পিয়ন এসে একটি চিঠি দিয়ে গেল। রেজিস্ট্রি চিঠি। আবদুর রহিমের পক্ষ থেকে
পাঠিয়েছে কোন এক উকিল সুবোধ বাবু । উকিলের চিঠি। সেটি হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে
রইলাম। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে খোলার কথা মনেই পড়লো না। আবদুর রহিম আমার স্বামী।
দুই বছরের সংসারের স্বামী।
নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে আমার; গালি দিতে ইচ্ছা করছে নিজেকে। পাঁচ পাঁচটি
বছর ছেড়ে এসেছি স্বামীর বাড়ি আমার পরিবার, ঘরবসত। এই পাঁচটি বছর খোঁজ নেয়নি,
নেওয়ার বোধকরি সময় হয়ে ওঠেনি তার! ভাত-কাপড় দেওয়ার ইচ্ছা বা তাগিদ অনুভব করেনি সে,
দেখা করার ইচ্ছাও হয়নি তার। এতদিন পরে উকিলের মাধ্যমে চিঠি দেওয়ার সুযোগ এবং ইচ্ছা
হয়েছে তার! এই চিঠির ভাষা কী হতে পারে তা যে কেউ আন্দাজ করতে পারে বা পারবে, আমিও
পারছি।
স্বামীর বাড়িতে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সকলে মিলে প্রতিদিন অপমান করেছে,
শারীরিক মানসিক অত্যাচার নিপীড়ন করেছে, সেসব কথা ভুলে গিয়েছিলাম। এতদিন পর নতুন
করে সেই অপমান-অসম্মানের কথা মনে পড়তে লাগল। পুরানো অপমান অসম্মানের সঙ্গে আবার
নতুন করে অপমান-অসম্মান! কিন্তু কেন এই অসম্মান, এই অপমান, নিপীড়ন; নতুন নতুন
পদ্ধতিতে কেন হেনস্থা করা বারবার! আমি নারী তাই? লেখাপড়া শিখিনি তাই? দেখতে ভালো
নই, কুৎসিত সেই কারণে! কেন ? কেন? এই অত্যাচার! আমার কেনর উত্তর দেওয়ার মতো
আশেপাশে কেউ নেই। শুধু একটি বিড়াল মিঁয়ো মিঁয়ো শব্দে তার অবস্থান জানান দিয়ে
জানালা দিয়ে লাফিয়ে বাইরে চলে গেল।
এই বাংলার শত শত নারীর মতো একদিন জন্ম হয়েছিল আমারও। জন্মলগ্নে কোন ন্ক্ষত্রের
আলোর কণা খুলে পড়েছিল কিনা জানি না; কোন রাহুগ্রাস ছিল কিনা জানা নেই আমার। শুধু
জানি আমার সুখ নেই; রাহু গ্রাস করেছে আমার সুখ, আমার আনন্দ, আমার জীবন।আমি বিংশ
শতাব্দির নারী। কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না। ভাগ্য স্বীকার করি না।
তবুও মাঝে মাঝে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয় এই মন; ভাগ্যকে না মানলেও ভাগ্যের খেলাকে
স্বীকার করতে বাধ্য হই! ভাগ্যকে জয় করার জন্যই মুখ বুঁজে এতটা পথ চললাম, একলা একা
পথ চললাম পাঁচটি বছর; সহ্য করলাম এতকিছু কিন' কিছুই তো আমার পক্ষে গেল না! ভাগ্যে
না থাকলে এই রকম চিঠি আসার কথা নয়, আসতে পারে না! আজও ভাগ্যকে স্বীকার করলাম,
মানলাম। বাবার অবস্থা ভালো নয়। বিয়ের সময় মোটর সাইকেল নয় একটা সাইকেল আর একটা
রেডিও দেবার কথা ছিল; দিতে পারেনি। বাবা রিটায়ার্ড করেছিল, ছোটখাট একটি চাকরি
করতো; আমরা ভাইয়ের সংসারে থাকতাম। ভাই দিতে পারলেও দেয়নি; সেই অজুহাতে প্রতিদিন
টুকরাটাকরা কথা কাটাকাটি চড় থাপ্পড় চলতোই। কথায় কথায় বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইতো
শাশুড়ি। স্বামী তাল মেলাতো ওদের কথায়, মারতো আর বলতো ‘হারামজাদী চলে যা। দূর হয়ে
যা।’ একদিন মার সহ্য করতে না পেরে স্বামীর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘চলেই যাবো।’ আমার
মাথা তুলে দাঁড়ানো সহ্য করলো না স্বামী। বলল, ‘যা না যা, কোন চুলায় যাবি যা। দেখি
তোর কোন ভাতারে তোরে খাওয়ায়। কোন বাপে কোলে তুলে রাখে।’ ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে
বের করে দিলো।
এখন যাবো কোথায়? বাবার অবস্থা ভালো নয়! আর
ভালো হলেই বা কী! কে কার? আমি তো অষ্টম শ্রেণি। তবুও সেদিন আর ঐ বাড়িতে ফিরে
যাইনি। আত্মহত্যা করার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠেছিল। আত্মহত্যা মহাপাপ; আত্মহত্যা করলে
অপরিতৃপ্ত আত্মা মানুষের চারপাশে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াবে এই পৃথিবীতে; আত্মার কষ্ট
হবে। ইহলোকে তো শান্তি পেলোই না পরকালও নষ্ট হবে। নষ্ট হলে হবে, হোক। অনেক
ভাবনা-চিন্তা করে ঠিক করলাম এই জীবন আর রাখবো না। ঘুমের ওষুধ, পোকা মারার ওষুধ,
ইঁদুর মারা বিষ কোনটাই পছন্দ হলো না। ঠিক
দুপুর বেলা খোলা চুলে দাঁড়ালাম; দাঁড়ালাম বুড়িগঙ্গার ব্রীজে।শুনেছি দাদি নানিদের
মুখে ‘ঠিক দুক্কুর বেলা ভূতে মারে ঠেলা’ এই তো সময়, শুনশান নিরব! নিচে খরস্রোতা নদী। খোলা চুল উড়ছে বাতাসে। নিচে
তাকিয়ে ডাকলাম ঈশ্বরকে! ক্ষমা করো ঈশ্বর, ক্ষমা করো আমাকে! মাফ করো আমায়, অধম
বান্দা আমি তোমার! এই জীবন থেকে পালানো আমাকে ক্ষমা করো, আমার অক্ষমতা ক্ষমা করো!
