বিষ
চাঁপার মায়ের নাম শেফালি। শেফালি যে শিউলি ফুলের নাম চাঁপা জানত না। পাড়ার ইশকুলের দিদিমনি শেফালি ফুল মানে শিউলি ফুল বলে দিয়েছিল, তবেই না জানল চাঁপা। চাঁপার বয়স বেশী নয়, এই সবে তেরো পেরিয়ে চোদ্দর ঘরে পা রেখেছে। ঠাকুমা বুড়ি লোকের কাছে বলে দশ। হি হি...এত হাসি পায়! পাড়ার ইশকুলে চার ক্লাস পর্য্যন্ত পড়েছিল, তারপর আর ইশকুলে যায়নি। বই-বেতন লাগে না ঠিকই, উঁচু ক্লাসের দিদিদের পুরনো বই দিদিমনিরা দেয়, তাই দিয়েই চলে যায়। কিন্তু ইশকুলে পড়তে গেলে একটা গোটা জামাও তো চাই! এমনিতেই ছেলে-ছোকরারা ঘুরঘুর করে, গায়ে জামা না থাকলে তো কথাই নেই! চাঁপার একটাও জামা ছিল না তখন। এখন মায়ের লাহা বাবুদের বাড়িতে কাজ হয়ে জামা পরতে পেয়েছে। আগে ছেঁড়া গামছা গায়ে দিয়ে থাকত। লাহা বাবুরা টাকা ভাল দেয়। খাটনি আছে, কিন্তু পুষিয়ে দেয়। পুজোর সময় বৌ-বিটিরা এলে এটা সেটা দিয়ে যায়। কিন্তু লাহা গিন্নির ভারি মুখ। মাঝে মাঝেই লেগে যায়।
চাঁপার মায়ের নাম শেফালি। শেফালি যে শিউলি ফুলের নাম চাঁপা জানত না। পাড়ার ইশকুলের দিদিমনি শেফালি ফুল মানে শিউলি ফুল বলে দিয়েছিল, তবেই না জানল চাঁপা। চাঁপার বয়স বেশী নয়, এই সবে তেরো পেরিয়ে চোদ্দর ঘরে পা রেখেছে। ঠাকুমা বুড়ি লোকের কাছে বলে দশ। হি হি...এত হাসি পায়! পাড়ার ইশকুলে চার ক্লাস পর্য্যন্ত পড়েছিল, তারপর আর ইশকুলে যায়নি। বই-বেতন লাগে না ঠিকই, উঁচু ক্লাসের দিদিদের পুরনো বই দিদিমনিরা দেয়, তাই দিয়েই চলে যায়। কিন্তু ইশকুলে পড়তে গেলে একটা গোটা জামাও তো চাই! এমনিতেই ছেলে-ছোকরারা ঘুরঘুর করে, গায়ে জামা না থাকলে তো কথাই নেই! চাঁপার একটাও জামা ছিল না তখন। এখন মায়ের লাহা বাবুদের বাড়িতে কাজ হয়ে জামা পরতে পেয়েছে। আগে ছেঁড়া গামছা গায়ে দিয়ে থাকত। লাহা বাবুরা টাকা ভাল দেয়। খাটনি আছে, কিন্তু পুষিয়ে দেয়। পুজোর সময় বৌ-বিটিরা এলে এটা সেটা দিয়ে যায়। কিন্তু লাহা গিন্নির ভারি মুখ। মাঝে মাঝেই লেগে যায়।
চাঁপাদের
তিন বোনের নামই ফুলের নাম। চাঁপাই বড়। মেজবোনের নাম জবা আর ছোটবোনের নাম বকুল। চাঁপার মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল ছেলে হলে নাম রাখবে পলাশ। তা
চাঁপার মায়ের সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি। হয়নি তো হয়নি, তিনটে মেয়ের পরেও আবার একটাকে চাই! আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচিনে!! এই
নিয়েই ঝগড়া চাঁপার ঠাকুমার সঙ্গে ওপাড়ার কেষ্ট লাহার গিন্নির। সেদিন ঠাকুমা গিয়ে
শুনিয়ে দিয়ে এসেছে দুকথা।–তা, আমার
বৌয়ের শখ যদি থাকে, তোমার কিসের এত ইয়ে? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকল, এখনও তো ছেলের বৌ
একটাকেও আনতে পারলে না। আমার বৌ তিনটে মেয়ে লিয়ে এসেছে বলে এত্ত রাগ! মর্...মর্...আমার
বৌ-বিটিকে যে অমন বলে তার মুখে পোকা পড়ুক, শত্তুর...শত্তুর!!
