গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

মৌ দাশগুপ্ত

বেউলাসুন্দরী

আমাদের গ্রামের একদম পশ্চিমে ঘোষপাড়া তারপরই গ্রামের সীমা শেষ। সোনাঝুরি নদী ,নদীর ওপারে দেউলটি গ্রাম,নদী আর ঘোষপাড়ার মাঝে খানিকটা ফাঁকা জমি।দিদান বলে ওটা সোনাঝুরির খাত,একসময়ে.একদম গ্রামের গা ঘেঁষে বইত সোনাঝুরি।পশ্চিম আর দক্ষিণ সীমানা বেঁধে রাখত,এখন দক্ষিণে আগের মত বইলেও পশ্চিমে অনেকটাই সরে গেছে।ওটা সরকারী খাস জমি।তারই এক চিলতে অংশে চার পাঁচ ঘর বেদিয়া পরিবার থাকে। গ্রামে বিশেষ ঢোকে না ওরা। সবাই বলে ওরা চুরি চামারি করে,বাচ্চা তুলে নিয়ে যায়,মন্ত্র পড়ে মানুষকে বশ করতে পারে,গরু গাধা কুকুর যা ইচ্ছে বানিয়ে দিতে পারে, এমনকি ওরা নাকি মন্ত্রের বাণ মেরে মানুষকে মেরেও ফেলতে পারে। আমাদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হত ওদিকে না যেতে, যদিও গ্রামের কাকা জ্যাঠা পিসে মেসোদের অনেককেই দেখেছি চোরের মত রাতের আড়ালে ওদের ঝুপসি ঘরের দিকে যেতে। গ্রামে যে.ওরা.একদম ঢুকতো না তা নয়।.মেলায় সাপের খেলা কুকুরের খেলা টিয়া আর কবুতরের খেলা দেখাতো।মাঝে সাঝে পুজোপ্যান্ডেলের বাইরে বা যাত্রা আসরের বাইরেও দেখেছি ওদের।জড়িবুটি বেচত,ব্যাথার ,ন্যাবারোগের, মৃগীর,পেটব্য়াথা দাস্তের,দাঁতব্যাথার ওষুধ,মেয়েলি ও পুরুষালি রোগের ওষুধ বেচত ওরামাঝেসাঝে কাছিমের ডিম, পাখির বাচ্চাও বেচতে দেখেছি । পুরুষগুলোকে ঘর ছাইতে, মুনীস খাটতেও মাঝেমধ্যে আসতে দেখেছি।

বেদিয়া মেয়েগুলো অদ্ভুত.পোষাক পড়ত।হা করে দেখতাম তাই।কি রকম জবরজং সাজত, ওরকম উল্কি আঁকা, চুলে রঙিন উল কি শোলার ফুলের ট্যাসেল ,রুপোর কাঁটা,গোল মোটা রুপোর হাসুলী মল, ঝোলা ঝুমকো, তাগা পড়া বেদেনীরা ঘরের মা মাসি দিদিদের থেকে যে একেবারেই.আলাদা সেটা ছোটবেলা থেকেই ওদের পোশাকে কথার টানে হাঁটাচলার মালুম পেতাম।

মাধ্যমিক দিতে না দিতেই এক বেদিনির নেশায় পড়ে গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেলেই হাত পায়ের তালু শিরশির করতো,কান লাল হয়ে যেত,তলপেটের তলায় অদ্ভুত অস্বস্তি হত। ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। না রোগা, না মোটা, না কালো, না ফরসা, না বেঁটে না লম্বা, একেবারে সাধারণ চেহারার বেদানির গোড়ালি ছোওয়া কালো সাপের মত চুলের বেণী নয়, কিলখিলে কাঁচভাঙা আওয়াজের হাসিও নয়,একেবেঁকে সাপের চালের হাঁটাও নয়,ওর দিকে সবার নজর যেত ওর চোখের জন্যই,ওরকম কাজল টানা সবুজ চোখ আজ অবদি নজরে পড়েনি আমার ।আর কি তীব্র দৃষ্টি,চোখে চোখ রাখা যায়না, সন্তু বলত ওর নাম নাকি ছম্মকছল্লো, বাপন বলত কালনাগিনী, পিট্টু বলত হিরোইন, আর দিদানের গেঁটেবাতের ওষুধ মালিশ করে দেওয়ার সময় দিদান ওকে বেউলা বলে ডাকত ,আসল নাম তাহলে বোধহয় বেহুলাই হবে।কে জানে!

বেউলা বয়সে আমাদের থেকে অনেক বড়ই হবে,বেউলা আর ওর দিদি কোয়ালার একসাথে সাঙা হয়েছে তিতরা বেদের সাথে,বেউলার কোন বাচ্চাকাচ্চা নেই, তবে তিনটে নেড়ি কুকুর মিরচা, ধনিয়া ,টমাটর সারাদিন ওর পেছনপেছন-ই ঘোর,ওদেরকেই অনেকে ফিচলামো করে বেউলার বাচ্চা বলে।
বেউলার নেশায় যে খালি আমিই মজেছিলাম তা নয়,বেউলার নেশা আগুন ধরিয়েছিল গ্রামের অনেক পুরুষের বুকেই।আমার সমবয়সী থেকে বাপ জেঠ্যার বয়সী অনেকেই সে লাইনে ছিল,আর সে খবর আমরা জানতামও। তবে সবচেয়ে বড় নেশাড়ু ছিল গাঁয়ের একমাত্র মদভাঁটির মালিক টাব্বু মিয়া। মদের ভাঁটিখানা চালালে কি হবে একফোঁটা মদ খেতোনা টাব্বু ।তবে কিছু একটা নেশা যে করত সেটা ঠিক।সারাদিন চোখ লাল হয়ে থাকত, খুব বদলোক ছিল, দুই দুইবার খুন করে.জেলে গিয়েও প্রমাণের.অভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে ।ষন্ডা মুসকো চেহারার টাব্বুকে সবাই সমঝেই চলত। এই টাব্বুর সাথে বেশ দহরম মহরম ছিল তিতরার, আর সেই সুবাদে বেউলাও দেখতাম বেশ রসেবশে ঢলে গড়িয়ে কথা বলত । টাব্বুর ভয়েই বেউলাকে লোক বেশী ঘাঁটাতনা।তা একদিন এই বেউলাকে নিয়েই শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই বাঁধলো তিতরা আর টাব্বুর।ওই সময়টাতেই আবার আমার দিদুন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রীতিমত যমে মানুষে টানাটানি। আমার বাবা তো সেই কোন ছোটবেলায় মারা গেছেন,মনেও নেই আমার। দিদানের কাছেই আমি আর মা থাকতাম। তাই দিদানের অসুখ বলে অন্য কোনদিকে নজর দেওয়ার সময়ও ছিলনা আমার।

