গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

তাপসকিরণ রায়


ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী৪৫

কল্যাণীর গঙ্গাঘাট



শশীভূষণ মোবাইলের লাইট জ্বাললেন। চোখের পলকে মনে হল যেন সাদা একটা ছায়া আড়ালে চলে গেল। অর্ণব চিৎকার করে উঠলেন, ভুত ভুত ভু...
কল্যাণীর গঙ্গার ঘাটের ভূতের উপদ্রবের কথা অনেক কম লোকেই জানে। এখানে  গঙ্গার পারে  প্রতি অমাবস্যা, এমন কি পূর্ণিমা রাতেও নাকি ভূতের আড্ডা বসে।  গঙ্গা পারের কাছাকাছি ছিল দু'তিনটে মাটির দেওয়ালের উপরে টিনের চাল দেওয়া ঘর।  ঘরের বাসিন্দারা ভূতের ভয়ে নিজেদের ঘর ছেড়ে দিয়ে পালতে বাধ্য হয়েছে। অর্ণবের পুরনো অফিসের এক বন্ধু তাঁকে কল্যাণীর গঙ্গাঘাটের ভৌতিক ঘটনাটার  কথা বলেছিল। পূর্ণিমা  অমাবস্যার গভীর রাতে গঙ্গা পারে বাসিন্দারা নাকি শুনতে পেত বেশ কিছু লোক গঙ্গার পারে এসে জড়ো হয়েছে। ওদের কথাবার্তা চলছে, হাসছে, কখনও চিৎকার করছে। শুরুতে একজন লোক নাকি ঘাটের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করেছিল। কাছে যেতেই সে দেখল জাগাটা হঠাৎ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়েগেল। একটু আগে যেখানে হ্যারিকেন  ল্যাম্পের মোটামুটি আলো ছিল সেখানে এখন অন্ধকার ! কেউ নেই সেখানে। ভয় পেয়ে সে লোকটা তখন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। পরের দিন সকালে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ঘরে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল। লোকটা আর কথা বলতে পারত না, শুধু  দিক  দিক তাকিয়ে থাকত। সারাদিন পাগলের মত বিড়বিড় করে বেড়াত। তারপর বহুদিন আর কোন ঘটনা ঘটল না। আর ঘটলেও ভয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে কেউ কিছু দেখার সাহস করেনি।
 ঘটনার বেশ কিছু দিন পর ওই ঝুপড়ির একজন নিজের ছেলেকে নিয়ে নদীর পারে গিয়েছিল। তখন সবে সন্ধ্যে হয়েছিল, লোকটা ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলে অনতিদূরে নদীর পারে পায়খানা করতে বসেছিল। লোকটা একটু পরে ঝুপ  করে নদীর জলে কিছু পতনের শব্দ শুনতে পেলো। আচমকা ভয় পেয়ে লোকটা চীৎকার দিয়ে ডেকে উঠল, কোথায় রে বাপ্ ! কি হল ?
ছেলের আর সাড়া পাওয়া গেল না। লোকটা চীৎকার দিয়ে ছেলের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। চীৎকার শুনে আশপাশের সবাই আলো, মশাল নিয়ে নদী পারে ছুটে এলো। খোঁজ খোঁজ কিন্তু জলে ডাঙায় কোথাও আর সে ছেলেকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। তারপর আর একদিন, নদীর পারের বাসিন্দারা এক রাতে দেখতে পেল নদীপারে  যেন কোন মিটিং চলছে। দস্তুর মত ভূত-প্রেতদের মিটিং। ভূতের চাপা চীৎকার শোনা যাচ্ছিল। ভুতুড়ে পরিবেশের মাঝে মাঝে কথাবার্তা, বাকবিতণ্ডা চলছিল। স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শুধু শব্দ  ছায়ার উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। এমনি সব ঘটনা দেখতে দেখতে নদী পারের লোকদের মনের মধ্যে ভীষণ ভয় ঢুকে গেল। শেষ পর্যন্ত ওরা নদী পারের ঘর ছেড়ে দিয়ে সবাই অন্যত্র কোথাও চলে গেল। এই পর্যন্ত ছিল অর্ণবের সেই বন্ধুর গল্প বিবৃতি। তারপর জনান্তিক খোঁজখবর নিয়ে এসে শশীভূষণ কে বললেন, শশী, মনে হচ্ছে অর্ণবের বন্ধু সত্য কথাই বলেছে। আমি কল্যাণীর এক জনের কাছে জানতে পারলাম গঙ্গার পারের সে সব ঘটনা নাকি সত্য। বর্তমানে দু তিনটে পাকা বাড়ি সেখানে হয়েছে বটে তবে সে সব ঘরের লোকজনরা নাকি সন্ধ্যের পর থেকেই ভয়ে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর পড়ে থাকে।
