম ব্যবহার করছো আমার  সাথে ? কী দোষ আমার”? “তোমার কী দোষ ? তোমার কোন দোষ নাই।সবই আমার ভাগ্যের দোষ । তা না হলে তোমাকে এত ভালবেসেও আমার  এই অবস্থা” ? – “কী হয়েছে সেটাই তো আমি জানতে চেয়েছি সুমনা”। “আমায় জিজ্ঞেস না করে নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করো শুভ। শুভময় বলে, “আমার বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার। এমন কোন গর্হিত  কাজ আমি করিনি যা তোমার দুঃখ, ব্যথা বা কষ্টের কারণ হয়ে উঠতে পারে”। “কিন্তু তাও তুমিই, যাকে আমি এতকাল ধরে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবেসে এসেছি, সেই তোমার কাছ থেকেই এত বড় আঘাতটা আসবে, আমার ভালবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে, আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি” শুভ, সত্যি বলছি”। “আমি তো সেটাই জানতে চাই কীভাবে কখন তোমায় আমি আঘাত দিলাম সুমনা”। সুমনা বলে, “না, আমি আর কিছুই বলবো না। বলাবলি সব শেষ। আমায় জোর করেও কোন লাভ হবে না। এ নিয়ে কোনদিন তোমার  সাথে কোন কথা বলতে চাই না। আমি জানি, তোমার কাছে আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। আমাকে ছাড়াও তোমার  দিব্যি চলবে”। এই বলে কথার মাঝখানেই সুমনা উঠে চলে গেল। শুভময় শূন্য দৃষ্টিতে সুমনার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।এ কী হল তার জীবনে? কেন সুমনা তার জীবন থেকে এভাবে চলে যেতে চায়, তা সে ভেবে পায় না। এমন কি সামান্য সুযোগটাও সে পেল না এর কারণটা জানার, যাতে তার কোন অন্যায় সত্যিই যদি থেকে থাকে, তার জন্য জবাবদিহি করতে বা সুমনার কাছে ক্ষমা চাইতে। এ কেমন ভালবাসা ? এমন তো হবার কথা ছিল না। সুমনাই তো বলতো  ‘কোন পরিস্থিতেই আমরা পরস্পরকে ভুল বুঝবো না । ভুল বোঝাবুঝির অবস্থা এলে আমরা নিজেদের মধ্যে  আলোচনা করে সব মিটিয়ে নেবো । সব কিছ যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবো’ । 
 
কিন্তু কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি ? কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে শুভময়ের জীবনের সব আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন, কল্পনা ? কেন এমন হল ? সুমনা বলেছিলো, “নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করো "। বিবেকের দরজায় শত আঘাত করেও কই শুভময় তো কোন উত্তর পাচ্ছে না। তবে এতদিনের সুমনার ভালবাসা শুধুই কি উচ্ছ্বাস, নাকি অভিনয় ? সে তো তার ভালবাসাকে উচ্ছ্বাস বা অভিনয় বলেও মানতে পারছে না। অনেক ভেবেও সে এর কোন কারণ খুঁজে পায় না । একটা গভীর চাপা কষ্ট সব সময় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে । আহার,
 
নিদ্রা, বিশ্রাম সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সে একা বসে শুধু ভাবে আর তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যায় একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চায়-- গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার ।
 
 

সাত আট দিন পর শুভময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনির্বাণ গ্রামের বাড়ী থেকে ফিরে শুভময়ের বাড়ীতে আসে । মাঝখানে যে এত ঘটনা ঘটে গেছে, তা সে জানে না । জানার কথাও নয় তার। শুভময়ের জগৎটায় যে এত বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে, তাও তার অজানা।তার বাড়ীতে পা রেখেই তাকে দেখে অনির্বাণ শিউরে ওঠে -- 
“এ কী শুভময়, এ কী অবস্থা হয়েছে রে তোর শরীরের ? তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না । কি হয়েছে তোর” “বাদ দে না আমার কথা । তুই কখন ফিরলি, কেমন আছিস বল” ? –“না, না, আগে বল তোর কী হয়েছে” ?
 
