দাদারা তখন
নাটক করার নেশায় মেতেছে।
পন্ডিত স্যারের মেজছেলে, দাদার
প্রাণের বন্ধু অশোকদাও, দাদার
সাথে নাটকের দলে আছে।
আর আছে পন্ডিত স্যারের
সেই ভাইপো, আমার সহপাঠী
বলাই, বা বাবু। এখনকার
মতো তখন নাটকের এত
চল্ ছিল না, দলতো
ছিলই না। যতদুর মনে
পড়ে “বন্ধন” নামে একটা
নাটক সেদিন বড় রাস্তার
ওপর “পাঠ ভবন” নামে
একটা পাবলিক লাইব্রেরীতে সন্ধ্যায়
মঞ্চস্থ হবে। দুপুর থেকেই
দাদা, অশোকদা ও আরও
সকলে নাটক নিয়ে খুব
ব্যস্ত। হলে চেয়ার পাতা,
মাইক বাঁধা, আলোর ব্যবস্থা
করা, জোর কদমে চলছে।
আজকের এই অনুষ্ঠানে পন্ডিত
স্যার প্রধান অতিথির আসন
অলঙ্কিত করবেন।
সন্ধ্যাবেলা দাদা,
অশোকদারা গ্রীনরুমে মেক-আপ
নিয়ে ব্যস্ত। দর্শকরা কার্ড
হাতে হলে ঢুকতে শুরু
করেছে। মাইক্রোফোন হাতে পেয়ে
পর্দার ওপাশ থেকে কে
যেন একই কথা বারবার
ঘোষণা করে চলেছে। ঘোষণার
মাঝেমাঝে, কাম-সেপ্টেম্বর এর
মিউজিকের রেকর্ড বাজানো হচ্ছে।
হলের বাঁধানো মঞ্চে উঠবার
জন্য দু’পাশে সিঁড়ি
রয়েছে। পর্দার পিছন দিয়ে
মঞ্চে যাবার ব্যবস্থা যেমন
থাকে তাতো আছেই। হল
থেকে বাঁধানো মঞ্চ বেশ
উচু। যাহোক্, একসময় মঞ্চের
পর্দা ধীরে ধীরে দু’পাশে সরে গেল।
নিয়ম মতো উদ্বোধন সঙ্গীত
ও দু’-একজনের বক্তৃতার
পর, ঘোষণা করা হলো—
এবার আমাদের প্রধান অতিথি,
শ্রী রবীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য মহাশয়,
কাব্য ব্যকরণ তীর্থ, ইত্যাদি
ইত্যাদি, তাঁর মূল্যবান বক্তব্য
রাখবেন।
পন্ডিত
মশাই মঞ্চে এলেন। তাঁর
সামনে মাইক্রোফোনটা সেট করে
দিয়ে যাওয়া হলো। স্কুলের
পড়ানোর কায়দায় তিনি মাঝেমাঝেই
দুই পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের
ওপর ভর দিয়ে উচু
হচ্ছেন, এবং বক্তৃতা দিয়ে
যাচ্ছেন। দীর্ঘক্ষণ সময় পার
হয়ে যাওয়ার পরেও, তাঁর
বক্তৃতা শেষ হওয়ার কোন
লক্ষণ দেখা গেল না।
'পাঠ ভবন' হলও রাতে
একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত
ভাড়া দেওয়া হয়। বেশি
দেরি হলে সম্পূর্ণ নাটক
মঞ্চস্থ করায়, অসুবিধা দেখা
দিতে পারে। কী ভাবে
তাঁকে ক্ষান্ত করা যায়,
এই নিয়ে দাদারা চিন্তায়
পড়ে গেছে। এমন সময়
তিনি বললেন, “এই তো গেল
গোড়ার কথা, এখন দেখতে
হবে, রস কয় প্রকার।
রস প্রধানত তিন প্রকার,
আদি, মধ্য ও অন্ত।
এবার তিনি আদি রস
ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন।
অবস্থা যা দাঁড়ালো, তাতে
এইভাবে রসের ব্যাখ্যা করতে
গেলে নাটক তো দুরের
কথা, তিনি অন্ত রসে
পৌঁছনোর আগেই, 'পাঠ ভবন' হল
ব্যবহার করার অনুমোদিত সময়
অন্ত হয়ে যাবে। শেষে
তাঁর কাছে গিয়ে ফিসফিস্
করে, বক্তব্য ছোট করার
কথা বলার চেষ্টা করা
হলো। কিন্তু তিনি সেসব
কথা শুনলে, তবে তো
তাঁকে বলা হবে। যাইহোক,
এইভাবে অনেক চেষ্টার পরে
তিনি তাঁর মূল্যবান বক্তব্য
শেষ করে, ফুলের তোড়া
হাতে নিয়ে প্রথম রোতে
তাঁর জন্য নির্দিষ্ট আসনে
বসলেন। বহু আকাঙ্খিত নাটক
শুরু হলো।
পন্ডিত
স্যারের ভাইপো বাবু, যে
আমার সাথে পড়তো, কৌতুক
অভিনয় ভালোই করতো। এই
নাটকেও সে একটা হাসির
রোলে চুরান্ত অভিনয় করছে।
দু’একবার হাততালিও পেয়েছে।
পুরোদমে নাটক চলছে, এমন
সময় পন্ডিত স্যার মঞ্চে
ওঠার পাশের সিঁড়ি ব্যবহার
না করে, পা উঁচু
করে হাতে ভর দিয়ে
একবারে দর্শকদের সামনে দিয়ে
মঞ্চে উঠে, মঞ্চের মাঝখানে
গিয়ে, বাবুর হাত ধরে
বললেন— “এই বাবু, এদিকে
আয়”। মঞ্চের সমস্ত অভিনেতারা
দাঁড়িয়ে পড়েছে, অভিনয় বন্ধ।
এবার তিনি দর্শকদের উদ্দেশ্যে
বললেন— এই যে বাবু,
আমার ভাইপো, ভাল নাম
বলাই ভট্টাচার্য্য, এর অভিনয় আমার
খুব ভালো লেগেছে। এর
অভিনয়ে খুশি হয়ে একে
একটা মেডেল দেবার কথা
ঘোষণা করছি। আজকের এই
নাটকে সকলেই খুব ভালো
অভিনয় করছে, ইত্যাদি কিছু
কথা বলে, তিনি প্রায়
একই কায়দায় মঞ্চ থেকে
নীচে নেমে এসে নিজের
আসনে বসলেন। নাটক আবার
শুরু হলো।