তিন বন্ধুর শিয়ালদা থেকে কল্যাণী যখন এসে পৌঁছালেন তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে। স্টেশন থেকে এত রাতে গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। কেউ বুঝি সেই ভুতুড়ে রাজ্যে যেতে চায় না। প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পর প্রায় ডাবল পয়সায় এক অটো ঠিক করা হল। ওরা যখন গঙ্গা পারের কাছাকাছি এসে পৌঁছল তখন রাত বারোটার বেশী হয়ে গেছে। গঙ্গা ঘাটের পারের পাকা বাড়ির কাছে এসে অটোওয়ালা বলল, আমি আর যেতে পারবো না--আপনারা এখানেই নামুন !
অর্ণব বললেন--আরেকটু চল না, গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দাও--
অটোআলা বলল, ওরে বাবা, আমায় মাফ করবেন, আমি যেতে পারবো না--মনে হল অটোচালকের গলা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। শশীভূষণ ওঁরা অগত্যা সেখানে নেমে পড়লেন। ঘাট খুব একটা বেশি দূরে নয়। রাতের নির্জনতা জলের ক্ষীণ আওয়াজ কানে এসে বাজছিল। বন্ধুরা জলের আওয়াজ ধরে সে দিকে হাঁটছিলেন। তিন জনের মোবাইল টর্চ বারবার জ্বলে উঠছিল। অর্ণব ভয়ে দুই বন্ধুর মাঝখানে ঢুকে পড়েছেন। ওই যে গঙ্গার ঘাট। রাত বারোটার পর আকাশের এক কোনায় এক টুকরো চাঁদ যেন লটকে আছে। তার ছাইরঙা আলোয়  আশপাশের কোন দৃশ্য স্পষ্ট হতে পারছে না। এক দিকে অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার, অন্যদিকে মৃতপ্রায় চাঁদ আকাশে ঝুলে আছে। আলো অন্ধকারের মাঝখানের এক ঘোলাটে মত অবস্থা, চার দিকের বাস্তবতাকে যেন অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বন্ধুদের মনে হচ্ছিল, ওঁরা বুঝি স্বপ্ন দেখছেন, ওঁরা বুঝি স্বপ্নের মাঝে কোন গ্রহান্তরের দৃশ্য দেখে চলেছেন। কোন ম্যাজিক জাদু কাঠির ছোঁয়ায় ওঁরা যেন অন্য কোন নির্জন গ্রহে এসে হাজির হয়েছেন। ওঁদের চেতনা ছিল বড় অস্পষ্ট, ওঁরা যেন নিজেদের অস্তিত্ব ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলেন !  ভাবেই অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। হঠাৎ শশীভূষণ নিজের মধ্যে কেমন একটা শিহরণ অনুভব করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সম্বিৎ ফিরে এলো। তিনি বন্ধুদের দু হাত আগলে দাঁড় করালেন, বললেন,  আর না, এবার আমাদের ফিরতে হবে ! খানিক স্তব্ধতার পর জনান্তিক ক্ষীণ আওয়াজে বললেন, কিছু যে দেখা হল না !
শশী ধীর গলায় বলে উঠলেন--কিন্তু অনুভবে তোর কি কিছুই মনে হচ্ছে না যে আমরা অবাস্তব কোন জাগায় দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ! এভাবে চললে আমাদের অস্তিত্ব যে আর আমরা খুঁজে পাবো না ! মনে হচ্ছে আমরা কেমন যেন তন্দ্রায়িত আচ্ছন্ন ঘুমে মধ্যে পড়ে আছি। আর এভাবেই আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ! না কোন দৃশ্য, না কোন শব্দ সঙ্কেত, সত্যি ওঁরা যেন ক্রমশ শেষ ঘুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আসলে এটাই একটা বড় অলৌকিকতা একটা অলৌকিক ভাবের মধ্যে দিয়েই তো তাঁরা হেঁটে চলেছিলেন !