দুই চোখ উপচে পড়লো জলের ধারা। কিছুক্ষণ কেঁদে চোখ মুছে তৈরি হই নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার
জন্য। ঝাঁপ দেওয়ার মুহূর্তে মনে হলো দুটো শক্ত হাতের বেষ্টনিতে বন্দী হয়েছি আমি!
এখানে তো কেউ ছিল না, জনমানবহীন, তবে কে?
‘এই মেয়ে কী করো?’ কণ্ঠে নরম ধমকের
সুর।
‘ দেখছেন না, কী?’ উষ্মা প্রকাশ করি।
‘আত্মহত্যা করা পাপ জানো না! আত্মহত্যা কেন করবে? এই জীবন কতো সুন্দর তুমি
জান না!’
‘সুন্দর আপনার কাছে! আমার কাছে না।’ কণ্ঠের রাগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
মানুষটি একটুও রাগ না করে বলে, ‘সুন্দর জীবন নিজে নিজে গড়ে নিতে হয়, কেউ হাতে ধরে
দিয়ে যায় না!’
‘আপনার লেকচার থামান তো, ভালো লাগছে না
আমার।’ কাঁদতে থাকি। আমার কান্না দেখে মানুষটি নরম সুরে বলে, ‘মরতে এসেছ কেন? একটা
জীবন কী তুমি দিতে পারো যে জীবন নিতে এসেছ।’
‘আমি না মরলেও ওরা তো মেরেই ফেলবে
আমাকে। আমাকে ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন আমাকে।’ ওর হাতের ভেতর ধরা হাতখানি ছাড়িয়ে নিতে
চেষ্টা করি। জোরাজুরিতে একসময় ছাড়া পেয়ে দৌড়াতে থাকি। সেও দৌড়াতে থাকে। ওর সঙ্গে
দৌড়ে পারি না। চেঁচিয়ে বলি, ‘পিছু নিয়েছেন কেন? পুলিশ ডাকবো, বলবো আপনি ডিস্টার্ব
করছেন! এরপরেও বিরক্ত করলে খামচি দিবো।’ আমার কথায় মানুষটি হাসে। দিক ভুলানো হাসি। আমি আরও রেগে যাই। বলি, ‘হাসছেন কেন?’
কথার উত্তরে মানুষটি বলে,‘হাসছি
না, তোমার তেজ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। এমন তেজ আর তা কাজে না লাগিয়ে এসেছ মরতে! যা এটা
কোন কাজের কাজ হলো! এই পৃথিবীতে মরা ছাড়াও অনেক অনেক কাজ আছে; মৃত্যুর চেয়ে জীবন
কতো মধুময় তা জানো না বলেই মরতে এসেছ।' মাথা নিচু করে থাকি। একটু অপেক্ষা করে বলে,
‘কোথাও বসি, কিছু কথা বলি তোমার সঙ্গে।’
‘এখানে বসবো কোথায়? বড্ড রোদ্দুর।’
‘রোদ্দুর তো কী হয়েছে? ছায়ার কী
প্রয়োজন আছে?’
ওর কথায় লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলি। খুব
আস্তে বলি, ‘তাইতো যে মানুষ মরবে বলে এসেছে তার রোদ বা ছায়ায় কী আসে যায়!’ আমার
কথা শুনে হাত ধরে; এই ধরার মধ্যে কোন দ্বিধা নেই, নেই কোন সংকোচ। আমরা ব্রীজ থেকে
নেমে নদীর ঢালুতে গিয়ে বসি। ওর পরিচয় দেয়; ও সাব্বির। এম.এ করেছে। বেকার কোন চাকরি
জোটাতে পারেনি এখনও। টো-টো কোম্পানির ম্যানেজার; বাবার হোটেলে চলছে খাওয়া দাওয়া!
