গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

রুখসানা কাজল

ওরা কারা

দ্রুত খাতা কাটছিল রুহি। যত শিঘ্র সম্ভব বাসায় ফিরতে হবে। মার শরীর ভাল নয়। বড় দুই বোন ঢাকায় আর ভাইয়া বিদেশে। মার কাছে একমাত্র রুহি থাকে। বাবা মারা গেছে অনেক আগে। রুহির ঠিক মনে নেই বাবার চেহারা। তবে এটুকু মনে আছে বাবা ওকে কখনো কাছে ডেকে নেয়নি আদর করেনি এমনকি কথাও বলেনি। ছোট বেলায় বাবার কাছে ছুটে গেলে তনু আপু ওকে সরিয়ে নিয়ে যেত। একটু বড় হতে দেখেছে বাবা আর ভেতর বাড়িতে আসত না। সারা দিন সামনের অফিস ঘরে মক্কেল সামলে রাতে ঘুমুতো অফিস ঘরের ছাদের ছোট্ট রুমে। আস্তে আস্তে সবার থেকে দূরে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিল বাবা। ইশকুলে যাওয়ার পথে রুহি দেখত বাবা কালো মাফলারে মাথা ঢেকে অফিসের চেয়ারে বসে নাস্তা খাচ্ছে আর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আমানত মুহুরি। এই আমানত মুহুরিকে রুহি দুচোখে দেখতে পারত না। ক্লাশ সেভেনে নতুন ক্লাশে ভর্তি হয়ে বাসায় ফিরছে রুহি। অফিস ঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে আমানত মুহুরি ডাক দেয়, অ রুইই দেখি ভরতির কাগজখান দেও ত। ভর্তির কাগজ , বেতনের রশিদ হাতে নিয়ে সেকি হাসি শয়তানটার। রুহির ইচ্ছা করছিল দেয় একটা লাত্থি মেরে। এমনিতে রাস্তা ঘাটে কোথাও দেখা হলেই রুই রুই করে ডাকে। অসহ্য লাগে রুহির। কাগজগুলো ফেরত দিয়ে পচা চোখে বলেছিল, গরীবের ছেলে বলে সংসার ছাড়ি যাতি পারতেছে না নাহিদ মিয়া। তাইতে তোর মত মিলিটারির মাইয়ের বাপ হতি হচ্ছে তারে!

কথাটা তখন বোঝেনি রুহি। কিন্তু নাইন টেনে উঠে বুঝে গেছিল সে একজন যুদ্ধশিশু। তার জন্মদাতা এই নিরীহ উকিল নয়। কোন এক পাকিস্তানী সৈন্য । সেই থেকে রুহি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পড়াশুনা, ইশকুল, বাসা আর বই। প্রতি বছর বাবা তার নিজের তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে যেত। কখনো রুহি আর ওর আম্মুকে নিয়ে যেতো না। মাঝে মাঝে রুহি আম্মুর সাথে মামাবাড়ি যেত। সেখানেই সে নানুবুজির কাছ থেকে জেনে নেয় সব ঘটনা। কোনো এক গরমের দুপুরে যুদ্ধের জন্যে বন্ধ ইশকুলে তার মা, ইশকুলের বড় আপা আর অন্য একজন শিক্ষিকার সাথে গল্প করছিল। এমন সময় একটা মিলিটারি জীপে করে চারজন সৈন্য এসে ইশকুলের বড় আপার সাথে দেখা করতে চায়। চারজন সৈন্যই ছিল অল্প বয়সি। টগবগ ফুটছে। বড় আপার সাথে কথা বলে কি একটা কাগজ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। এসময় দেখে ফেলে রুহির মাকে। বান্ধবীদের ভেতর সবচে সুন্দরী, মোমরঙএর শরীর ছিল ওর মা নার্গিস আক্তারের। তিন ছেলেমেয়ের সাথে গাইড বুক দেখে ইংরেজিতে কথা বলত নার্গিস আক্তার, তানু ডোন্ট টাচ বালি। রেইন নামছে, ওয়েট হয়ো না। কিপ ড্রাই । ভুল ইংরেজি বলা খুব স্মার্ট আর সুখি মহিলা। কালোমত সৈন্যটা যে ছিল চারজনের ভেতর সবচে বড় আর সিনিয়র সে থমকে যায়। তারপর রাইফেল উচিয়ে ফায়ারের ভাব দেখাতেই দারোয়ান জলিল ছুটে পালিয়ে যায় ইশকুলের বাগানের ভেতর। রুহি বোঝে অই কালো সৈন্যটাই হচ্ছে ওর জন্মদাতা। ওকে দেখলে আম্মু কেমন ভয় ভয় চোখে তাকায়।