এ প্রশ্নের উত্তরে শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। “শেষ হয়ে গেল
   আমার সব শেষ হয়ে গেছে রে অনির্বাণ”। “কি শেষ হয়ে গেছে তোর, কি বলছিস তুই” ? 
“ঠিকই বলছি। আমার সব শেষ হয়ে গেল। বেঁচে থাকার আরকোন মানে হয় না আমার”।
 
অনির্বাণ বলে, “কি বলছিস যা তা।সব কথা খুলে বল আমাকে” ।
 
শুভময় বলে, “সুমনা আমায় ছেড়ে চলে গেছে । কী কারণে, কেন আমার এত দিনের এত ভালবাসাকে দু পায় মাড়িয়ে চলে গেল ও, আমি যে জানার সুযোগটুকুও পেলাম না রে অনির্বাণ । দুম করে বলল আমার সাথে তার আর কোন সম্পর্ক নাই।বলেই সে চলে গেল”।
 
“তুই ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিস নি” ? শুভময়ের আক্ষেপ “শত অনুরোধেও ও কিছু বলল না, জানালো না কারণটা কী। ও শুধু বলল, “নিজের বিবেক কে জিজ্ঞেস করো। আমার বিবেকের তো কোন দংশন নাই। এত ভালবাসি আমি ওকে যে এত বড় আঘাত টা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না । এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল ছিল”। অনির্বাণ বলে, “বোকার মত কথা বলিস না তুই । মনটাকে শক্ত কর।সুমনা
 বরাবরই ঐ রকম, তুই তো ভাল করেই জানিস। হয়তো এটাও ওর খামখেয়ালিপনা । তবুও কারণটা তো 
জানতেই
 হবে । আর তুই যদি মনে করিস তোর মনে কোন পাপ নেই,  তাহলে এত ভেঙ্গে পড়ছিস কেন ? ওসব আজেবাজে ভাবনা মন থেকে একদম মুছে ফেল । তুই শান্ত হ, কিছু ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবেএখন যাচ্ছি । দু একদিন পর আমি আবার আসবো” । 
 
এই বলে অনির্বাণ চলে যায় । শুভময় আবার ডুবে যায় চিন্তার জগতে । কোন মতেই মনটাকে সে শান্ত করতে পারে না । এই ভাবে একটা অকল্পনীয় আঘাত যে তার মন, মানসিকতা, অন্তরাত্মাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে বা দিতে পারে তা তার স্বপ্নেরও অতীত ছিল । সে সব সময় শুধু ভাবে সুমনার সাথে তার মধুর, সুন্দর, রঙিন দিনগুলোর কথা । একটা বোবা কান্না তার বুকে জমতে জমতে তাকে যেন অবশ, পাথর করে দিচ্ছে ।
 
ঘটনার আকস্মিকতায় সে যেন মূক হয়ে যাচ্ছে। জীবনের অর্থ এবং জীবন বোধটাই পাল্টে যাচ্ছে তার কাছে।
  সারা রাত জেগে বসে থাকে সে আর ভাবে শুধু সুমনার কথা, আর যেন জগৎ সংসারে তার ভাবার কিছুই নাই কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে তার, সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না সে পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে। মাঝখানে অনির্বাণ আরও দু একবার এসেছে তার কাছে । উদাস, করুণ বন্ধুর মুখটার দিকে তাকাতে ভীষণ কষ্ট হয় তার । খুবই চিন্তায় পড়ে যায় সে । এভাবে চললে শুভময় বাঁচবে কি করে ? মাঝে মাঝে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে শুভময় আর বলে , " দেখ অনির্বাণ, এই জীবনটা আমার কাছে বোঝা হয়ে উঠেছে । বেশ বুঝতে পারছি সুমনাকে ছেড়ে আমার পক্ষে একটা দিনও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।এমন ভাবে বাঁচা যায় না রে”। 
 
বন্ধুর মনের অবস্থা অনির্বাণকে ভাবিয়ে তোলে। সে জানে শুভময়ের মত এমন অভিমানী একটা ছেলেকে বাঁচাতে হলে কিছু একটা করতেই হবে । তাই সে ঠিক করে একবার সে সুমনার মুখোমুখি হবেই । সামনা সামনি সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করবে তার এমন আচরণের কারণটা কি ? তাই একদিন সে সুমনাকে ফোন করে –“হ্যালো, কে সুমনা ? আমি অনির্বাণ বলছি । কেমন আছো” ? সুমনা বলে, “মনে পড়লো এতদিন পর আমার কথা ? তা কি ব্যাপার তোমার” ? “তোমার সাথে কিছু দরকারি কথা ছিল । তবে সব কথাত আর ফোনে বলা হয়ে ওঠে না। তাই তোমার সাথে একবার দেখা হওয়া খুবই জরুরী । কবে, কখন, কোথায় আসবো, বলো”। সুমনা বলে “তার আগে বলো, কী নিয়ে কথা বলতে চাও আমার সাথে”? “অত উতলা হবার কারণ নেই। সাক্ষ্যাতেই সব বলবো”। সুমনা বলে, “ঠিক আছে, আগামী কাল সন্ধ্যে ছটায় পাঁচ মাথার মোড়ের কফি হাউসে এসো। ওখানে বসেই কথা হবে” । 
 
