গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

রুখসানা কাজল

ছাতিম পলাশ মহুয়াবন

বৃষ্টি হয়ে বেশ ভালই হয়েছে। অন্তত দুদিনের রেহাই ধূলো থেকে। উত্তর ধানমন্ডি গেল পরশু ছিল ধূলোমোড়া। গাছের পাতা, ছেঁড়াফাড়া কাগজ, চিপস এর নানারঙ্গা প্যাকেট আর পলি ব্যাগ ছোট ছোট বাতাসে এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। শাড়ির আঁচলে নাক মুখ ঢাকলেও কিছু ধূলো রুমকির কালো মুখকে ধূসর করে ঢুকে পড়েছিল বুকের ভেতর। বুকের বামদিকে হৃদয় । এক্স রে প্লেটে ফর্সা আঙ্গুল রেখে ভাইয়া গম্ভির হয়ে বলেছিল, বাঁচতে গেলে এটাকে সবল রাখতে হবে। তোকে ইয়োগা ক্লাশে ভর্তি করে দিই চল। দিব্যি বেঁচে আছে রুমকি। বরং ভাইয়াটাই মরে গেলো। মরে যাওয়ার কিছুদিন আগে নিজের রুমের ঠিক মধ্যিখানে সুন্দর করে আলপনা এঁকেছিল। লাল হলুদ ফুলের পাশে যখন কিছু স্বউদ্ভাবিত জ্যামিতিক লতা আঁকছিল রুমকি প্রবল তাচ্ছ্যিলে আপত্তি তুলেছিল, এম্মা ভাল লাগছে না। এটা কি লতার পাতা শুনি! ভাইয়া শুনলে ত! ঁকেই যাচ্ছিল। রুমকিও ঘ্যানপেনে কম নয়, ভ্যা গেল আল্পনাটা । কি পচা লাগছে। মুছে দে না! সবুজ রঙ্গে তুলি চুবিয়ে এবার ভাইয়া বলেছিল, বুঝলি না ভেবলি, এই লতা ছিল আদম হাওয়ার স্বর্গের বাসার পেছন বাগানে। এতে তেলাকুচার মত দুধসাদা ফুল ফুটত। ফল হত শশার মত সবুজ আর পাকলে লাল টুকটুক। কচকচ করে খেয়ে নিত আদম হাওয়া। ঠোঁট বেঁকিয়ে চরম অবিশ্বাসে রুমকি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে টুক করে তুলি ছুঁইয়ে রঙ মেখে দিয়ে বলত, যা তো একটু আদা চা করে আন। অনেক ক্ষণ ঝুঁকে আছি বলে বুকে কেমন চাপ চাপ লাগছে। কেমন পোড়া পোড়া হয়ে গেছিল ভাইয়া। রুমকির হাতের পাশে হাত রেখে বলত এই দ্যাখ, আমি এখন তোর রঙ নিয়ে নিয়েছি। ভাল হয়ে উঠলেই তোর পকাতা এঁকে দেবো। ভাইয়ার ঘনকালো চোখের পাপড়িতে নির্ভুল মৃত্যু। ইয়োগা ক্লাশে যে মেয়েটি ইন্স্রাকটর তার হ্যান্ড মাইকটা সবুজ। মাইকটা দোলে , উঠে, নামে, স্থির হয়, কখনো টেবিলে মাথা কাত করে শুয়ে থাকে। প্রথম প্রথম মনে হত মৃত্যু খেলছে, নড়ছে , চলছে, কথা বলছে তাকিয়ে আছে। শিরশির করে উঠত বুক। 

অনেক অনেক বছর ভাইয়ার মৃত্যু নিয়ে রুমকি কখনো কারো সাথে কথা বলেনি। এমনকি ভাইয়ার বন্ধুদের কারো কাছে কখনো বলেনি, আমি অমুকের বোন। যারা জানে তাদের এড়িয়ে গেছে। বিয়ে করেছে, চুটিয়ে সংসার করতে করতে দেখে রুমকির ছেলের মুখে ভাইয়ার ছায়া। ছেলের আঙ্গুলগুলো ভাইয়ার মতই ছবি আঁকে । ইয়োগা ইন্সট্রাকটর মেয়েটা শক্ত মুখে বলে, পুল ইয়োর লেগস ম্যাম, জাস্ট এভাবেরুমকি কচ্ছপ আসনে বসে কেঁদে ফেলে। ভাইয়া ছুটে আসে। আস্তে খুব নরমভাবে পা ছাড়িয়ে দিয়ে রুমকিকে নিয়ে চলে আসে। বাচ্চুকাকু ভয়ংকর রেগে যায়। ভাইয়া রাগে না। ফর্সা মুখে গোলাপি হাসি দিয়ে সালাম দিয়ে বলেছিল, কাকু ওর হার্ট উইক। মনের উপর চাপ পড়লে অসুস্থ হয়ে যাবে যে। মন কি হৃদপিণ্ডের পাশে থাকে রে ভাইয়া? এক্স রে প্লেট এনে খুলে ধরে, কই মন কই ? চিনিয়ে দে তো ! ক্লাশ শেষে ইন্সট্রাকটর মেয়েটা হাসে। ম্যাম আজ আপনি পারফেক্ট পারফ্যমেন্স করেছেন। অন্যদিনের মত দুষ্টুমি করেন নি। মেয়েটাকে একটা কফি চকোলেট দিয়ে রুমকি হাসে, মন খারাপ ছিল যে তাই! উত্তর ধানমন্ডির এই বাসায় ঢুকতে পাকা উঠোনে একটি শেফালি গাছ পেরুতে হয়। কিছু ফুল থেঁতলে থাকে। কিছু ফুল আশ্চর্য সতেজতায় অক্ষত থেকে চেয়ে থাকে। রুমকি হাঁটু গেঁড়ে তুলে নেয়। কাগজে মুড়ে যত্ন করে রেখে দেয় ব্যাগে। ড্রাইভাররা সহাস্যে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কোন কোন বাড়ির বাসিন্দারা থমকে দেখে চলে যায়। আজকাল অন্য ভাবিরাও ফুল কুড়ায়। সাদা পিরিচে ফুলগুলো পু্রো একবেলা আনন্দ দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। ছেলে দেখে খুশি, অহো মাম্‌ ইটস রিয়েলি হেভেনাবল! রুমকি গল্প বানায়, জানো আদম ঈভের হেভেনের বাসায় শিউলিফুলের গাছ ছিল। ছেলে যখন ছোট ছিল ভাবত আমার মা সব জানে। আর তাই জানতে চাইত, তুমি দেখেছ ? রুমকিও মনের সুখে বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাত যে গল্পের কোন শেষ নেই। আজকাল ছেলে হাসে। কখনো কেয়াফুলের ঝাড় কিনে লুকিয়ে রেখে বলে, মাম্ তুমি কি জানো ঈভের প্রিয় ফুল কি ছিল? সমস্ত ফ্ল্যাটের নিঃশ্বাসে ভাসে কেয়ার সুঘ্রাণ। রুমকি লাফিয়ে উঠে, কই দেখি তো ওমা তাই তো ...।