নিজের পরিচয় দিয়ে আমার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করে। নাম বলি; ভেবেছিলাম নাম পাল্টে দিবো
কিন' বলতে পারিনি। মিথ্যে কথা গুছিয়ে বলতে পারি না। নাম বলে সব কিছু অকপটে খুলে
বললাম।
আমার সব কথা শুনে নদীর স্রোতে চোখ রেখে বলল, ‘যদি কিছু মনে না করো, আমার
ফোন নম্বর রাখো, বাড়ি ফিরে যাও। প্রয়োজনে ফোন করো।’ পরক্ষণে কী একটা ভেবে বলল,
‘ঠিক আছে চলো পৌঁছে দেই তোমার বাড়ি।’ আমার বাড়ি মানে বাবার বাড়ি। এখনও বাবার
বাড়িতেই থাকি। ভাই একটা ঘর দিয়েছে সেখানেই থাকি। খাবার ব্যবস্থা নিজেই করি। ওদের
ঘাড়ে বোঝা হতে ইচ্ছা করেনি। ওই ঘটনার মাসখানেক পরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে একটা
প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয় সাব্বির, ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থাও সেই
করে। মুরগি খামারের মালিক এখন আমি; ঋণ শোধ করেছি। দিন চলে যাচ্ছিল ভালোই। এতো বছর
পর গোল বাধালো এই চিঠি। চিঠিটি হাতে নিয়ে বসে আছি; খুলিনি। পড়িনি। চিঠিতে কী লেখা
আছে জানতে হবে, সেই মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। সাব্বিরকে পুরো বিষয় জানাতে হবে। কিন্তু
ওকে জানাতে মন চাইছে না।
আজ রবিবার। আসবে সাব্বির। সাব্বির ওকে চায়, ওরও ভালো লাগে। কিন' ‘ঘর পোড়া
গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়’ আমার সেই অবস্থা! অন্য জীবনে জড়াতে ভয়; মনের কথা
জানাইনি সাব্বিরকে; জানায়নি সাব্বিরও। হয়তো অপেক্ষা করছে ওর কথা শোনার। আমি
পড়াশোনা করছি। সামনে এসএসসি। লোন শোধ করে খামারটি একটু দাঁড়িয়ে গেলে বইপত্তর এনে
দিয়েছে সাব্বির। বলেছে,‘লেখাপড়া মানুষকে শক্ত হতে সাহায্য করে। জ্ঞান কখনও চুরি হয়
না, জ্ঞান চুরি করা যায় না। জ্ঞান বৃথা যায় না, বরঞ্চ ভাবনা-চিন্তাতে সাহায্য
করে।’ সাব্বিরকে কথা দিয়েছি লেখাপড়া করবো। এস.এস.সি দিবো। ভালোভাবে পাশ করতে পারলে
আরও পড়বো।
কিন' এই চিঠি? চিঠিটি খুললে যদি আবার মরতে ইচ্ছা করে। খুব আবেগপ্রবণ আমি।
চিঠির মধ্যে যদি অসুন্দর লুকিয়ে থাকে; অসুন্দরে খুব ভয়; অসুন্দর সহ্য করতে পারি
না। চিঠিটি কি সাব্বিরকে দিবো; চিন্তা করি। চিঠি খোলার জন্য অপেক্ষা করবো
সাব্বিরের; তা কি ঠিক হবে? কিছু কিছু কাজ, কিছু কিছু বিষয় থাকে যা একান্ত নিজস্ব;
নিজেকেই করতে হয়। সিদ্ধান্ত নিতে হয় নিজেকেই।
চিঠি খুললাম। মেলে ধরলাম চোখের সম্মুখে; ডিভোর্স নোটিশ। স্বামী ডিভোর্স
দিবে তারই প্রথম নোটিশ। কারণ দর্শানোর নোটিশ। চোখ জ্বালা করছে। বাঙালি নারী
ডিভোর্সের কথা শুনলেই চোখ ভরে ওঠে জলে; সেপারেশনে থাকা যায় কিন্তু ডিভোর্স!
ডিভোর্স মেনে নিতে কষ্ট হয়! চিঠি মেলে ধরা সম্মুখে; চোখ ভরা জল। অন্যমনস্ক আমার
কাঁধে হাতের স্পর্শে চমকে উঠি। সাব্বিরের আসা টের পাইনি। সাব্বির হাত থেকে চিঠি
নিয়ে রেখে দিলো টেবিলে। দাঁড়ালো সামনে; বলল, ‘চল খামারে যাই। এখন এসব নিয়ে ভাবার
সময় নয়। যা নিজের নয় তা নিয়ে কখনও ভাবতে নেই।’ ওর এই একটি কথাতেই জোর পেলাম মনে;
বুঝতে পেরেছি আমার গন্তব্য। ওর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম।