গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

শোক

এই মাত্র পাওয়া খবরে জানা গেছে, বিশিষ্ট অভিনেতা তথা নাট্য নির্দেশক রমেন বাগচীর জীবনাবসান হয়েছে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে শিল্পী মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর প্রতি সম্মান দেখাতে আজ নির্ধারিত সমস্ত শুটিং বাতিল করা হয়েছে। শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপণের উদ্দেশ্যে তাঁর মরদেহ আজ সারাদিন রবীন্দ্র ভবন চত্তরে রাখা থাকবে 
হইলো, এবাবা, তাহলে ওই সিরিয়ালটার কি হবে? রমেন যে চরিত্রটা করত কী দারুণ করত গো। বৌমা, শুধু চা দিলে? তোমায় যে বলেছিলাম অনুপকে স্পেশ্যাল চানাচুরটা দিতে। একটা কথাও যদি মনে রাখ। ওবাবা, এইটুকু কথাতেই তোমার চোখে জল নাকি? আর পারিনে বাপু 
ছাড়ুন না মা, ভুলে গিয়েছে হয়ত। বাচ্চা মেয়ে 
এই তোমরাবাচ্চা মেয়ে বাচ্চা মেয়েবলে বলে আরোও ওর বারোটা বাজাচ্ছ। যে বয়সে ইনি বিয়ে করলেন, সেই বয়সে আমার খুকু, টুলু দুজনেই হয়ে গেছে। খোকা তখন হবে 
না না, তাছাড়া বুঝতেই তো পারছেন মা, এই রকম একটা খবর আচমকা...” 
হ্যাঁ, তুমি আর তাল দিও না বাবা। তোমার বউ শুনলে আরোও সব্বনাশ। মানুষ তো মরবেই, তাবলে কী আত্মীয়কুটুম্ব আসবে না? অতিথি আপ্যায়নে ভুল হবে? তুমি তো এবাড়ির বড় জামাই নাকি? তোমার দিদির মেয়ের বিয়ের সুখবর দিতে এসেছ, সেখানে যত্ন আত্তি করবে না? শিখতেও তো হবে। আমি চোখ বুজলে খুকু, টুলু তাদের বাড়ির লোক নিয়ে আসবে না বাড়িতে? যত্তো সব। আর তাও যদি সিরিয়ালে অভিনয় করত বৌমা। তাতেও পড়শিদের কাছে মুখ উজ্জ্বল হতো। উনি তো করতেন থিয়েটার, সেই দেখতে গিয়েই তো খোকার মাথা ঘুরে গেল, মনে নেই?” 
রান্না ঘর থেকে সবই শুনতে পায় টুপুর। লুকিয়ে চোখের জল মোছে। হাহাকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে যেখানে, সেখানে টুঁ শব্দটিও করতে পারছে না। ফোনটা বেজে ওঠে, গলাটা যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক করে ফোন তোলে,
 হ্যালো, বল
বল মানে? তুই খবরটা পাসনি?” 
পেয়েছি। টিভি তো ছাড়াই রয়েছে 
তাহলে?” 
কী তাহলে?”
যাবি না?” 
কী করে যাব বলত? অঞ্জনের দিদি জামাইবাবু এসছেন, জামাইবাবুর দিদির মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। মাংস বানালাম, এখন লুচি ভাজছি 
হোয়াট? তুই, তুই রমেনদা শেষ যাত্রায় না গিয়ে.... তুই কী ভুলে গেলি সব?” 
কী করে ভুলি বলত? নাঃ, রাখিরে। এখনই খেতে দিতে হবে 
তোর বন্ধু কিন্তু ঠিকই বলেছে 
বড়দি??!!”  রান্না ঘরে কখন যে খুকু মানে টুপুরের বড় ননদ এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি টুপুর। 
শোন, তোর জামাইবাবুকে দেবার পরিমাণ লুচি ভাজা হয়ে গেছে না? ব্যস্ আমি দিয়ে দিচ্ছি। তুই আমার সঙ্গে 
কোথায়?” 
রমেন বাবুর শেষ যাত্রায় 
বড়দি। কিন্তু মামনি...”
