গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

সুজনা চক্রবর্তী

গাঁটছড়া 


শেষ পর্যন্ত মিলে গেল ছাড়পত্র । জজ সাহেব দুজনকেই বুঝিয়েছেন, অনেক বুঝিয়েছেন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরাও কিন্তু জর্জরিত মনে মৃণাল ছিল নাছোড়, ফলাফল অবশ্যম্ভাবি, আর এগোয়নি পথ চাওয়াতে পথচলা । মুসাফির ভেঙে দিতে সব সম্পর্ক সক্ষম হয়ে আজ আবার স্বাধীন মনে ফিরে পাওয়া মুক্তির স্বাদে । সামান্য দুটো সই সম্পুর্ণ সমস্যার সমাধান করে দিল নিমেষেই অনেকদিনের অনেক টানাটানি খেয়োখেয়ি হোঁচট খাওয়ার অবশেষে । "আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে "- বাপরে বাঁচা গেল স্বগতোক্তি মৃণালের, মৃণাল সোম, ডাবলু বি সি এস পরীক্ষা দিয়ে সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । মাস গেলে মোটা মাইনে ড্র করে, এ ছাড়াও আরো কিছু, ফলে একটা ব্যক্তিত্ব সুস্পষ্ট চেহারায়,গাম্ভীর্য্যে ।
মেলে দেওয়া ডানায় এসে বসে ড্রাইভারের সিটে, নিজেই আজ গাড়ি চালিয়ে এসেছে আদালত চত্বরে, আজকে যে মামলার শুনানি ছিল, মৌপ্রিয়া আর ওর ডিভোর্স মামলার, যা বজ্জাত মেয়ে, কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, শেষকালে অনেক গচ্ছা দিয়ে, খাইপরশ মেনে নিতে তবে মিলেছে মুক্তির নির্দেশ । কোনকিছুতেই আপত্তি করেননি মৃণাল, শুধু যে করেই হোক নিস্তার পেতে চেয়েছিলেন প্যানপ্যানে গায়েপড়া মেয়েটার হাত থেকে । "বিরক্তি ! বিরক্তি ! এক্কেবারে বিরক্তি ধরিয়ে দিয়েছে গত দশ বছরের বৈবাহিক জীবনে । একটা বাচ্চাকাচ্চাতো হলোইনা উপরন্তু বলে কিনা কোনো একটা অরফানেজ থেকে একটা বাচ্চা  নিয়ে এসে দত্তক নিতে ! আরে বাবা মৃণাল সোম বাড়ির একমাত্র সন্তান, কতো সম্পত্তির মালিক, কে দেখবে সে সব তাঁর অবর্তমানে শুনি ? বেশি বেশি আধুনিক যুগের মানুষ হয়েছেন মেয়ে, তাই অগত্যা ! কি আর করার ?" নিজের জন্যই বলে ওঠেন মৃণাল কথাগুলো ।
মনের আনন্দে স্ট্রিয়ারিং এ হাত দিয়ে হু-----------, গাড়ি ছুটে ছলেছে লং ড্রাইভে, পেরিয়ে যাচ্ছে  বাড়ি, ঘর, রাস্তা, মাঠ, ঘাট । পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষজন । আজ অনেকদিন পর বকখালির উদ্দেশ্যে চালিয়ে দিলেন গাড়ি , ভীষণ প্রিয় জায়গা তাঁদের, তাঁর এবং মৌপ্রিয়ারও । কতোবার এসেছেন এইখানে দুজনে ছুটি কাটাতে, কতো ছবি এঁকেছেন জনান্তিকে, সবার চোখের অলক্ষ্যে কাছাকাছি এসে নিভৃতে । পেরিয়ে যাচ্ছেন পথের সীমা শহরের কোলাহল ছেড়ে যতই, ততই এগিয়ে আসছে স্মৃতিচারণের মেঘলা আকাশ । মনে পড়ে যাচ্ছে, মনে পড়ে যাচ্ছে সব-- সব---সবটাই ----সবকিছু ।
