গিরগিটির মত লাইনটা তিন ভাজে রং পালটায় ,--- খুব ভোরভোর আসে
পেনশান প্রত্যাশী বার্ধক্য ভাতার দল ;
ওরা থাকে লাইনের একদম মাথার দিকে । টাইম’কলে জল আসার আগেই আসে কাজের মাসি , আয়া ,
ঠিকে ঝি আর যত দেশের দলানো মোচড়ানো এনামেলের ডেচকির মত ত্যাঁদড় ভিখারি আর ভবঘুরের
দল । বাবুপাড়ার বিশ্রামের সময় হাঁটুর বাত নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নেমে আসে বড় গিন্নি
, মেজ সেজ ন’ ফুলখুড়ি পদিপিসি তারামনি আয়ি----এদের কর্তারা কেউ পুলিশে , কেউ
ইনকামট্যাক্সে ; কারও ছেলে প্রমোটার , কারও কনডাক্টার , কেউ কেউ ভদ্র সুস্নাত
ইঞ্জিনিয়ার অথবা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ! তবে ভুঁড়িওয়ালা দশ আঙুলে বিশ আংটি
পরা গলায় গজমতি ঝোলানো বাঙালী বেনিয়া ভুটিয়া মাড়োয়ারি এরা পিক সময়ে আসে না ; ওরা আসে, হেলতে দুলতে এধীরে সুস্থে বেলা গড়িয়ে পাঁচে !
--‘ ঢ্যামনাগুলো ভলেন্টিয়ার মারিয়েছে ! পেছনের চামড়া তালের
আঁটি হয়ে যাবার জো হল , এখনও একটা চাকরি জোটাতে পারল না ---এমন ভাবখানা দেখাচ্ছে
যেন সরকারের ঘরে কত লেনদেন !’
--‘ তোর অত গা জ্বলছে ক্যান ? চাড্ডি ফরম ফিলাপ করে দিয়ে
দ্যাখা , দেখি কেমন পারিস !’ সোনালী বৌদির বেলেল্লেপনায় সুখীর তোলা পর্যন্ত কুটকুট
করে উঠল ! সুখী মনে মনে ভাবল ,--‘ দুবাই থেকে মোতলা মোতলা পাঠাচ্ছে তো এই জন্যে
ভারি তেল তোমার ! এজেন্টগুলো তো ভালোই জোগাড় করেছ---নোটেও আছে ঠোঁটেও আছে !’ এরপর
ওঁর গায়ে গুঁতো লাগতেই একেবারে খেকিয়ে উঠল –‘ এই যে দ্যাখ বৌদি , পরেশ কাকুর পাঁচ
পাঁচটি ছেলে ; উনার কণ্ঠি এখন একঢোক গঙ্গা জলের জন্যে ফাটছে , আর উনি এয়েছেন কিনা
লাইনে দাঁড়াতে ! হাজাপচা লাগলে ছেলে বৌমা , রোগবেদ্দ্যিতে ছেলে বৌমা , তেত্তধম্মেও
তারা--- আর এখন কড়ি গুনতে একা ! বলিহারি আহিংকে বাপু !’
--‘ তোর মুখে তো সকাল থেকে খই ফুটছে রে !’ পেছনে দাঁড়ানো
পান্না জেঠির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল ,--‘ আমি পেত্তম দিন থে’ই লক্ষ্য করছি , তুই সকাল
সন্ধ্যে এসে লাইনে দাড়াচ্ছিস ! খাস তো বাসন মেজে রোজ রোজ এত এত মোটা বাণ্ডিল কোথায়
পাচ্ছিস শুনি !’ সুখী নিঃশব্দে লাইন থেকে সরে দাঁড়াল । হাতে তাঁর অনেক কাজের চাপ ;
এত খুচরো কথার কচকচানিতে সে তাঁর ওয়েট নষ্ট করতে রাজি নয় !
