গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

সুবীর কুমার রায়


অতি সাবধানতার ফসল


সালটা ১৯৮০, আমরা সাতজন হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সাথে বাবা, মা, দুই বন্ধু, ও এক নিঃসন্তান প্রতিবেশী দাদা-বৌদি। মাঝপথে চাম্বাতে বয়স্ক চারজনকে হোটেলে রেখে, দুই বন্ধুকে নিয়ে মণিমহেশ ট্রেক করার পরিকল্পনা।
যেকোন ভ্রমণেই ছোট বড় কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হতেই হয়, এটাকে চিরকালই ভ্রমণের অঙ্গ হিসাবেই মেনে এসেছি। পরিকল্পনা মতো সমস্ত জায়গা ঘুরে মানালি থেকে চন্ডিগড় যাওয়ার পথে, ঘটলো সেই অযাচিত ভয়ানক বিপদটি।
মানালি থেকে বাসে চন্ডিগড় গিয়ে, চন্ডিগড় শহরে দুটো দিন থেকে শহরটা ঘুরে দেখে, কালকা হয়ে ফিরে আসার কথা। সেইমতো দু’দিন আগেই একটা লাকসারি বাসে দু’টো দু’জনের বসার, ও একটা তিনজন বসার  সিট্ পুরো টাকা দিয়ে রিজার্ভ করে রেখেছি। সে যাইহোক, বেশ সকালেই আমাদের বাস ছাড়ার কথা, সেইমতো অনেক আগেই আমরা মালপত্র নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হাজির হলাম। সুন্দর আবহাওয়ায় ঘন নীল আকাশের নীচে, মানালি শহরটি ভোরের আলোয় এক অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে যেন আমাদের বিদায় জানাবার অপেক্ষায় রয়েছে।
এখনকার মতো সেইসব দিনে পরিবহনের এতো সুযোগ সুবিধা ছিল না। মোটর গাড়ি ভাড়া করে এক জায়গা থেকে অপর জায়গা যাওয়ার সুযোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা, দু’টোরই আমার বেশ অভাব ছিল। নির্দিষ্ট  সময়ের বেশ আগেই ঝাঁচকচকে বিশাল বাসটা এসে দাঁড়ালো। আমার স্বভাব ছিল বাসের ভিতর মালপত্র রাখা সম্ভব না হলে, বাসের ছাদে মালপত্র নিজে তুলে সাজিয়ে রেখে, একটা পলিথিন শীট দিয়ে ভালো করে মুড়ে রাখা, যাতে বৃষ্টি আসলেও পথে মালপত্র না ভেজে। এবারেও তার অন্যথা হলো না। বন্ধুদের সাহায্যে একে একে সমস্ত মালপত্র বাসের ছাদে তুলে সাজিয়ে রাখলাম। একবারে সামনে বাসের একটা প্রকান্ড চাকা, সম্ভবত স্টেপনি রাখা থাকায়, ঠিক তার পাশে মালপত্র রাখতে হলো। চাকাটার তলায় ভাঁজকরা খাকি রঙের ভীষণ মোটা ত্রিপল রাখা থাকায় সুবিধাই হলো। পলিথিন শীট দিয়ে মালপত্র না ঢেকে, ওই ত্রিপল দিয়েই ঢেকে রাখা অনেক নিরাপদ বিবেচনা করে, চাকার তলা থেকে ত্রিপলের একটা কোণ ধরে টেনে নিয়ে মালপত্র ঢেকে রাখার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। কিন্তু চাকাটা যে অত ভারী, ও ত্রিপলটা যে অত বড়, মোটা ও ভারী, এ ধারণা আমার ছিল না। ত্রিপলটার কিছুটা অংশ টেনে বার করে চাপা দেওয়া সম্ভব হলেও, সমস্ত মালপত্র চাপা দেওয়া সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়ে চাকার সাথে টাগ্ অফ্ ওয়ারের মতো যখন ত্রিপল নিয়ে শক্তি পরীক্ষার লড়াই চলছে, এবং এলোপাথাড়ি ভাবে যখন অনেকটা ত্রিপল চাকামুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়েও