অপুর
ব্যাপারটা মিটে গেছে একবছর আগেই । পরে আর কেউ সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ
করেনি অপুর বিরুদ্ধে । তাই অপুর মার মনে শান্তি বিরাজ করছে । ওর বাবার মাথায় কিছুই
নেই আর । সে জানতেও চায় না । কিন্তু আর একটা সমস্যা এসে উপস্থিত হল । কি যে সমস্যা
। এও বুঝি হয় ? ভাবতে
ভাবতে অপুর মা চুল ছিঁড়তে থাকলো মনে মনে ।
অপুর দিদি
অর্পিতা । ও কলেজে পড়ে । অপুর থেকে বছর চারেকের বড় হবে । ওকে নিয়েই নতুন সমস্যা
এসে উপস্থিত ।
সেদিন
অর্পিতার কলেজ ছিল না । ও ছুটির দিন তেমন বাইরেও বেরোয় না । সারাদিন কানে হেড-ফোন গুঁজে গান শোনে । টিভির কাছে যায় খুবই কম । কারো সাথে
ওর কথা বলতে ভালো লাগে না । মানে নিজের মতো নিজে দিনযাপন করে ।
ভ্য্যাজানো
দরজা খুলতেই অর্পিতার মা অবাক । সে যেন তখন আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো । অর্পিতা মনের
সুখে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে । ধোঁয়া বেরোচ্ছে বেশ । ওর মা তখন ভাবল,কিছু বলবো না এখন । পরে দেখা যাবে । কিন্তু একথা ভেবেও সে ঘরে ঢুকে পড়লো । মার
দিকে চোখ পড়তেই অর্পিতা সিগারেটটা পিছনের দিকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো । ফেলে
দেওয়ার উপায় নেই তখন ।
‘’ব্যাপারটা
কী ? এ আবার কেমন কথা ?
তুই মেয়ে না ? কি সব্বনাশ !’’
অর্পিতার মুখের কাছে এসে ওর মা
চোখ গোল্লা করে বলে উঠলো । পিছনে তখন ধোঁয়া বেরোচ্ছে বেশ ।
মার কথা শুনে অর্পিতা স্মিত হাসল
।
হেসে ওর
মাকে বলল,’’তুমি শুরুতেই ভুল । মেয়ে বলে
সিগারেট খাওয়া যাবে না এমন কিন্তু নয় । আমাদের কলেজের অনেক মেয়েই খায় । শুধু ওদেরই
বা বলি কেন ? অনেক গুণী
মেয়েরাও মনঃসংযোগের জন্য সিগারেট টানে । সব বুঝি ছেলেদের জন্য ?
কি যে বল না তুমি ।‘’
কথাগুলো
শেষ করে অর্পিতা মুচকি হেসে প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা খোলা জানলা দিয়ে বাইরে
ফেলে দিলো ।
অর্পিতার
কথা শুনে ওর মা বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলো,’’বাজে কথা বলিস না । কে কোথায় খায় তাতে তোর কী ? তোকে খেতে হবে কেন,শুনি ?
আর এ শরীরের পক্ষেও ভালো না । বাজে নেশা থেকে দূরে থাকো,মা ।‘’
তারপর আর
কোন কথা না বলে অর্পিতার মা হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । মার যাওয়া দেখে
অর্পিতা মনে মনে হাসতে থাকলো । তারপর উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার একটা
সিগারেট ধরাল । এবার ও বেশ নিরুপদ্রব ।
অর্পিতার
বাবা অফিস থেকে ফিরল সন্ধের দিকে । সে কিছুসময় বিশ্রাম নেওয়ার পর অর্পিতার মা তাকে
দোতলার ঘরে নিয়ে গিয়ে মেয়ের ব্যাপারে সব তাকে বলল । অর্পিতা তখন নিজের ঘরে বসে গান
শুনছে আপন মনে ।
সব শুনে অর্পিতার বাবা হেসে উঠলো
।
সে বলল,’’তাই বুঝি ? এমন
উন্নতি আমার মেয়ের ? তবে এ
উন্নতি অনিবার্য । আজকের সময়ের সাথে আমি বা তুমি তাল মিলাতে পারবো না । জেট গতিতে
এগিয়ে চলেছে সব । তুমি ওকে বলতে বলছ আমাকে । সে আমি বুঝেছি । বাট আমি অপারগ । আমি
নিজেই লজ্জায় মরে যাবো । ওর ভালোমন্দ ওকে বুঝতে দাও । আর কোথায় লেখা আছে মেয়েরা
সিগারেট বা মদ খেতে পারবে না ? থেমে যাও,ডার্লিং ।
নতুন প্রজন্মকে অবাধে এগোতে দাও ।‘’
অর্পিতার বাবার কথা শুনে ওর মা
বেশ বিরক্ত তখন ।
সে রাগত-স্বরে তাকে বলল,’’অপুর ব্যাপারেও তুমি এমন করেছিলে
। আজো করলে । আমি একা কী করি ?’’
