ওগো আমার কি সর্বনাশ হল গো।কে কোথায় আছো এসো গো।
মেয়েটাকে আমার জলের মধ্যে থেকে খুঁজে দাও না গো। হে ঠাকুর রক্ষা করো। আমি তোমাকে
বুক চিরে রক্ত দবো মা কালী । মেয়েকে আমার ফিরিয়ে দে মা।মনসা আছাড়ি পাছাড়ি করে কাঁদছে।
চারিদিকে জল থৈ থৈ করছে। নদীর মত বয়ে যাচ্ছে জল। আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে
সবাই। হাউমাউ করে কাঁদছে ভজন,আর পাগলের মত খুঁজছে মেয়েকে। টলে পড়ে যাচ্ছে,
জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে, তবু হাবু ডুবু খেতে খেতে খুঁজছে ।মা বেটিতে শুয়ে ছিল ঝুপড়িতে।
ফিরে এসে ভজন দেখে মনসা একা। কোলের কাছে মেয়ে নেই।মনসা কে ডেকে তুলতেই,ধরফর
করে উঠে পড়ল।তার পর হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে,পাগলের মত খুঁজতে লাগল।কিন্তু কোথাও
পেল না পুটুকে। আশপাশ তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে কিন্তু কোত্থাও
নেই মেয়েটা।
মাস তিনেক আগে সুন্দরবন থেকে মেয়েকে পিজি হাসপাতালে দেখাতে
নিয়ে এসেছিল। রোজ যাতায়াত করা সম্ভব নয় ।তাই যেখানে হোক একটু মাথা গুঁজে রাত কাটাতো
।এমনি করেই, এখানটা জুটে যায় কপালে।প্রথমে তাদের থাকা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল সবাই।এমন
একটা পস এরিয়ায় কিনা বস্তির লোক জনের বাস! সবাই মিলে উৎখাতের চেষ্টা করেছিল।কিন্তু
পারে নি। মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেছে সবাই। ওদের কাছে অনেক রকমের হেল্পও পায় এরা
।কাজের লোক ডুব দিলেই ডাক পড়ে মনসার।দিব্যি সামলে দেয়।ওরাও নিজেদের মত থাকে।কাউকে
বিরক্ত করে না।বাচ্চাটাও বেশ ফুট ফুটে হয়েছে।যেতে আসতে সবাই আদর করে যায়।লজেন্স বিস্কুটও
দেয় কেউ কেউ।
মেয়েটা ভালো হয়ে গেলে তারা গ্রামে ফিরে যাবার কথা ছিল।
কিন্তু দেশে তো ভালো কাজ কর্ম নেই । এক চিলতে জমি জমাও নেই। তাই কলকাতা থেকে ফেরার ইচ্ছা
হচ্ছিল না।ভজন এখানে টুকটাক ভালোই কাজ করছিল ।মেয়েটা একটু বড় হলে,মনসা দুবাড়ি কাজ
দেখে নেবে ঠিক করেছিল ।তারপর এখান থেকে উঠে কোনো বস্তিতে চলে যাবে।কিন্তু একি করলে
ঠাকুর,বলে,ডুকরে কেঁদে উঠল মনসা। কোথায় গেলি পুটু । ফিরে আয় মা।
জলের প্রবল স্রোত।টানা সাত আট দিন ধরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ।গোটা কলকাতা
শহর ভাসছে। রেসটুরেন্টএর ছেলেগুলো পর্যন্ত জলে নেমে তোলপাড় করে ফেলল।কিন্তু এমন ঘূর্ণি
স্রোতে ,কোথায় পাবে সেই এক রত্তি দুধের শিশুকে।
ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে তখনও।আস্তে আস্তে দিনের আলো নিভে
এলো।রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো জ্বলে উঠল একে একে। কেঁদে কেঁদে অসার হয়ে গেছে মনসার
শরীর।ভজন পাগলের মত খুঁজেই চলেছে।তার পর পুলিশ ভ্যান এলো।অনেক খোঁজাখুঁজির পর, রাজবিহারী
পেরিয়ে হাজরা মোড় এর কাছে পাওয়া গেল সেই ছোট্ট মেয়েটির নিথর দেহ। গোটা কলকাতা স্তব্ধ
হয়ে গেছে তখন।পাগলের মত কাঁদছে মনসা ।হায় হায় করছে ভজন। বুকের
মধ্যে হু হু করে রাবণের চিতা জ্বলছে তাদের। এত জল বৃষ্টি মাথায় করেই সেই ক্যামেরা
বাবুরা,মাইক বাবুরা এসেছে।পট পট করে ছবি তুলছে।গাছ তলায় পড়ে থাকা টাটকা বকুল ফুলের
মত, শুয়ে আছে পুটু।রাস্তায় যেতে যেতে কেউ ওর ছবি তুললে কি খুশি ই না হতো মেয়েটা।এখন
এসব কিছুই আর তার নাগাল পাচ্ছে না।মনসার কান্না আর জলের স্রোতের শব্দ পাক খেতে খেতে
সো সো করে চলে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে।যেদিকে সুন্দর বন। পুটুদের গ্রাম ।