হঠাৎই মনে হলো তাঁর কাঁধে মাথা রেখে মৌপ্রিয়া, বাহুবেষ্ঠনের আলতো চাপ, নিঃশ্বাস পড়ছে ঘাড়ের উপর, উষ্ণতা বাড়ছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে! ছুটির আমেজে ছুটছে গাড়ি, দুই পাশে গাছের সারি সাড়া দিয়ে যাচ্ছে বাতাসের পরশে, ভেসে আসে মৌপ্রিয়ার ব্যবহৃত প্রসাধনী গন্ধ, আবেশে ছেয়ে যাচ্ছে মন, প্রাণ, অনুভূতি। গতি বাড়িয়ে ছুটছে গাড়ি নীরব আলিঙ্গনে । কতক্ষণ মনে নেই হঠাৎই সামনে একটা ট্রাক গর্জন করতে করতে দৈত্যাকারে, এইবুঝি সব -----! চমক ভেঙ্গে ফিরে আসে সম্বিত, কোনো রকমভাবে সামাল দেয় এই যাত্রায় , বেঁচে যায় বড়ো কোনো অঘটনের হাত থেকে !
মনে মনে ভীষণ বিরক্ত লাগে, রাগে ফুঁসতে থাকে , এখনো এখনো ছাড়েনি তাঁকে বেয়াড়া  মেয়েটা, এখনো আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছে মনোবিকারে। নিজের শিক্ষা পদমর্যাদার কথা ভুলে ছুড়ে মারেন কয়েকটা অশ্লীল শব্দ মৌপ্রিয়ার উপর, অনন্তের শূন্যতায়, তারপর শান্ত মনে চালিয়ে যেতে থাকেন গাড়ি, প্রায় চলেই এসেছেন বকখালি, ছোট্ট জায়গা বড়ই চেনা পরিবেশ । ছোটখাটো ছুটি পেলেই ছুটে এসেছেন, মৌপ্রিয়া বেড়াতে বড্ড ভালোবাসে ।
নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি ল্যান্ড করে পায়ে পায়ে এগিয়ে যান চেনা পরিচিত রাস্তা দিয়ে, রিসর্টের ছোটখাটো স্টাফেরা সবাই হাত জোর করে অভিবাদন জানায়, বারবার ফিরে ফিরে আসা জায়গা, সবাইই প্রায় চেনাজানা । ভালো লাগছে ভীষণ মৃণালের , আস্তে আস্তে এগিয়ে যান রিসেপ্সনের টেবিলে, তন্ময় বাগচী, এখানকার মালিক কাম ম্যানেজার, আপ্যায়িত গলায় সম্বোধন করেন, "আরে মিস্টার সোম যে, খুব ভালো খুব ভালো, আপনার পছন্দের ঘরটা খালিই আছে আজ, আমার মন বলছিল আপনি আসবেন, আসবেনই, তাই ঘরটা ------  তা কই ম্যাডামকে দেখছিনাযে, তিনি কোথায় ? " ব্যবসায়ী মানুষ, কোথায় কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ভদ্রলোকের । মনে মনে সামান্য বিরক্তি লাগলেও কে জানে কেন সত্যি কথাটা বলতে পারেননা মৃন্ময় সোম । কোনো লজ্জা বা অস্বস্তি বোধ কন্ঠ রোধ করে ধরে । অযাচিত ভাবে বলে ওঠেন তিনি , "না মানে এবারের ট্রিপে ও আর আসতে পারলোনা, আমার মনটাই ভীষণ ভীষণ চাইছিল একটা নিরালা, শহুরে পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠলাম একেবারে , তাই আরকি, একাই চলে এলাম "