পরের দিন অনির্বাণ নির্ধারিত সময়ে কফি হাউসে পৌঁছে দেখে সেখানে সুমনা আগেই
 
পৌঁছে গেছে । সে তাকে নিয়ে একটা কেবিনে বসে সামান্য স্নাক্সের সাথে দু কাপ
 
কফির অর্ডার দেয় । তারপর সুমনাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছো’ ?
 
  ‘ভালই তো আছি, খারাপ থাকবো কেন’ ? 
  ‘হ্যাঁ, ভালই তো থাকা উচিৎ । খারাপ থাকার কোন কারণ তো না থাকারই কথা । তবু বলি, তোমার চেহারা আর চোখ মুখ কিন্তু তা বলছে না”। “কি মনে হচ্ছে তোমার” ? অনির্বাণ বলে, “দেখো সুমনা, নিজের সাথে লুকোচুরি খেলে কী লাভ ? তুমি যে ভালো নেই আর তোমার মধ্যে অহরহ যে একটা যুদ্ধ চলছে, তাতুমি যতই আড়াল করার চেষ্টা করো , তোমার চোখে মুখে তা ফুটে উঠছে । সুমনার প্রতিবাদ “একদম বাজে কথা। শরীরটা কদিন ধরে একটু খারাপ চলছে বলেই হয়তো তোমার ও রকম মনে হচ্ছে” । 
অনির্বাণ বলে, “শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে মনের ব্যথা কেন লুকিয়ে রাখতে
 চাইছো তুমি ? শুভময়কে আর তোমাকে তো কম দিন চিনি না, এদিকে তুমি আর ওদিকে শুভময় মনের দুঃখ, ব্যথা, যন্ত্রণা আর কষ্টে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছ”। সুমনা দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আমার সাথে দেখা করতে  চাওয়ার কারণটা কি জানতে পারি  আমি” ? অনির্বাণ বলে, “তোমার কাছে হাত জোড় করে বলছি শুভময়কে তুমি বাঁচাও 
তোমাকে ছাড়া
  ও যে বাঁচতে পারবে না । কেমন করে তুমি ওকে এত বড় আঘাত দিতে পারলে ? যে তোমাকে ছাড়া আর কিছু জানে না, কাউকে জানে না, আর কারও কথা ভাবে না, তার প্রত   এত নিষ্ঠুর কি করে হতে পারলে তুমি” ? সুমনার জবাব, “কেন, সুমিতা তো আছে ওর দেখাশোনা করার জন্য, ওর 
সেবা
 যত্ন করার জন্য । ভালবেসে ওকে ভরিয়ে দেবার জন্য । আমাকে ওর আর কি প্রয়োজন” ? 
অনির্বাণ বলে, “কোন সুমিতা” ? সুমনার গলায় ঝাঁজ, “বন্ধুর সম্বন্ধে এত কিছু জানো আর সুমিতাকে জানো
 
