গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

বৈশাখী চক্রবর্তী


ভুল হিসেবের পলাশ  


ছোটবেলায় আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিল অবন্তী,অবন্তী বসুরায়। ওর সঙ্গে আমার আমার অনেক অমিল ছিল তবু আমরা বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম। আসলে ওর জন্য আমার মনে একটা কেমন কষ্ট ছিল। আমার কেবলই মনে হত আমার বাবা-মা আমাকে যতটা ভালবাসে,অবন্তীকে আন্টি-আঙ্কেল ততটা বাসে না। একবার ওর জন্মদিনে ওদের বাড়ি গেলে অবন্তী ওর ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। ওর আলাদা ঘর। কী সুন্দর সাজানো! দেওয়ালের সঙ্গে রঙ ম্যাচ করা আসবাব,ঘরের এক কোণে বেতের দোলনা। ছোট্ট বিছানার মাথার দিকের দেওয়াল জুড়ে ডোনাল্ড ডাক ও তার ফ্যামিলির ছবি সঙ্গে পুকুর,গাছ ,ফুল কত কী আঁকা। কত টেডি,কত বার্বি সাজানো! তবু কেমন যেন কষ্ট হয়েছিল। ও একা একা শোয়,আমার মত বাবা আর মায়ের মাঝখানে শোয় না। তার মানে আঙ্কেল বাবার মত গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয় না।আন্টি আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় না। আচ্ছা ওর ভয় করে না? ভাবতাম আর ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিতাম। অবন্তীকে টিফিনের সময় জিজ্ঞেস করতাম। অবন্তী হাসতো। হাসলে ওকে খুব মিষ্টি দেখাতো। ‘ভয় পাবো কেন?বাপি বলছে—‘ রাক্ষস খোক্ষস ভূত পেত্নী বলে কিছুই হয় না। আর বাড়ির বাইরে পাহারা  তো আছেই।’
‘আমার তো ঘুমই আসবে না মায়ের কাছে না শুলে,বাবার কাছে গল্প না শুনলে। বাবা কত গল্প বলে জানিস?’
অবন্তী দুষ্টু নয়,পড়াশনাতেও খুব ভালো,খুব সুন্দর নাচে তবু ওকে আঙ্কেল-আন্টি শাস্তি দিল কেন? আমার কথা শুনে একদিন অবন্তী আমাকে ফিসফিস করে বললো—‘ বড়দের কারণ,কাউকে বলবি না বল? তাহলে বলবো। ’
‘না না,প্রমিস। কাউকে বলবো না। ’
‘আগে আমিও বাপি-মাম্মার কাছেই শুতাম,তোর মতো মাঝখানে নয় বিছানার দেওয়ালের দিকে। ’
‘তারপর—’
‘আমাদের খাটটা পুরোনো ছিল তো মাঝে মাঝেই নড়তো,আমি নড়েচড়ে উঠলেই মায়ের হাত এসে থাবড়ে দিত আমায়। আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। একদিন খাটটা দুলছে,নড়ছে,আমি বোধহয় ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম।
 ভয় পেয়ে উঠে বসেছি। দেখি—’
‘কী?’
‘কাউকে বলবি না বল?’
‘প্রমিস করলাম তো।’
‘দেখি বাপি না মাম্মির ওপর। বাপি যেন ঘোড়া চালাচ্ছে। মা কষ্ট পাচ্ছে। আর দুজনেই—’
‘দুজনেই?’
‘ন্যাংটো। তুই কিন্তু প্রমিস করেছিস,কাউকে বলবি না। বাপি ছিটকে গেছিল আমাকে জাগা দেখে। মাম্মি বলেছিল বাজে স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তারপর থেকে যতদিন ও বাড়িতে ছিলাম দাদুন-ঠাম্মির কাছে শুতাম আর এখানে তো আমার নিজেরই ঘর। ’
অবন্তীর জন্য তাই আমার কষ্ট হত। তারপর একদিন মা আমাকে বললো আমার জন্য মা একটা ভাই আনবে। আমি বললাম—‘ভাই কেন ?একটা বোন হলে কত সাজাতে পারি। বোন বেশি ভালো।তুমি যখন দোকান থেকেই ভাই আনবে?তাহলে ভাই না এনে ফুটফুটে একটা বোনই এনো।
 
মা বললো—‘ রাজা-রানীর এক রাজকন্যা আর এক রাজপুত্তু। দুই ভাইবোনে খেলা হবে। দোকান থেকে নয় তো,ঠাকুর দিয়েছেন, এই আমার পেটের মধ‍্যে আছে।তিনি যেমন ভাল মনে করবেন তেমন‌ই দেবেন ।’
‘ঠাকুর ভাইই দেবেন তুমি জানলে কী করে?’
‘রাজা আর রানী যে চাইলো,তাদের পুত্র সন্তান আসুক। ’
মা বললো আমার জন্য ভাই, কিন্তু আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারলাম আসলে আমার আদরের ভাগীদার এসে গেছে। আমারও ঘর বিছানা আলাদা হল। মানুদিদি আমার ঘরে মেঝেতে শুতো।আমার ঘরটা অবশ‍্য অবন্তীর মত সুন্দর নয়।
    একসময় আমি বড় হয়ে গেলাম,ধুমধাম করে একদিন আমার রাজা এলো।
      আমি নতুন নতুন আদর শিখলাম। নতুন করে চাঁদের আলোর উষ্ণতা মাখলাম,নতুন করে ভিজলাম বৃষ্টিতে। নতুন ভীষণ নতুন এক জীবন,নতুন ভালবাসা।

            আমার এখনকার সবচেয়ে  প্রিয় বন্ধু পিয়ালী। ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে। কিন্তু একটু রিজার্ভ। ও কনটেম্পোরারি লিটারেচারের কী একটা বিষয়ে রিসার্চ করছে, তার সঙ্গে পড়ানো তো আছেই। খুবই ব্যস্ত তবু দিনে একবার কথা হয়ই। একদিন, ওর জন্মদিনেই বোধহয়,ওর ফ্ল্যাটে গেছি। ঘুরে ঘুরে দেখছি ওর সাজানো ড্রইং রুম,স্টাডি। আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ওর ঘরে। হ্যাঁ ওর ঘর। ওদের ঘর নয়। ‘বিয়ের বয়স তো মোটে পাঁচ বছর। তবে?’
   পিয়ালী খুব সুন্দর করে বললো—‘তুষার আমাকে ভুলের ভ্রমে রাখেনি। ওর আর ব্রততীর সম্পর্কটা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে। আমি টানাটানি চাই না। ’
‘আলাদা হয়ে যাবি?’
‘আলাদাই তো। ব্রততী আর তুষার প্রায় লিভ ইন এ আছে। আমি সরে যাওয়াই উচিত। সব প্রেমেরই একটা লাইফটাইম আছে বুঝলি।তারপর ঝরে যায়।’
  মনে মনে ভাবলাম বুঝি রে। খুব বুঝি। রাজা এক নতুন রাজ্যের নতুন রাজকন্যার দেখা পেয়েছে। আমি গন্ধ পাই,স্পর্শ পাই না। আমি যে তোর মত চাকরি করি না,আমার সঙ্গে যে আরো একটা ছোট্ট জীবন জড়িয়ে। জানি ভালবাসা ভাগ হয়ে গেছে দিক পাল্টে,কর্তব‍্যটুকু পড়ে আছে তবু অবুঝের মত আঁকড়ে আছি। হয়তো কাল নয় পরশু আমারও ঘর আলাদা হয়ে যাবে।