একটা বয়সে রুহির খুব ইচ্ছা করত পাকিস্তান গিয়ে লোকটাকে খুঁজে বের করে খুন করতে। কিন্তু কি করে চিনবে? আম্মু তো কিছুই বলতে পারে না। তাছাড়া আম্মুর মাথাও ঠিক নেই অই ঘটনার পরে। বাবাকে দেখলেই চেঁচিয়ে মারতে আসত , দালাল দালাল, রাজাকার রাজাকার, তুমি না বলেছিলে পাকিস্তানীরা গুড দ্যান বঙ্গালী ? নাউ কি ঘটলো? রুস্তম ফায়ার হিম। হি ইজ দ্যা গ্রেট রাজাকার। রুস্তম আম্মুর ভাইয়ের ছেলে। ফুপির এমন অবস্থা দেখে দাঁত কিড়মিড় করে ফুপাকে বলেছিলো, আমি মুক্তিযোদ্ধা হলে আপনাকে গুলি করে মারতাম। খাতা দেখা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় রুহি। ফাঁকা ইশকুল। আয়া দারোয়ান ছাড়া সবাই চলে গেছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ জোলেখা আয়া এক কাপ চা এনে দাঁড়ায় , কি খালা কিছু বলবা? মনসুর আইছে। দেখা করতি চায়। খুশির তরংগ বয়ে যায় রুহির মনে। এতক্ষণ যে তাড়া ছিল বাসায় যাওয়ার তার বদলে মনসুরের সাথে দেখা করার ইচ্ছাটাই তীব্র হয়ে উঠে, খালা পাঠায় দেও। আর চা দিও । ইতস্তত করে জোলেখা। কিছু বলতে চায় রুহিকে। সামান্য আয়া সে। কিন্তু রুহির আম্মুর অনেক কাছের। রুহিকে সে কোলে পিঠে করে বড় করেছে। জন্মের পর রুহিকে নিয়ে কি করবে তাই ভাবতে ভাবতে ওর মা কেমন পাগল পাগল হয়ে গেলো। সেই সময় রুহিকে সেই তুলে নিয়েছিল। রুহি বড় ভাল মেয়ে। মনসুরের পাল্লায় পড়ে জীবনটা গেছে মেয়েটার। আজো দুজনের কেউ বিয়ে করেনি। সমাজসেবা করে করে মনসুর পাগল। তার সাথে রুহিও আর এক পাগল। তোমরা কি বিয়ে করবা না ? রুহি এবার জোরে হেসে দেয়, খালা বিয়েটাই কি সব খালা? তয়? মাইয়া মানুষ না তূমি! মাইয়া মানুষ হলেই বিয়ে করতে হবে কে বলেছে? এইই ভাল আছি খালা। অন্তত কিছুটা ত মানুষের উপকারে লাগছি। মনসুর ঢুকে পড়েছে টিচার্স রুমে। আমানত মুহুরির এই ছেলেটাও এক পাগল। লোকে বলে পাজির ঘরের হাজি। রুহির সাথে বিয়েতে আপত্তি করায় আমানত মুহুরিকে ছেড়ে উঠে গেছে অন্য খানে।

রাস্তার শিশুদের নিয়ে দিনরাত এক করে দিচ্ছে দুজনে। তাদের লেখাপড়া করানোর সাথে সাথে সঠিক ইতিহাসটাও জানাতে হবে। প্রতিবারের মত লাল সবুজ শাড়ি হাতে মনসুর রুহির সামনে বসে গপ করে রুহির চা টা খেয়ে ফেলে। আন্তরিক রাগে গজগজ করে জোলেখা। মনসুরের জন্যে আনা চা ঠক করে রেখে চলে যেতেই জড়িয়ে ধরে মনসুর, খালা ও খালা আমার সোনা খালা তুমিই তো আমার মা সত্যি কিনা বল! আচ্ছা আজকেই আমরা বিয়ে করব তুমি খুশি? জোলেখার চোখে জল ভাসে। জলে মেশা স্বপ্ন ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে। কত বছর ধরে সে একটা সোনার চেন আর আংটি লুকিয়ে রেখেছে। মনসুর হোক আমানত মুহুরির ছেলে। সে তো আমার রুহিকে ভালবাসে। আহা সোনা বাচ্চারা আমার! অবাক হয় রুহি, এই তোর মাথামুথো ঠিক আছে ত ? একদম ফিট। টেবিলের উপর ঝুঁকে মনসুর নরম হয়ে বলে, চল রুহি বিজয় দিবসকে আমরা গেঁথে নিই আমাদের জীবনের সাথে! রুহির বুক কেঁপে উঠে, ক্লাশ এইট, ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে রুহিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল গেম মিস। ভূগোল মিস কেমন হেসেছিল, মিলিটারির মেয়ের সখ কত! জাতীয় সঙ্গীত গাইতে চায়! ওর বুকের ভেতর সুরে সুরে উড়ে আসে ভ্রমর, পাখনার ভাঁজ খুলে দুলে দুলে তারা গেয়ে উঠে , অনেক অনেকদিনের অনেক আবেগে জমিয়ে রাখা সেই পূণ্য সঙ্গীত, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে, ওমা আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী , সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি-