ননীর মা জীবনেও ননী
খায় নি আর ননীর মুখেও কোনদিন ননীমাখন তুলে দিতে পারে নি। ননী তখন পাঁচবছরের, সেইসময়ে
ওর বাবা মারা যায় হঠাৎ দুদিনের জ্বরে। সেই থেকে টুকটাক সেলাইফোঁড়াই, এর ওর দয়ায় মা-ব্যাটার
চলে এসেছে। প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত বিদ্যে ননীর। বছর তেরো-চোদ্দ বয়স হলে কার থেকে
যেন টাকা পয়সা ধার করে একদিন একটা মোটর লাগানো ভ্যান রিক্সা কিনে ফেলল ওইটুকু
ছেলে। তারপর ওই ভ্যানে করে মাল সাপ্লাই করে দিব্যি পয়সা রোজগার করতে শুরু করে দিল
ননী। আর মাকে কড়া হুকুম দিয়ে রাখল – ‘রোজ রোজ রাত জেগে চোখের মাথা খেয়ে তোমাকে আর
সেলাইয়ের কাজ করতে হবে না। যা করার আমিই করব।‘ ননীর মা’র মুখে যেমন হাসি ফুটল একটু,
তেমনি ছেলের জন্য চিন্তায় রাতের ঘুম গেল। এই চিন্তা যে কিসের তা সে নিজেও জানে না।
মায়েরা বোধহয় চিরকাল এমন অকারণেই সন্তানের জন্য চিন্তা করে।
বেশ চলল কিছুদিন এভাবে। কিন্তু ননীর মা’র কপালে বুঝি সুখ
ছিল না। একদিন সে ছেলের মুখে চুল্লুর গন্ধ পেল। বকাবকি করতে গেলে ছেলে ভীষণ তেড়ে
এলো। আর তারপর থেকেই ননীর মা গুটিয়ে নিল নিজেকে। ও বুঝে গেল, ছেলে তার পর হয়ে
গেছে। এরপর নেশা করাটা ননীর অভ্যেস হয়ে গেল। একদিন সকালে মেজাজ ভালো থাকায় মাকে
ডেকে বলল, ‘তুমি আজকাল এত চুপচাপ থাক কেন? নেশা করলেই কেউ খারাপ হয়ে যায় না।‘ সেদিন
একটু আশ্বস্ত হলেও ননীর মা’র চিন্তা যেন কিছুতেই কমে না।
এক রাতে ননী বাড়ি ফিরল না। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ননীর মা
চারদিকে ছোটাছুটি করতে লাগল। কে একজন বলল, থানায় ডাইরি করতে। ননীর মা থানায় গিয়ে
সব জানালো। পরের দিন থানা থেকে ডেকে পাঠালো তাকে। সেখান থেকে ওকে মর্গে গিয়ে লাশ
শনাক্ত করে আসতে বলল। উদভ্রান্তের মত মর্গে গিয়ে এক নজরেই চিনে ফেলল ছেলেকে।
পোস্টমর্টেম হয়ে গেলে শক্ত মুখে মড়া বাড়ি নিয়ে এসে তার দাহকাজ করল।
বাড়ি ফিরে ননীর মা’র ছেলের সেলাই করা শরীরের দৃশ্য বারবার
মনে পড়তে লাগল। অস্ফুটে নিজেকে বলল, আবার সেলাইয়ের কাজ শুরু করতে হবে।