এসেছে, তখন বাসের পাশে রাস্তায় দাঁড়ানো একটি বছর ত্রিশের ছেলে, বেশ বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, “এ কেয়া হো রাহা হ্যায়, বাদল্ হুয়া হ্যায় বারিস আ রাহা হায় কেয়া”? কিছু বলার নেই, মেঘমুক্ত নির্মল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ, তাই বাধ্য হয়ে ত্রিপল টানা বন্ধ করে, যতটুকু অংশ চাকার বাইরে টেনে আনা সম্ভব হয়েছে, তাই দিয়েই মালপত্রের কিছুটা অংশ ঢেকে, নীচে নেমে আসলাম। ত্রিপলের অনেকটা অংশই চাকার তলা থেকে বেরিয়ে আসলেও এমনভাবে বেরিয়েছে, যে সেটা দিয়ে মালপত্র ঢাকা বাস্তবে সম্ভব নয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ছেলেটি চালকের আসনে বসে ইঞ্জিন চালু করে বেশ দীপ্ত কন্ঠে আদেশের সুরে বাসের ভিতর ধূমপান করতে বারণ করে দিল। জানা গেল হরিয়ানার এই ছেলেটি নিজেও ধূমপান করে না, অন্য কেউ বাসের ভিতর ধূমপান করুক, এটা সে বরদাস্ত করে না। আমি দু’জন বসার একটা সিটের জানালার ধারে বসেছি, আমার ডানপাশে আমার সেই প্রতিবেশী দাদার মতো ভদ্রলোক। এই ভদ্রলোকটি আবার চেন্ স্মোকার, একটার পর একটা সিগারেট খান। কিছুক্ষণ উসখুস উসখুস করে নেশার তাড়নায় থাকতে না পেরে, ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরানো মাত্রই, ছেলেটি ঠিক গন্ধ পেয়ে বাস দাঁড় করিয়ে দিলো। দেখা গেল বাসে অনেকেই ধূমপায়ী আছেন। সকলের যৌথ অনুরোধে ছেলেটি শেষপর্যন্ত একটু নরম হয়ে কম সিগারেট খাওয়ার ও জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে বাস ছেড়ে দিলো।
সুন্দর আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে বাস বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এখন রোদের তেজও বেশ চড়া। জানালার ধারে বসে আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, জানালার ঠিক ওপরে কি যেন একটা উড়ছে। মাথা বাড়িয়ে দেখেও কিছু নজরে পড়লো না। কিছুক্ষণ পরে দেখি সেই ত্রিপলের কিছুটা ভাঁজকরা অংশ, ছাদ থেকে ঝুলে পড়ে হাওয়ায় কাঁপছে। সেরেছে, কি করা উচিৎ ভাবতে ভাবতেই ত্রিপলটার অনেকটা অংশ নীচের দিকে ঝুলে পড়লো। ঘটনাটা যখন আমারই কারণে ঘটছে, এবং স্বয়ং চালকই যখন এই ঘটনার প্রধান সাক্ষী, তখন তার মতো বদমেজাজি একজন মানুষকে ব্যাপারটা নিজমুখে জানিয়ে, শহিদ হওয়ার সাহস আমার কোথায়? বাধ্য হয়ে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ত্রিপলটা ওপর দিকে চাগিয়ে ধরে বসে রইলাম। বাসের প্রায় সব যাত্রীই তন্দ্রাচ্ছন্ন, বা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে মাধ্যাকর্ষণ, প্রবল হাওয়ার গতি, ও ত্রিপলের বিশাল ভার, আমাকে বেশিক্ষণ ওইভাবে ত্রিপল ধরে রাখতে দেবে না। তবু ত্রিপল টেনেছেন যিনি, ধরে থাকবেন তিনি পথ অবলম্বন করে, আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় ওপর দিকে ঠেলে ধরে থাকলাম। আরও কিছুটা সময় পরে বুঝলাম আমি অ্যাটলাস নই, এই ভার আমার একার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। যন্ত্রণাগ্রস্ত হাতটা বাসের ভিতরে সরিয়ে নিলাম।
মুহুর্তের মধ্যে দেখলাম, ত্রিপলটা ‘হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে দে রে, যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে’ বলে ঠিক পাখির মতোই সম্পূর্ণ ডানা মেলে নীচের দিগন্তের উদ্দেশ্যে উড়ে চলে যাচ্ছে। বামপাশে ইতস্তত পাথর পড়া সবুজ তৃণভূমি অনেকটা নীচু পর্যন্ত নেমে গেছে। হেঁটে অথবা দৌড়েও সেখানে সহজেই নেমে যাওয়া যায়। ভাবলাম বাঁচা গেল, চন্ডিগড়ে চুপচাপ মালপত্র নিয়ে কেটে পড়লেই হলো। কিন্তু আমি কি আর সেই কপাল নিয়ে জন্মেছি? পিছনের সিট থেকে একজন ‘সামান গির গ্যায়া সামান গির গ্যায়া’ করে চিৎকার শুরু করলো। হা ভগবান, তুমি কেন আর সকলের মতো এই লোকটাকেও ঘুম পাড়িয়ে রাখলে না!  
বাসটা তখন বেশ কিছু মিটার পথ এগিয়ে গেছে। পিছনের চিৎকারে মুহুর্তের মধ্যে বাসটা প্রবল বেগে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। এবার বাসটাকে হেল্পার ও কন্ডাকটারের নির্দেশে, পিছিয়ে নিয়ে আসা শুরু হলো। আমার আয়ু এই ধরাধামে আর মাত্র কয়েক মিনিট জেনেও, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন না করে, চোখ বুঝে ঘুমের ভান করে, মনে মনে ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’ গাইবার চেষ্টা করেও নিস্ফল প্রার্থনা বুঝে, মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান গাইতে শুরু করলাম।  
ধীরে ধীরে বাসটা একসময় অকুস্থলের কাছাকাছি পিছিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল। অনেকেই এই সুযোগে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গেলেও, মৃত্যুপথ যাত্রী আমি চোখ পিটপিট করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে, ত্রিপল উদ্ধার পর্ব ও চালকের প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করার চেষ্টা করছি। কন্ডাকটার ও হেল্পার দু’জনে মিলে বাস চালকের নির্দেশে, বহু নীচে ত্রিপল উদ্ধারে প্রায় ছুটে নামতে শুরু করলো। বাস চালক চিৎকার করে হম্বিতম্বি করলেও, ঘুমন্ত ও অর্ধমৃত মানুষের সাথে ডুয়েল লড়াইয়ের পথে না গিয়ে, কিছু খিস্তি খেউড়ের পথকেই সঠিক বিবেচনা করলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন, ত্রিপল উদ্ধার পর্ব সমাপ্ত করে, ভাঁজ করে বাসের ছাদে তুলে রাখতে গেল। আমি আধবোজা চোখে লক্ষ্য রাখতে লাগলাম যে, চালকের রোষে আমাদের মালপত্র না আবার ত্রিপল উদ্ধারে নীচের জমিতে গিয়ে হাজির হয়। বাসের ত্রিপল বাসে ফিরে আসায় পরিস্থিতি ঠান্ডা হলো, চালকও নিজের আসনে গিয়ে বসলো। না, চন্ডিগড়ে গিয়ে মালপত্র বাসের ছাদ থেকে নামাবার সময় দেখলাম, মালপত্র ঠিক আগের জায়গায় আগের মতোই আছে। তাদের ওপর কোন অত্যাচার করা হয়নি।