আমার ছেলে থাকলে আরো দুটো হত, তোর তাতে কি?”
চাঁপার
অবশ্য এইধরণের গালাগাল ঠিক পছন্দ নয়। কিন্তু বললেই শুনছে কে?
ঠাকুমার যা মুখ। ঠাকুমাকে ভয় পায় ওরা তিন বোনেই। লাহা গিন্নির
চাকরিটাও মায়ের এবার বোধহয় গেল, গেলে খাবে কি? এত মুখ মনিব সইবে কেন? তাও আবার ছেলে না হওয়ার
খোঁটা-- চাঁপার মা’ও ভাবে মনে মনে। কত বাড়িই যে ঘুরেছে, এই
বুড়ির জ্বালায়। যেখানে
কাজ পাবে, সেখানেই বুড়ি ছুটবে। আগে ভাগে জেনে নেবে মাইনে কত, কি
দেবে-থোবে। দুটো পয়সা যে বাঁচিয়ে রাখবে, তা দেবে না বুড়ি।
‘লোককে গাল দিস, তুই মরতে পারিস
না, মরলে হাড় জুড়োয়’ চাঁপার মা
ভাবে মনে মনে।
চাঁপাদের
বাপ নেই। বাপ রাস্তার ওপারে চটকলে কাজ
করত। কাজ আবার কি! শুধু তো মদ গিলতে আর জুয়া খেলতে যাওয়া আর রেতের বেলায় এসে চাঁপার মায়ের সঙ্গে
ঝগড়া, লাঠালাঠি। এক রাতে চাঁপা নিজেও দেখেছে
রান্নাঘরের বেলুনি নিয়ে এসে মা’কে মারতে। ভয়ে ককিয়ে
উঠেছিল চাঁপা। ঠাকুমা বুড়ি মুখচাপা দিয়ে নিয়ে গেল বাইরে গজগজ করতে করতে—পুরুষের রাগ অত ধরলে কি আর চলে!’ বাপ মরে গিয়ে মায়ের মারধোর
কমেছে বটে কিন্তু ঠাকুমা বুড়ির চিৎকার কম নয়। তবে হ্যাঁ,
তাদের কিছু বলে না। নইলে মা কি তিন বোনকে রেখে কাজে যেতে পারত!
লোকে বলে মেয়ে হলে সংসারে তার দাম কমে যায়। কিন্তু ঠাকুমার যত দোষই থাক, তাদের তিন বোনকে বুকে আগলে রাখে। সময়মত খাওয়াদাওয়া জোটে না, মাথার চুলে তেল পড়ে না। তবু চাঁপা যে দিন দিন দেখতে বেশ ডাগরটি হচ্ছে বোঝা যায়। কি করে
বোঝে? কি করে আবার, রাস্তা দিয়ে গেলে লোকে
কেমন করে তাকায়। শুধু রাস্তার লোক কেন, এই তো গেল
বিষ্যুদবারে লাহা গিন্নিকে পূজার ফুল দিতে গিয়ে লাহা বাবুই তো বললে—চাঁপা যে!
বাবা বেশ বড় হয়ে গেছিস তো। তা কাজকর্ম কিছু শিখলি, নাকি ঘরে বসে থাকিস। মায়ের সঙ্গে এসে দুটো কাজও তো করে দিতে পারিস।‘
তাই শুনতে পেয়ে লাহা গিন্নি বলে উঠল---ও কেন কাজ করতে যাবে,
এইটুকু মেয়ে। আজকালকার
দিনে সবাই লেখাপড়া শিখছে, ও শিখবে না
নাকি? কি রে, চাঁপা”—বলেই চাঁপার দিকে তাকালেন। লাহা বাবু লোকটাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না
চাঁপা। খালি দেখা হলেই ওর বাড়িতে কাজ করতে যাবার জন্য বলবে। লাহা গিন্নি ঝগড়া করুক,
কিন্তু চাঁপার
সঙ্গে কথা কইতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন—যা চাঁপা, তোর কোন কাজ নেই, যা... মা’কে পাঠিয়ে দিস।‘
সেদিন
সাতসকালে মা
গেছে লাহা বাবুর বাড়ি কাজে। চাঁপাকে বলে গেল যাবার সময় রাস্তার কল থেকে দু বালতি
জল এনে রাখতে, মা কাপড় কাচবে। চাঁপা বোন দুটোকে মুড়ির
বাটি দিয়ে বসিয়ে রেখে গেল জল আনতে।
কলতলায় ঠাকুমাকে দেখল দুটো লোকের সঙ্গে কথা কইতে। লোকদুটোকে আগে
দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না চাঁপা। কিছুক্ষণ দূর থেকে দেখার পর নিজের মনেই মাথা
নাড়ল--না, এরা এপাড়ার লোক নয়। তবে এখানে কেন? আর বুড়ির সঙ্গেই বা এতো কথা কিসের? চাঁপা হাঁক
দিল—ঠাকুমা, ঘরকে যাও, বুন দুটো একলা রইছে।‘
ঠাকুমা যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে, এমন করে তাকাল ওর দিকে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল—আয়, ইদিকে আয়’ বলেই সেই লোকদুটোকে বললে—এই আমার বড় লাতিন, চাঁপা। খুব ভালো, কাজে কম্মে...যা বলবেন, সব সুনবে বাবু।‘
ঠাকুমা যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে, এমন করে তাকাল ওর দিকে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল—আয়, ইদিকে আয়’ বলেই সেই লোকদুটোকে বললে—এই আমার বড় লাতিন, চাঁপা। খুব ভালো, কাজে কম্মে...যা বলবেন, সব সুনবে বাবু।‘
ভুরু
কুঁচকে উঠল চাঁপার। ঠাকুমা কি কোন বাড়ি কাজে লাগাবে তাকে?