--‘ ঠাম্মা আমার লাইনটা কিন্তু এখানেই ছিল ।‘
---‘ এখানে তো ওই সুখী ছুড়িটা দাঁড়িয়ে কটরকটর করছিল !’
---‘ আমি ওর পেছনেই ছিলাম ।‘
--‘ তুমি যে একবার ভেতরে ঢুকলে দেখলাম ?’
--‘ আসলে হারাধন জেঠুর অনেক বয়েস হয়েছে তো , একটু হাতখান
ধরে ভেতরে নিয়ে গেলাম আর কি !’ মহামায়া ঠাম্মা তাঁর দুর্গাদরদী হাতখানা রাহুলের
মাথায় বুলিয়ে দিলেন,-- ‘ বাহ ! বাহ ! এই না হলে একালের ছেলে ! আমিও চাড্ডি পেটে
ধরেছি ! টাকার গন্ধ পেলে একেবারে হাঙরের মত মুখ বাড়িয়ে থাকে ! আর বৌ গুলোও জুটেছে
তেমনি , হাসি তো না যেন একএক পদের আগুনের হল্কা ! তোমার বাবা আসেনি বুঝি ? কি
ফ্যাসাদেই না পড়া গেল বলতো !’
--‘ বাবা দেবে আমার হাতে টাকা ! তা হলে তো হয়েছে ! অমন
টাকায় গুলি মারি !’
--‘ অ হরি ! বল কি ! তবে এই কচিডবগা বয়সে তুমি এই লাইনে
ক্যান ? চাকরির ফরম দিচ্ছে বুঝি ?’
--‘ না ! তুমি ওসব বুঝবে না ! পঞ্চাশ দিন একটু ভালভাবে হাত
চালাতে পারলে অমন ম্যান্তাপড়া চাকরির জন্যে আর ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে হবে না ! আর
তাছাড়া চাকরি কোথায় যে সরকার দেবে ! বুঝলে ঠাম্মা , একদিন সরকার আমরাই চালাব দেখে
নিও !’
কচ্ছপের ব্যামো ! লাইন মোটে সরে না ! মহামুশকিলে পড়েছে
মহামায়া ঠাম্মা । দুদিন বাদেই নাতিপুতি নিয়ে ছেলেরা তাঁর বিদেশ থেকে ফিরবে । একে
সরকার মেয়েলি প্রাইভেসি ল্যাংটো করে ঝাড়তে শুরু করেছে খোলা বাজারের মধ্যেখানে ;
তার ওপর ছেলেরা এসেই যদি তারা শোনে যে তাঁর মা , অসুস্থ্য বাবাকে একলা ফ্লাটে ফেলে
রেখে দিনের পর দিন বাইরে কাটিয়েছে তখ কি যোগ্য জবাব দেবে সে ! নাহ ! ছেলেগুলো
সত্যি হেল্পফুল ! দিনরাত এক করে যেভাবে খাটছে ---সত্যি
তুলনা হয় না ! বিশু’দা একঘণ্টা অন্তর অন্তর আসছেন আর সবাইকে পিঠ চাপড়ে আবারও অন্য
ব্যাঙ্কের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিচ্ছেন ! কাউন্টারের কর্মী গুলো কি সব রানীক্ষেতে
আক্রান্ত হল না কি রে বাপু ---দশখানা গুনতে কি দশধণ্টা সময় লাগে ! কটু ভাষা আর
হতাশার অন্ধকারে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে !
--‘ স্যার দাঁড়ান ! দাঁড়ান ! অপারেশান হবে ? বাইপাস
সার্জারি ?’
--‘ না না ! ডেলিভারি !’