পরে শুনেছি, মদের পিপে তিতরা বেদেকে বিনাপয়সায় মদ খাওয়াতো টাব্বু। শুধু মদই না, অন্য নেশার যোগানও দিত। অনেক টাকা পাওনা হয়ে যাবার পর টাকার বদলে তিনরাত বেউলাকে নিয়ে মজা লুটতে চেয়েছিল টাব্বু। তিতরাবেদে রাজি না হওয়ায় ওকে মারধোর করে হাত পা বেঁধে ভাটিখানায় আটকে রেখে বেউলাকে একা ডেকে পাঠিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে একাই গেছিল বেউলা, বেদিয়াপাড়ার কোন মরদ তো দুর অস্ত, কোন জেনানা, এমনকি ওর নিজের দিদি কাম সতিন কোয়েলাও সাথে যায়নি।ওখানে যে কি হয়েছিল সবই অনুমানসাপেক্ষ, তবে বেউলাকে ছোঁয়ার আগেই টমাটর লাফ দিয়ে উঠে টাব্বুর টুঁটি কামড়ে ধরেছিল, মিরচা আর ধনিয়া হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল টাব্বুমিয়ার শাগরেদদের ওপর। সেই গন্ডগোলের ফাঁকে তিতরা বেদেকে নিয়ে পালিয়েছিল বেউলা।টমাটরকে কোনভাবে মেরে ছাড়িয়ে টাব্বুকে হাসপাতাল নিয়ে গেছিল ওর লোকেরা। আর সেইটুকু সময়ের মধ্যেই বেদেপাড়া খালি করে কর্পূরের মত উবে গেছিল বেদেপাড়ার লোকজন।খালি ভাঙা ছাউনির ঘরগুলো পরদিন টাব্বুমিয়ার শাগরেদদের রাগ মিটানোর জন্য অসহায়ের মত খোলা আকাশের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনটে মরা কুকুরের ছিন্নভিন্ন দেহর মত।
অসুখ থেকে দিদান আর সেরে ওঠেননি।মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই দিদানও চলে যাওয়ায় বড়মামা আমার পরীক্ষার পরপরই মা আর আমাকে বজবজে নিয়ে গেছিলেন।তারপর অনেকদিন কোন যোগাযোগ ছিলনা। আজ বছর কুড়ি পর গ্রামে এসেছি মায়ের পৈত্রিক জমির বিলিব্যাবস্থা করতে।দিদান বেঁচে থাকতেই সব মায়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন। দুইমামার অনুমতি নিয়ে জমিটা বিক্রি করে দিচ্ছি।তো এসেই দেখা টাব্বুমিয়ার সাথে। সাথে বাপন না থাকলে চিনতেও পারতমনা। টাব্বুমিয়া নয়। এ যেন টাব্বুমিয়ার ধ্বংসাবিশেষ।গলায় মোটা কাপড় জড়ানো। কথা বলতে পারেনা।শকুনের মত দৃষ্টি মেলে ভাটিখানার বাইরের কেঠোচেয়ারে বসে আগ্রাসী দুচোখে লোকজন দেখে।বাপন বলল গলায় টমাটরের দাঁতের চাপে ফুটো হয়ে গেছিল সে আর সারেনি।নাছোড়বান্দা এই কামড়ের কথা ভেবে কেন জানিনা আমার Ernest Thompson Seton এর লেখার কথা মনে পড়ল। উনি লিখেছিলেন না, একদিন একটা উড়ন্ত ঈগলকে শিকার করলেন। তারপর সেই মৃতদেহ ভালো করে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন তার গলাটা কামড়ে ধরে ঝুলে আছে একটা weasel–এর শুকনো খুলি! কবে বুঝি পাখিটা ছোঁ মেরে মাটি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ক্ষুদে weasel-টাকে, আর সে-ও প্রাণপণে কামড়ে ধরেছে ঈগলের গলা। কিন্তু ঈগল তার শিকারকে খুব দ্রুত ছিঁড়ে খেয়ে ফেলায়, কামড়ের জোর কমে এসেছে। তবু ছোট্ট weasel-এর দুর্দম জেদ কন্ঠহারের মতো আমৃত্যু রয়ে গেছে তার হন্তারকের গলায়।টমাটর নেই তবে ওর দাঁতের চিহ্ন আমৃত্যু টাব্বুমিয়া বয়ে বেড়াবে বেউলাকে নাগালে না পাওয়ার অতৃপ্তির মত, অথবা বেউলার কাছে পরাজয়ের স্মৃতির মত।