না ? এটা
  আমাকে বিশ্বাস করতে হবে ? তোমরা পুরুষরা সবাই এক  রকম । কতই না ভালবাসতাম আমি শুভময়কে। কত স্বপ্নই না দেখতাম ওকে ঘিরে । কত আশায় না বুক বেঁধেছিলাম 
ওকে সঙ্গে নিয়ে। আর সেই কিনা এভাবে এমন মূল্য দিল আমার ভালোবাসার ? মানুষ এমনও হতে পারে ? এই ভাবে এত
  দিনের ভালবাসার অপমৃত্যু ঘটবে” ? অনির্বাণ সুমনাকে থমিয়ে দিতে বলে, “থামো, থামো, ভুল বোঝাবুঝির আসল কারণটা মনে হয় বুঝতে পারছি। আচ্ছা, তুমি সুমিতাকে চেনো” ? সুমনার জবাব,  
 “হ্যাঁ, চিনি বইকি । বেশ কিছুদিন ধরেই আমি লক্ষ্য করছি শুভময় সব সময় কি একটা যেন আমার কাছ থেকে  আড়াল করে চলতে চাইছে”। অনির্বাণের প্রশ্ন, “ওকে কোনদিন প্রশ্ন করোনি এ নিয়ে” ? সুমনার উত্তর, “প্রশ্ন করা অবান্তর আর তা ছাড়া প্রশ্ন করেই বাকী লাভ ? শুভময়ের বাড়ীতে গিয়ে ওর ঘরে ঢোকামাত্র একটি মেয়ে তক্ষুনি ভিতরে চলে গেল । এক পলকে তার মুখটা আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম । ওর সম্বন্ধে জানতে চাইলে শুভময় শুধু বললো, ‘ও সুমিতা -- আমার বন্ধু’। তারপর আরও  অনেকদিন এমন হয়েছে, ওর প্রসঙ্গ তুলতে চাইলেও শুভময়সযত্নে তা এড়িয়ে গেছে, সুমিতাকে সামনে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা” । অনির্বাণ বলে, “তাই তুমি ধরে নিলে সুমিতার সাথে শুভময়ের কিছু একট  ব্যাপার আছে যা তোমার কাছ থেকে ও গোপন রাখতে চায়” । সুমনা বলে, “ওর ঐ লুকোচুরি খেলাটাই তো আমাকে ভাবতে বাধ্য 
করেছে।
 আমার মনে হয়েছে আমাকে ওর আর ভাল লাগে না, ভালবাসে না আমাকে আর একটুও।পর পর তিন দিন সময় দিয়েও ও আসেনি আমার কাছে অথচ আমি জানতে পেরেছি ঐ তিনদিন ও সুমিতাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে আর অনেক রাত্রে বাড়ী ফিরেছে।এ নিয়ে প্রশ্ন করায় ও কোন জবাব না দিয়ে এড়িয়ে গেছে”। অনির্বাণের প্রশ্ন, “তারপর” ? সুম্না বলে, “তারপর আর কি ? আমি ভালই বুঝতে পারলাম আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে । আমার মন, মানসিকতা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসার অপমৃত্যু ঘটে গেছে। তাই মনে মনে ভাবলাম ওর  যাতে সুখ, তাতে কেন আমি অন্তরায় হই ? তাই ওকে আমি  চিরমুক্তি দিয়ে চলে এসেছি” । ওদের এই কথাবার্তার মাঝখানেই একজন সুন্দরী, সুবেশা তরুনী ওদের কেবিনের পর্দা সরিয়ে সটান ভিতরে ঢুকে পড়লো । হাতে তার একটা বড় প্যাকেট । ঢুকেই সে অনির্বাণকে উদ্দেশ্য করে বললো, এই নাও ধরো, কার্ডগুলো নিয়ে এলাম। দেখেশুনে নাও সব ঠিক আছে কি না । আরে, তুমি সুমনা না ? তোমার  কথা অনেক শুনেছি শুভময়দার মুখে।দেখতো কার্ডটা কেমন হয়েছে” ? “কী কার্ড, ওমা বিয়ের কার্ড। অনির্বাণ ওয়েডস সুমিতা। তার মানে তোমার সাথে অনির্বাণের বিয়ে” ? সুমিতা বলে “হ্যাঁ গো সুমনা ম্যাডাম। আমাদের বিয়েতে তোমাদের দুজনকে আসতেই হবে আগে থেকে বলে রাখলাম”। 
 