এবার হাসতে থাকলো অর্পিতার বাবা
।
সে একমুখ
হাসি নিয়ে বলল,’’অপুর
ব্যাপারে আমি সফল । বুঝতে পারো না কিছু ? কিন্তু অর্পিতার ব্যাপারে আমি শুধু তোমাকেই স্পিচ দিলাম । ওকে আমি মরে গেলেও
কিছু বলতে পারবো না । কাল আমাকে নারী-স্বাধীনতা নিয়ে একটা ভাষণ দিতে হবে । তাই তার আগে ছন্দ কাটতে রাজী নই । বাদ
দাও বাজে ব্যাপার ।‘’
রাতের
দিকে অর্পিতা এলো বাবার কাছে সাহিত্যের কি ব্যাপারে আলোচনা করতে । সে তখন সুখটান
দিচ্ছিল বেশ । বাবাকে দেখে অর্পিতা স্মিত হাসল ।
পরে
জিজ্ঞেস করলো,’’মেয়েদের
বুঝি সিগারেট খাওয়া বারণ ? কোথাও এমন
কথা লেখা আছে ? তুমি জানো
কিছু এ ব্যাপারে ?’’
সঙ্গে-সঙ্গে বাবা একগাল হেসে ওর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলতে
থাকলো,’’লজ্জা দিস না আমাকে । এ কোত্থাও লেখা নেই । আর থাকবেই বা কেন ?
বিচার-বিবেচনা নিজের ওপর । এ নিয়ে আবার ফতোয়া কীসের ? মেয়েদের সিগারেট খাওয়া চলতেই
পারে । আমাদের অফিসের দুজন মহিলা দিব্যি টানে আমাদের সামনেই । তাতে কী ?
তবে একটা কথা বলি তোকে ।‘’
কথাগুলো
শেষ করে অর্পিতার বাবা এক চিলতে হাসল । বাবার দিকে বেশ অবাক-দৃষ্টিতে তখন অর্পিতা চেয়ে থাকলো ।
‘’তোমার
কথাটা কী,বাবা ?’’
সাগ্রহে অর্পিতা জিজ্ঞেস করলো ।
ওর বাবা
তখন বেশ বিজ্ঞের সুরে বলতে থাকলো,’’কাউকে দেখে কিছু করবি না । এতে নিজের জাত-মান আর থাকে না । বান্ধবীরা খেলে খেতে হবে,তা কেন ?
তোর মন কি চায় খেতে ? তাহলে খাস । আর মনঃসংযোগের ব্যাপারটা ধাপ্পা । ও প্রচলিত কথা । হৃদয় সবথেকে মনঃসংযোগকারী
। হৃদয় যা চাইবে করবি । আসলে সত্যিকারের হৃদয় থাকলে কোনোকিছুতেই সমস্যা হয় না ।‘’
তারপর
অর্পিতার বাবার আর সময় ছিল না । সে সারা মুখে হাসি নিয়ে বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে
ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । অর্পিতা চুপ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ ।
এরপর
অর্পিতা নিজের ঘরে গেলো । প্যাকেটে তখন চারটে সিগারেট ছিল । অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে
ও সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলো । তারপর চুপিচুপি বাড়ির ছাদে
গিয়ে প্যাকেটের মধ্যে দুটো কাঁচের গুলি দিয়ে প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো বাড়ির
পাশের জঙ্গলে ।
নীচে নেমে
এসে ও মাকে তৃপ্তির হাসি হেসে সে কথা জানালো । জেনে ওর মা তো আনন্দে আত্মহারা ।
ওকে বুকে
জড়িয়ে ধরে সে স্বস্তির হাসি হাসতে হাসতে বলল,’’অমন সব্বনেশে কাজ আর করিস না । তুই ভালো মেয়ে না ?’’
নিজে ভালো
না মন্দ,তা নিয়ে বিচার করার সময় তখন ছিল
না অর্পিতার । তাই এক ফালি হেসে আবার নিজের ঘরে চলে এলো ।
কিন্তু
বাবা বাজার থেকে ফিরতে অর্পিতা ওর বাবাকে বলতেই সে বলে উঠলো একটু আনমনে,’’কি যে করিস ছাই । এভাবে নেশা ঘোচে ? চলতে চলতে একটু একটু করে থেমে যায় । তুইও দেখছি অপুর মতোই । ধুস... আর ফেলবি কেন তুই ? আমার পয়সায় কেনা না ?
আমাকে দিতে পারতিস ।‘’
বাবার কথা
শুনে বেশ লজ্জা পেলো অর্পিতা । বাবার শেষ কথায় বেশ মনমরা হল ও । ওর মাও ছিল কাছে ।
সে বেশ
ঝাঁঝের সঙ্গে বলে বসলো অর্পিতার বাবাকে,’’কি যে বলি তোমাকে । মেয়েটা আনন্দ করে বলতে এলো । আর তুমি কিনা... তুমি যে কি আজো বুঝলাম না ।‘’
অর্পিতা
মার কথার মাঝে নিজের ঘরের দিকে মাথা নিচু করে হাঁটা দিয়েছে । ওর যাওয়া দেখে ওর বাবা এক চিলতে হাসে ।
আর
অর্পিতার মার কথায় উত্তর দেত সে,’’এ যুগে অভিভাবক হওয়া খুব কঠিন গো । অনেক প্যাঁচ আছে তাতে । তুমি খুলতে জানো না
। চুপ করে থাকো । মেয়েকে আরও ভাবতে দাও । আমার আর ভাবার কিছু নেই । একটু কফি কর ।
জমিয়ে পান করা যাক ।‘’