শশীভূষণ নিজেকে জোর করে যেন দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তারপর শরীরটাকে একবার ঝাঁকিয়ে নিলেন তিনি। জনান্তিকও তাই করলেন। ওঁরা যেন এবার বাস্তবতায় ফিরে এলেন। অর্ণব তখনও ঘোরের মাঝে হেঁটে যাচ্ছেন নদীর কিনারা ধরে। শশীভূষণ  জনান্তিক ছুটে গেলেন অর্ণবের কাছে। অর্ণবের  সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে বাধা দিলেন। অর্ণব ঘোরের ভাব নিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি যেন কোন দিনও তার সামনে দাঁড়ানো লোক দুটোকে দেখেননি ! শীভূষণ অর্ণবকে ধরে হঠাৎ দুবার ঝাঁকিয়ে দিলেন। কাজ হল ঝাঁকুনিতে। অর্ণব ওদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,  তোরা ? তার পরমুহূর্তে অর্ণব চারদিকে তাকাতে লাগলেন, তাঁর কাছে  জাগাটা  কেমন যেন অপরিচিত বলে মনে হচ্ছিল ! এই জায়গা--আমরা কোথায় ? অর্ণব অবাক কণ্ঠে বলে উঠলেন।
কিছু সময় বিহ্বল থাকার পর ধীরে ধীরে সম্বিত ফিরে পেলেন অর্ণব। তিন বন্ধু এবার ফিরে যাচ্ছেন। মোবাইলটর্চ বহু সময় ধরে জ্বালাবার কথা কারও মনে আসেনি কেন কে জানে !  বেশ কিছু সময় মোবাইল নামক বস্তুটা যেন তাদের কাছে অজানাই থেকে গিয়ে ছিল। এক সময় তাঁরা দেখতে পেলেন, তাঁদের সামনে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কয়েকটা ঘরের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে।  চালাহীন ঘরগুলির বেশিরভাগ মাটির তৈরি দেওয়ালগুলি ধসে পড়েছে। বন্ধুরা বুঝলেন যে এগুলিই সেই পরিত্যক্ত ঘরগুলি যেগুলির বাসিন্দারা ভয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ঘরগুলি যেন এক বিরান ভূমির কোন প্রাগৈতিহাসিক চিহ্ন হয়ে পড়ে আছে।
শশীভূষণ কি মনে হল, তিনি চুপচাপ ওই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে বন্ধুরাও তাঁকে অনুসরণ করে সে ঘরে ঢুকলেন। সবাই বাকশূন্য হয়ে আছেন। কেন ? তা বোঝা গেল না। শশীভূষণ মোবাইলের লাইট জানলেন আর চোখের পলকে ঘটে গেল একটা ঘটনা। একটা সাদা মানুষ আকৃতির ছায়া হঠাৎ ঘরের ভাঙা দেয়ালের কোন থেকে যেন আড়ালে সরে গেল !
অর্ণব আচমকা চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ভুত ভুত ভু...আর কিছু নেই--আর কোন  ছায়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না।
বন্ধুরা ফিরে আসছেন। মোবাইল ঘড়িতে তখন রাত চারটা বাজে। শেষরাতে ওঁরাও বড় ক্লান্ত অবসন্ন। অর্ণব কলের পুতুলের মত হেঁটে চলেছেন। এখন কোন গাড়ি পাওয়া যাবে না। হেঁটে যেতে হবে স্টেশন। আজের ঘটনার পর শশিভূষণের  অভিজ্ঞতা যেন আরও অনেক বেড়ে গেল। তাঁর মনে হল, আজের অভিজ্ঞতা যেন ছিল অন্য এক রকম। ছায়া দর্শন, শব্দ শ্রবণ,  সব কিছু অলৌকিকতা তো বটেই কিন্তু ভাবনার মধ্যে দিয়ে এক অন্য পৃথিবী ঘুরে আসা সে যে এক অভিনব চমৎকারী অলৌকিকতা !