অমায়িক হাসিতে মিস্টার বাগচী বলে ওঠেন "তা বেশ করেছেন স্যার,আপনার কোনো অসুবিধা নেই,আমরা তো সবাই আছি আপনার জন্য ",বলেই চিৎকার করেন, "এই হরিহর ইধার আ যাও ,বাবুজীকা সামানটামান লে যাও,২২৬ নাম্বার খোল,ঠিকঠাক দেখভাল করনা সাহাবকো, কহি নালিশউলিশ করনেকা জাগা মাত্ রাখনা,ইসবার মেমসাহাব নেই আয়ী,কোই তকলিফ উঠানা না পড়ে আচ্ছাসে দেখনা "কথা শেষ হবার আগেই নমস্তে বাবুজী বলে হরিহর হন্তদন্ত ভিআইপিটা নিয়ে হাঁটতে থাকে লাউঞ্জে, ইশারায় ডেকে নিয়ে মৃণালকে ।
দোতলার নির্দিষ্ট ঘরটার সামনে এসেই হরিহর খুলে দেয় দরজা, বিনীতভাবে ভেতরে প্রবেশ করতে অনুরোধ করে ত্রস্ত পায়ে চলে যায় দুপুরের লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে । মৃণাল শান্ত মনে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে সাদা চাদর পাতা বিছানার উপর, মনের উপর অনেক ধকলতো গেছেই এবার একটু নিজের মতন নিশ্চিত বিশ্রামের জন্য । অনেক শান্তি, অনেক তৃপ্তিতে ক্লান্ত শরীরে দুচোখ বুঝে আসে সুখ নিদ্রায় ।
হঠাৎই খিলখিল করে হেসে ওঠে মৌপ্রিয়া, কাপড়ের আঁচল টা ধরে একটানে নিজের বুকের উপর এনে ফেলে প্রেয়সীকে মৃণাল, না কোন ছাড়ান নেই আজ,একহাতে জাপটে ধরে লবঙ্গলতা নিভিয়ে দেয় যতো বাতি অন্যহাতে! ভালোবাসা তাদের দীর্ঘদিনের ,প্রায় সাত আট বছর ধরে,কখনোই কোনোভাবেই অসম্মানের স্পর্শ করেনি মৌপ্রিয়াকে,আজ মৌপ্রিয়া তাঁর বৌ,বধু বেশে,অনেক অপেক্ষার পর আজ আর ছাড়াই নেই কোনো,কেউ তাকে দমাতে পারবে না । মৌপ্রিয়া তাঁর বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে সমর্পিতা নারী পরম নির্ভরতার আশ্রয়ে,একদম লেপ্টে থাকা অবস্থায়,গাঢ় আলিঙ্গনে, যেন ওও ছিল অপেক্ষার প্রহর গোনার শেষ পর্বে।
কেটে যেতে থাকে পল,বাইরে তখনো সানাইয়ে বসন্ত বাহারের সুর । হঠাৎই প্রচণ্ড দরজা ধাক্কান্নোর শব্দে ধড়মড় করে উঠে পড়ে মৃণাল, ফ্যালফ্যাল চোখে ঠিক ঠাহর করতে পারেন না কোথায় তিনি,অন্ধকার ঘরে,কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিম্ভূত কিমাকার,ঘোর কাটেনি তখনও,একটা অমোঘ বিহ্বলতার মধ্যে আওয়াজ অনুসরণ করে হাতড়ে হাতড়ে খুলে দেন দরজা, সামনে দাঁড়িয়ে অনেক মানুষ কেমন অবাক হয়ে,হরিহর ভয়ার্ত গলায় বলে ওঠে, " ক্যায়া হুয়া বাবুজী ? কেতনা টাইম হোগ্যায়া দরজা খুলতেই নেহি,মুঝে তো ডর লাগগ্যায়া, আপ ঠিকতো হ্যায়না সাব ? তবিয়ত ঠিক হ্যায় ? মেমসাহাব কো ফোন করে ইধার আনেকেভলিয়ে ? বহুত ডর লাগ রহা হ্যায় সাহাব ।"
তড়াং করে কোলাব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠে প্রায় চিৎকার করে ওঠে চল্লিশোর্ধ মিস্টার সোম, ভীষণ খেপে গিয়ে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়েই বার করে দেন হোটেল বয় হরিহরকে,পরক্ষণেই বুঝতে পারেন এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি,গা হাত পা ঘেমে নেয়ে জবজবে,গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সমস্ত বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে নিজেকেই ধিক্কার দিতে থাকেন তিনি। ইন্টারকামে হরিহরকে ডেকে পাঠান ,কে জানে আবার কি করতে কি করে বসে বৃদ্ধ মানুষটা, মৌপ্রিয়ার সাথে বড়ই ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল বেচারার ,অনেক সুন্দর সুন্দর মজার  গল্প বলত বেশ রসিয়ে রসিয়ে প্রিয়াকে, আর প্রিয়া হেসে গড়িয়ে যেতো । এবার নিজের উপরই খেপে যান, "মৌপ্রিয়া এখনো ভুতের মত ঘাড়ে চেপে বসে আছে দেখছি,না না,এবার সংযত হতেই হবে,মৌপ্রিয়াকে তাড়াতেই হচ্ছে ভাবনার আকাশ থেকে ।" বলে তোয়ালে নিয়ে স্নানঘরের দিকে যান ।
হরিহর দ্বিপ্রাহরিক খাবার দিয়ে গেছে টেবিলে,যদিও এখন বেলা প্রায় গড়িয়েছে, তবু হাত মুখ ধুয়ে মুছে সামান্য কিছু মুখে দেন তিনি ,সেই সকাল থেকে চা ছাড়া যে কিছুই পেটে পড়েনি, প্রিয়া থাকলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে বসত, শরীরের প্রতি কোন অযত্নে ও একদম রেগে কাঁই হয়ে যেতো । ভীষণ রাগারাগি করে নিজেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে ------ দেখো, দেখো আবার! নিজের কানটা নিজেই মুলে দেন খুব জোরে,আরো জোরে মৃণাল ।
তখন পড়ন্ত বিকেলের আলো পশ্চিমের জানালা ছুঁয়ে ঘরের ভিতরে একটা অদ্ভুত রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করেছে ,এইসময় মৌপ্রিয়ার সারা শরীর থেকে একটা উষ্ণ আবেদন গড়িয়ে পড়ত ঝলমলে রোদের সুখে,সামলাতে পারতো না নিজেকে মৃণাল, নিষিদ্ধ গণ্ডী ছিন্নভিন্ন করে অসময়েই পাগলপারা হয়ে পড়েছে কতো বিকাল,মৌ মানা করলে শুনছে কে ? ওতো তখন আদিম মানুষের দলে, সামনে আরাধ্য মনের সরাব নিয়ে মৌ, তাঁর ইভ, তাঁর নিজের বিয়ে করা বৌ,তখন কি আর কোনো জ্ঞান থাকে ? অনেকদিন বৈকালিক চা নাস্তা দিতে এসে বৃদ্ধ হরিহর পরে আসব বলে লজ্জিত হয়ে চলে যেতো,আর মৌপ্রিয়া তার চওড়া বুকে দমাদ্দম কিল মারতে মারতে নিজেই ঢলে পড়ত নগ্নিকা মনে নিবেদিতা আগুনে লজ্জা নম্র ভাবাবেগে। তারপর শুধু সুগন্ধ সুখ, শুধু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার খেলা,খুনসুটি,একাত্মতা ।
না মৃণাল থাকতে পারেননি বকখালিতে,কোনরকমে রাতটা কাটিয়ে ফিরে আসেন নিজের বাড়িতে সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠেই,কোনরকমে এককাপ চায়ে চুমুক দিয়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ওরা সবাই বিস্মিত চোখে,ম্যানেজার কিছু একটা ভেবে নিয়ে বিশেষ কথা বাড়াতে চাননি । মৌপ্রিয়া এমনভাবে তাড়া করে ফিরছিল,এমন মিশে ছিল সমস্ত পরিবেশটার সঙ্গে, পালিয়ে এসেছেন মৃণাল সোম রিসোর্টের সুন্দর নির্মল পরিবেশ ছেড়ে । থাকতে পারেননি একটা রাতও সুস্থ স্বাভাবিক,কেবল মৌপ্রিয়ার অসম্ভব আকর্ষণ তাঁকে বিঁধছিল বাঁধছিল ।
কিন্তু বাড়ির মধ্যে ? সেখানে তো প্রিয়া আরো বেশি করে নিপাট ভালোবাসার অহংকারী প্রতিচ্ছবিতে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ! সকালের ঘুম ভেঙ্গে থেকে ঘুমের মাঝেও কেবলই মৌ, মৌ আর মৌ, প্রিয়া, প্রিয়া আর প্রিয়া, মৃণাল আদর করে এই দুই নামেই ডাকাডাকি করতেন প্রাণাধিকাকে । সেই মৌপ্রিয়া বাড়িতে সর্বত্রই  ভুতের গল্পের মতো কেবলই ঘুরছে, ফিরছে, কথা বলছে, জিনিসপত্র এগিয়ে দিচ্ছে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে, পাশাপাশি শুয়ে বসে, মায় সর্ব কর্মে সানিধ্য দিচ্ছে ছায়ার মতো । অফিসের কাজ কর্মের মাঝখানেও ফোনটা তুলে বাড়ির নাম্বারে ডায়াল করে ওঠেন মৃণাল  -------- , কি এক ভাবনার আধিপত্যে কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছেন মৃণাল সোম আজকাল । কোথায় ছিল তাঁর এতো অনুরাগ অনুভূতি ? কোথায় ছিল তার বিভোর ভালোবাসা ? ইদানীং তো আদালতে দেখা হলেই, বেশ কিছুদিন যাবৎ মৌপ্রিয়া বাপের বাড়িতেই থাকত,একটা বিশ্রী বিতৃষ্ণা গিলতে আসত তাঁকে, মৌপ্রিয়ার মুখটা দেখলেই ঘৃণায় দাঁত কিড়মিড় করতেন । তবে !!! বিশ্বাস করতেই পাচ্ছেন না!
ভাবনায় চিন্তায় কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে গেছেন মৃণাল সোম । পিসিমণি রেনুবালা আবারো বিয়ে দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করে পাত্রী দেখার ব্যবস্থা করেন । কিন্তু সেখানেও ব্যাঘাত! কোনো পাত্রীই পছন্দ হয়না, সবার মধ্যেই মৃণাল মৌপ্রিয়াকেই খোঁজে, ওর মতো গায়ের রঙ, ওর মতো চোখ, মুখের আদল, ওর মতো চনমনে মিশুকে! ওর মতো দীঘল ,মায় দ্বিতীয় মৌপ্রিয়া চাই মৃণালের। অনেক দেখেও পছন্দের মেয়ে পাননা মৃণাল,সবার মধ্যেই খুঁত খুঁজে, নাক সিটকে চলে আসেন । প্রচণ্ড রেগে পিসীমণি ফিরে যান নিজের বাড়িতে,আর নাক গলাতে রাজী নন তিনি তাঁর ব্যাপারে । বন্ধুদের সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এই একটা কারণেই । সবাই ওঁকে একটুখানি এড়িয়েই চলেন । বলতে কি এই বয়সে একজন বিবাহিত পুরুষের আর কজনইবা বন্ধুবান্ধব থাকেন ? ওই অফিসের কয়েকজন শুভার্থী । আর পাড়ার দু একজন ছেলেবেলার সাথী । তারাও প্রায় কথা বলাই ছেড়েছেন ।
মৃণাল সোম একা একাই আজকাল,দিনের পর দিন শরীর ভাঙ্গার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন, চোখের কোণে কালি,মুখে বিষন্নতা । একটা বয়স্ক কাজের মানুষ আছে সেই দেখাশোনার ভার নিয়েছে। মৌপ্রিয়ার ছায়া ছেড়ে যায়নি আজো, ভুতের মতো সঙ্গ দিচ্ছে,এ যেন এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে জীবনের জিজ্ঞাসা । কোই কিছুতেই তো বুঝতে পারেননি সেইদিন, এতো গভীরে বসে আছে মৌপ্রিয়া,এতখানি জুড়ে সৃষ্টি করেছে ক্ষত, যেখানে প্রলেপ দেবার জন্য কেউ নেই । বশীভূত করেছে তাঁর সর্বাত্মক,তিনি যে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন ভালোবাসার আলিঙ্গনে কই বুঝতেতো পারেননিতো এক মুহুর্তের জন্যও সেই সাইক্লোনে ! আজ যখন মুক্তির ছাড়পত্র হাতে নিয়ে, তখনই যে ------ আজ একবছর পরেও একদিনের জন্য তাঁকে মুক্তি পেতে দেয়নি মৌ । একমুহূর্তের জন্যেও না । সবসময়ই হু হু করে পুড়িয়ে যাচ্ছে ,বুকের বাঁদিকটায় একটা চিনচিনে ব্যাথা । জখমটা যেন বাড়ছেই নিয়মিত।
কি মনে করে বন্ধু অম্বর ব্যানার্জির কাছে বলতেই সব শুনে ডাক্তার বন্ধু তাঁকে সুপরামর্শ দেন, প্রায় জোর করেই বলেন ফিরে নিয়ে আয় মৌপ্রিয়াকে ,ফিরিয়ে নিয়ে আয়,ওই তোর সব রোগের চিকিৎসা,সব জ্বালার মলম । বোঝে,স্বীকারও করেন আজ মৃণাল ঠেকে শিখে সত্যিটা, তাঁদের মধ্যেকার দূরত্ব তাঁকে ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দিয়েছে প্রাকৃত । কিন্তু ? কিন্তু ? একটা বড়ো প্রশ্নচিহ্ন জাঁকিয়ে বসেছে তার মনে,কি করবেনা তিনি ? কি করে ফিরে যাবেন প্রিয়ার কাছে ? আর ইতিমধ্যেই যদি মৌপ্রিয়ার -------- না আর ভাবতে পারেন না মৃণাল, হাত পা অবশ অসাড় হয়ে যাচ্ছে,নিঃশ্বাস বুজে আসছে ,হাতড়ানো হাতে চোখে অন্ধকার দেখছেন ।
তারপরের কিছুই মৃণালের মনে নেই,শুধু ঘুম ভেঙ্গে দেখেন আকুল চোখে বিধ্বস্ত বিষন্ন প্রিয়া তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন কখন চোখ খুলে দেখবেন তার আশায় । চোখ মেলতেই মুখে খেলে গেল এক অপার্থিব আলোর সৌন্দর্য,সব পাওয়া পরিপূর্ণতায়, চার চোখ আবার একহয়ে তাকিয়ে রইল পারিপাশ্বিক ভুলে । মৃদু উচ্চারণে ওর ডাকনাম ধরে ঠোঁট নাড়তেই নববধূ লজ্জা আচ্ছন্ন করে মৌপ্রিয়াকে আবীরের লাল রঙে। মৃণাল সোম অনুভব করতে পারেন তাঁদের ভালোবাসা একটুখানিও কমেনি,বরং বেড়েছে অনেক অনেক অনেক । চেপে ধরেন তিনি প্রিয়ার হাত সর্বশক্তিতে ।
এরপরে বন্ধু ডাক্তার অম্বর ব্যানার্জির একক চেষ্টায় মৃণাল-মৌপ্রিয়া খুঁজে পান তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সোনার হরিণ,দুজনের সুখের সংসার আলো করে ওদের প্রিয় একমাত্র কন্যা মৃণালপ্রিয়া,মাতৃসদন অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেওয়া অনাথা শিশুটা আজ এমবিএ সম্পূর্ণ করে নূতন দিনের আলোতে বাবা মায়ের একমাত্র ভরসা ।।।।