কিন্তু সুমিতার কোন কথাই তখন আর সুমনার কানে ঢুকছিলোনা । মনে মনে বলছিল এই তো
 সেই সুমিতা যাকে সে শুভময়ের বাড়ীতে দেখেছিল, যে অনির্বাণের বাগদত্তা, যার সাথে অনির্বাণের বিয়ে হতে যাচ্ছে আর কয়েক দিন পরেই । এ কী হয়ে গেল ? যারসাথে জড়িয়ে শুভময়কে সন্দেহ করে তার এমন অবস্থা করলো সে, তার বিয়ে অনির্বাণেরসাথে ? এ কী করলো সে , নিছক সন্দেহের বশে তাকে এত বড় আঘাত কিভাবে দিতে পারলো ? কিন্তু সুমিতাকে নিয়ে শুভময়ের অমন লুকোচুরি খেলার মানেটা তাহলে কি ছিল ? এখন কি হবে ? দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে ওর বুক ভাসিয়ে দিল । সুমিতা আর অনির্বাণ গভীর আগ্রহ আর সমবেদনায় ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো । অনির্বাণই মুখ খুললো, “কী হল সুমনা ? কাঁদছো কেন তুমি ? কি হল তোমার” ? সুমনার আক্ষেপ, “আমার সব শেষ হয়ে গেল অনির্বাণ। নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনলাম । বিচার বুদ্ধি সব হারিয়ে আমি   নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গেলাম । এখন তো আমার আর দাঁড়াবারও জায়গা নাই । নিশ্চিন্ত আশ্রয়টাও আমার হারিয়ে গেল । আচ্ছা অনির্বাণ, একটা কথা বলতো সুমিতা তাহলে ওর বাড়ীতে কি করতো আর ওই বা কেন আমার সামনে ওকে এমন আড়াল করে চলতো” ? অনির্বাণ বলে, “তবে শোন, সেই ছোট বেলায় মা, বাবাকে হারিয়ে সুমিতা মামার বাড়ীতে মানুষ,ওর মামী ওকে একেবারেই সহ্য করতে পারতো না। মামা তাকে ভালবাসলেও মামীর কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস তার ছিল না । বড় হয়ে ওঠার পর ওরা সুমিতাকে বোঝা বলে মনে করতো । আপদ বিদেয় করার জন্য ওরা তিন সন্তানের জনক বিপত্নীক একটা লোকের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলো। সুমিতা  আর আমার মধ্যে অনেক দিনের ভালবাসা, ঠিক সময়ে খবর পেয়ে সুমিতাকে নিয়ে চলে আসি। ওকে শুভময়ের বাড়ীতে লুকিয়ে রাখি। পরে একদিন  রেজিস্ট্রি বিয়ে করে এখন সামাজিক বিয়ে হতে যাচ্ছে”। অনির্বাণ আরও জানায় ----- 
“শুভময় কে অনুরোধ করেছিলাম সুমিতা যে ওর বাড়ীতে আছে কেউই যেন জানতে না পারে। ও যে
 
তোমাকেও কিছু বলবে না, ভাবতে পারিনি। ওর কোন
  দোষ নেই। "কেউই যেন জানতে না পারে", এই 
কথাটা ও তোমার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করবে ভাবা যায় না। আমার অনুরোধটা ও অক্ষরে অক্ষরে পালন
 করেছে”।
 
অনির্বাণের কথাগুলো শুনে সুমনা হতবাক হয়ে যায় । এতকাল তবে সে শুভময়কে কতটুকু 
চিনলো ? অবুঝের মত ব্যবহার করে ওকে এত বড় আঘাত দেবার পর তার সামনে এখন আর সে দাঁড়াবে কেমন করে, কোন মুখ নিয়ে ? সে ঝরঝর করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে । চোখের সামনে যেন তার স্বপ্নময় কল্পনার জগৎটা ধ্বংস হয়ে গেছে, আর তার কারণ সে নিজেই । কেমন করে জোড়া লাগাবে সে আবার ? কেমন করে, কোনমুখে সে আবার তাকে বলবে, "আমায় ক্ষমা করে দাও, আমার ভুল হয়ে গেছে, আমি তোমায় ভীষণ ভীষণ ভালবাসি"। সুমনা শুধু কাঁদতেই থাকে।অনির্বাণ বলে -“এত ভেঙ্গে পড়ছো কেন ? তোমার কিছুই হারায়নি। সব
 ঠিক আছে আগের মতই”। সুমনার কাতর জিজ্ঞাসা “কিন্তু কেমন করে ফিরে পাবো সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ? কেমন করে ফিরে আসবে সেই জীবনটা” ? অনির্বাণ আশ্বাস দেয় সুমনাকে “তুমি একবার, শুধু একটিবার শুভময়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াও, দেখবে কিছুই হারায়নি তোমার। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে আমি চিনি, আর তার চেয়ে অনেকবেশী চেনো তুমি। তুমি যাও, ওকে বাঁচাও আর নিজেও। বাঁচো” । 
 
সুমনার চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার। বুকের ভিতরটা তার যেন হাহাকারে ভরে গেছে। সুমনা আর এক মুহূর্ত দেরী করে না।দৌড়ে বেরিয়ে যায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য, দিশেহারা হয়ে শুভময়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।