মা জানলে কুরুক্ষেত্তর। মা বলে দিইছে, আর
কারুকে কাজে লাগাবে না। তবে, বুড়ি কি চাইছে? দুপুরে কাজ সেরে মা এলো বাড়িতে। ততক্ষণে চাঁপা ভাত আর দুটো ধুঁধুল
পুড়িয়ে রেখেছে। লাহা গিন্নি কালকের বাসী মাছ দিয়েছিলো, তাই দিয়ে আজ চলে যাবে।
লাহা গিন্নি জানে, বাড়িতে অনেকগুলো মুখ হাঁ করে আছে,
তাই দেয়-থোয় বেশী করে। এমন মনিবও থাকবে কিনা কে জানে! খাবার পর
ঠাকুমা কি যেন মা’কে ডেকে বললে। আর জ্বলে
উঠল মা---কি, আমার খাবে, আমার
পরবে, আর আমার মেয়েদের লিয়ে তুমি লোককে লোভ দেখাও?
দূর হও এখান থেকে। তুমি কি আমার শাউড়ি, যে
তুমাকে মাথায় করে রাখব? এত্তদিন রেখেছি সেই ঢের, আর না। মাগো, কি কালসাপ পুষেছি ঘরে, রাস্তা থেকে তুলে লিয়ে এসেছিলাম তুমায়, আর
তুমি কিনা...যাও,
আজই বিদেয় হও। আর না, অনেক করেছি তোমার
জন্যি...দুর হও তুমি, এখনি...যাও ‘
রাত
হল। সেদিন আর কোন রান্নাবান্না হল না। চাঁপার মা লাহাবাবুর বাড়ি থেকে কাজ করে এসে
চুপ করে ঘরের দরজায় বসে রইল। বোন দুটো মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। চাঁপা সাহস করে মায়ের
কাছে এগিয়ে এল---মা, ঠাকুমা,আমাদের নয়?’
--না...’
কোন দূর থেকে যেন ভেসে এল মায়ের স্বর।
চাঁপা
মায়ের গাঁ ঘেঁসে বসেছিল। এবার আর থাকতে না পেরে হুহু করে কেঁদে উঠল। ঠাকুমায়ের
জন্য কষ্ট হচ্ছে মা...কেন তাড়ালে?’
মা
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠল—বিষ কেউ হাতের
কাছে রাখে? হয় খায়, নয় ফেলে দেয়?
আমি ফেলে দিইছি। আমার পূজার ফুলের ঘরে উ ধুতরোর বিচি ছিল ....’
বলেই চাঁপাকে কোলের কাছে আঁকড়ে ধরে বসে রইল। কি যেন একটা অজানা ইঙ্গিত চাঁপার মনে খেলা করতে লাগল।
ঠাকুমা কি তাকে কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছিল, লোকগুলান
তবে কে? ঠাকুমা কে, এখানে কি করে
এল? ঠাকুমা কি কাউকে দেবে বলে তাদের আদর-যত্ন করত?
বাপ মরেছে কবে, বুন দুটো .....’
--হে
ভগবান, আর একটু বড় করে দাও, নইলে
বুঝব কি করে?’ মা’কে ধরে সেই
দিনের আশায় চাঁপা বসে রইল আকাশের দিকে তাকিয়ে, মনের ভিতর
বুড়ির জন্য হাহাকার...মায়ের জন্য দুঃখ...
আকাশে
তখন চাঁদ আর মেঘের
খেলা শুরু হয়েছে।