মা কে আমি সামলে নেব। তুই চট করে রেডি হয়ে চলে চল 
জানো, বড়দি, আমার কিন্তু রমেনদা মৃত্যু সংবাদে যতো না শোক হচ্ছে, তারচেয়ে বেশী হচ্ছিল এই আধুনিক যুগেও এতো অমানবিক আচরণ দেখে। আবার দেখো, তোমার মতো মানুষও তো আছে 
এখন আর কথা বাড়াস না, তুইও শিখে রাখ, নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েও নিজের টুকু আদায় করে নিতে হয়, সংসারে। সব সময় কী আর কেউ এসে সাহায্য করবে রে?” 
*****
তুই নিয়ে এলি যে? সে কী এটুকুও শিখে আসেনি বাপের ঘর থেকে, যে, কেউ বেড়াতে এলে তাকে দিয়ে কাজ করাতে হয় না
মা। প্রথমতঃ তুমিই না বল, ‘বিয়ে হয়ে গেছে তাতে কী? এটা এখনও তোদের বাড়ি?’ তাহলে, নিজের বাড়িতে কাজ করতে অসুবিধে কোথায়? দ্বিতীয়তঃ, তোমরা সবাই জানো, রমেন বাগচী নামটা টুপুরের কাছে ভগবানের নামের তুল্য। টুপুরকে উনি হাতে ধরে স্টেজে নিয়ে গেছেন, যা কিনা যথেষ্ট বিরল সৌভাগ্য। টুপুরের প্রতিভাকে উনিই বের করে এনেছেন, এবং তাকে যোগ্য সম্মান দিয়েছেন।টুপুর কিন্তু অমন নামজাদা মানুষের নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছে, চূড়ান্ত আনকোরা হয়েও। সে সুযোগও তো ওই মানুষটার সৌজন্যেই।  টুপুর তোমার ছেলের বউ, এর বাইরেও তার একটা পরিচয় আছে, সেটা তো ভুললে চলবে না। আজকের দিনটা অন্ততঃ মানবিক হবে আশা করেছিলাম। কারণ, সে তো তোমাদের কাজের লোক নয়, সে এবাড়ির বউ। এই পরিবারে, আমাদের সবার যতোটা অধিকার, টুপুরের এক বিন্দু কম নয়।
আমি, টুপুরকে নিয়ে যাচ্ছি; রমেন বাবুর শেষ যাত্রায়। তোমাদের যা যা ইচ্ছে ছিল, সব তো করে দিয়েছে মেয়েটা। এবার তোমরা শাশুড়ি জামাই বসে টিভি দেখো আর খাওয়া দাওয়া করো”
“দেখলে তো বাবা অনুপ? আমি, ঠিক এই আশঙ্কাই করছিলাম। বাইরের লোক লাগে না গো, ঘরের মধ্যেই আমার শত্রু” 
“হ্যাঁ। আজকের যুগে দাঁড়িয়েও যদি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের কষ্ট বুঝতে পারাটা যদি কারো শত্রুতা মনেহয় তবে তাই হোক। অন্যের কষ্টে তার পাশে না দাঁড়াতে পারলে, তাহলে আমার শিক্ষা বৃথা। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত মা,তোমার মেয়েকে তুমি কতো ভালো শিক্ষা দিতে পেরেছ, ভেবে” 
“মামনি, আমি বড়দি’র সাথে যাচ্ছি....” 
“হ্যাঁ। যাবে তো বটেই। তবে, দেখো, তুমি তাঁর নায়িকা ছিলে বলে কথা, টিভি অলাদের ধরে একটু মুখটা দেখিও কোনো চ্যানেলে। তাহলে তাও সোসাইটিতে বেশ মুখউজ্জ্বল হয়। আমার ছেলের বউ, কি না রমেন বাগচীর নায়িকা। হলোই বা থিয়েটারে” 
“তোমার বলা শেষ? এবার তাহলে আমরা আসি মা? আর হ্যাঁ শোনো, আমাদের জন্য অপেক্ষা কোরো না, কতো রাতে ফিরতে পারব জানি না। তোমার জামাইকে তাঁর খাওয়া হলে, বাড়ি চলে যেতে বোলো। আমরা সেখানে তো শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছি, কাজেই টিভি তে মুখ দেখতে পাবে আশা কোরো না, কেমন?” 
...