গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী


বাদলবেলায় আলোর খেলা



অবিনাশ আসলে দলের অন্যতম পেস-বোলার । ব্যাট করতে নামে শেষ ব্যাটসম্যানের আগে ।
কিন্তু সেদিন দিনের শেষে দুই দামী উইকেট পড়ার সাথে-সাথে অধিনায়ক কুলবিন্দার ওকে নামিয়ে দিলো ।
পইপই করে বলল--
- আজ আর উইকেট পড়লে চলবে না । তুমি পারবে । একটু দেখে খেলো ।
কুলবিন্দার অবিনাশের সঙ্গে উইকেটে । যাহোক,ঝড়ের বেগের কিছু বল খেলে দিয়ে অবিনাশ আশ্বস্ত করলো ওর অধিনায়ককে ।
নিজের প্রতি খুশি হয়ে মনে-মনে বলল--
- আমি তবে পারি । দেখি না কাল খেলা শুরু হলে কতটা কি করা যায় । আর কুলুর পরামর্শ তো আজ পাবোই ।
সন্ধে এলো ।
তারপর রাত । রাত গড়াল । অবিনাশ কয়েকবার চেষ্টা করলো অধিনায়ক কুলবিন্দারের সঙ্গে কথা বলার । মানে কিছু পরামর্শ । কিন্তু কুলবিন্দারকে নিরুত্তাপ থেকে ও থমকে গেলো । কখনো তাকে গেলো খুল্লামখুল্লা মেজাজে । তবে সে আউৎ হওয়া দুই ব্যাটসম্যানের সঙ্গেই বেশী ।
খুব মন ভেঙে গেলো অবিনাশের ।
হতাশ হয়ে ভাবতে থাকলো--
- আমি তবে গেছি সকালেই । শিশির-ভেজা কি যে মারাত্মক হয়ে ওঠে ।
ভেবে-ভেবে রাত গেলো অবিনাশের । তবে কখনোই ও অধিনায়কের ওপর রাগ করেনি । বরং সরলভাবে অন্যদের থেকে পরামর্শ চায় । কেউ-কেউ কিছু বলে ।
একেবারে শেষ ব্যাটসম্যান বিরাজ একগাল হেসে ওকে বলে--
তুমি আর আমি মিলে বলের খেল দেখাবো । এত ভাবো কেন ?
ভেবে-ভেবে সেই খেলার সময় এলো । খেলা শুরু হল ।কিন্তু দু'ওভারের মধ্যেই কুলবিন্দারের উইকেট ছিটকে গেলো । তার কাছে ছুটে এলো অবিনাশ ।
তার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বলল--
- আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো । অন্যরাও চেষ্টা করবে নিশ্চয় । তুমি অত ভেবো না । বি রিলাক্স ।
তবে কুলবিন্দার ঘটনার আকস্মিকতায় ওর সঙ্গে কথা না বলে প্যাভিলিয়নের দিকে পা বাড়াল ।
খেলা চলল । শুরু থেকেই পরের ব্যাটসম্যান নবদীপ নিজেই দায়িত্ব নিতে থাকলো ।
অবিনাশকে সে বলল--
- বুদ্ধি করে স্ট্রাইকটা আমি বেশী নেবো । তুমি আমার কথা শুনো ।
কিন্তু এর কিছুপরেই নবদীপ রান-আউট হয়ে গেলো । দোষটা ওর । কিন্তু কটমটে চাউনিটা অবিনাশের দিকে ।
অসহায় অবিনাশ তাকে কিছুই বলতে পারলো না ।
এরপর ঝপাং আর ঝপাং । মানে ঘনঘন উইকেট পড়তে থাকলো । সাত উইকেট পর্যন্ত অবিনাশ ক্রিজে । রান মাত্র কুড়ি । তাতেই বা কি । আছে তো ।
বিদায়ের সময় কেউ কিন্তু অবিনাশকে কিছু বলে যায়নি । ও নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করে পেস-স্পিন দুইই খেলতে থাকলো ।
সহসা বিপক্ষ-দলের এক পেসারের বাউন্সারে অবিনাশ কাঁধে খুব চোট পেলো । ও যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে গেলো । ছুটে এলো অনেকেই ।
আকাশের দিকে একবার চেয়ে অবিনাশ যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখে বলল--
- আমার সামান্য কৃতিত্ব দাম পাবে তো ?
হ্যাঁ,দারুণ দাম চুকিয়েছিল অবিনাশ । আঘাতের জন্য পরের দুই ম্যাচে ও সুযোগ পায়নি । সুস্থ হলে আর ডাক পায়নি ।
প্রেসের কাছে কুল্বিন্দার বিজ্ঞের সুরে বলে--
শুধু বল করলে হবে না । ব্যাটে রান চাই । অমন বোলার পেয়ে গেছি । তাই নতুন করে কিছু ভাবছি না ।
সে খবর পরেরদিন পেপারে দেখে ছলছল চোখে ওর মাকে জিজ্ঞেস করে--
ব্যাটসম্যানদের বল করার দরকার নেই,মা ?
মা ওকে স্নেহের সুরে বলে তখন--
- তুই কেন বলছিস সে আমি বুঝেছি । তবে খুব সত্যি কথা গদা যাদের হাতে থাকে এ জগত তাদেরই জন্য । ভয় দেখিয়ে মন জোগানোর ওই এক অস্ত্র । তবে সুযোগ আসবে । সময়ের অপেক্ষা । তার আগে আমরা দুজন রোজ ব্যাটিং প্র্যাকটিস করবো । কেমন হবে ?
মার কথায় হেসে অস্থির অবিনাশ ।
ও মাকে জড়িয়ে ধরে এক-আকাশ হেসে বলে--
- তুমি আগে বল করে দেখে নিও আমি কতটা মজবুত । তবে মার বলে ছেলে আউট হওয়া ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো ।
বিধবা মার চোখে জল এলো অবিনাশের কথা শুনে । নিজেই অবিনাশের জামার নীচের অংশ দিয়ে ঝুঁকে পড়ে মুছে নিলো ।