--‘ এখানে ক্যান স্যার ! নার্সিংহোমে চলুন না ----আমরাই
আপনাকে হেল্প করছি ! টাকার চিন্তা করবেন না স্যার , যত লাগে আমরা আছি ---এই নিন না
; আরও লাগলে আমরা আছি স্যার !’ অবাক করা
ভারতবর্ষকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গেল অমিও ! পঁচিশ কিলোমিটার পথ
অতিক্রম করতে করতে মুখে শুধু ছিল –ওহ মাই গড ; আর এই মুহূর্তে তাঁর ঠোঁট ফুঁড়ে
আপনিই উচ্চারিত হল—থ্যাংস আ লট ! হাসপাতাল করিডোরের প্রতিটি অচেনা মানুষই যেন তাঁর
চোখে দেবদূত , স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে তাদের আগত সন্তানকে ভাল আলোহাওয়া দেওয়ার
আকুল আবেদন নিয়ে ! দ্বিধা ও সঙ্কোচের মধ্যে টাকার বাণ্ডিলসহ প্রশেন্ট ঢুকে গেল
ওটিতে ! একমাত্র ফটকে আর এমারজেন্সিতে দুটো বড় বড় লাইট । বাকি এক কিলোমিটার
হাসপাতাল চত্তর জুড়ে থান থান দলা পাকানো অন্ধকার ! এ্যাম্বুলেন্স যাওয়া আসার মত
মাপে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ধুলোর ওপরেই বিছানা পেতেছে আশ্রয়হীন রোগির আত্মীয়রা ! বিকার
বিতাড়িত আলোয় খানিক খানিক দ্যাখা যায় তাদের অরক্ষিত অঙ্গ আর সেইসাথে ক্লান্তি ও উদ্বেগ হরণকারী অস্থির
যৌন তিয়াসা !
ঘণ্টা দুএকের মধ্যে পেশেন্ট পার্টি বাইরে বেরিয়ে এল । অনেক
প্রত্যাশা আর হাসিমুখে ছুটে আসেন সাহায্যকারী দেবদূতের দল ---‘ স্যার ! আপনার পাশে
দাঁড়াতে পেরে সত্যিই আমরা ধন্য ! আপনার পেশেন্ট ঠিক আছে তো স্যার ? আরও যদি
কিছু------!’
---‘ না ! ধন্যবাদ ! ওপরওয়ালার আসীম কৃপায় নর্মাল ডেলিভারি
হয়ে গেল ! এক সপ্তাহ আগেও ডাক্তার স্যার যেভাবে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ! ওফ ! আজ উনি
বললেন একটাকাও আপনার খরচ করতে হবে না ; সরকার আপনাদের জন্য এত এত খরচ করছে কি
শুধুমাত্র সিজার সিস্টেমকে চালু রাখারও জন্যে ! ধরুন ! আর দয়া করে একটু গুনেও
নেবেন প্লিজ !’ এমারজেন্সিতেও লোডশেডিং হয় ! লোকগুলোর মুখ কিন্তু তখনও দারুণ
উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল ! টাকার বাণ্ডিল ব্যাগে ঢোকানোর আগেই অন্য একটা এ্যাম্বুলেন্সের
ভয়ংকর আর্তনাদ লক্ষ্য করে ওরা দ্রুত তাঁর পিছু নিল ! অমিয়ও তাঁর সাদা বুদ্ধিতে
সন্তানসুখে শতকণ্ঠে কুর্নিশ জানাল !
আজ আরামে চোখ বুজে আসছে বলরামের । রাঘববোয়ালগুলো দেশের দিকে
এবার তাকাচ্ছে একটু ! কোটি হলেও সেই দেড় লাখের ফাইল , রঞ্জলি হলেও সেই আর হাবরার
চাল পট্টি হলেও সেই একই কলামের রিটার্ন ফাইল ! এটুকু বিবেচনা না করলে আমাদের পক্ষেই
বা আর কতদিন ওদের শেল্টার দেওয়া সম্ভব তাই না !’ গোপা কথায় কোনও হ্যাঁ হু করে না ।
বলরাম বুঝল স্ত্রীকে পাশে নগ্ন রেখে অন্য পুরুষের প্রসংশা করতে নেই , তাতে রমণ
কল্পনায় অন্য রং লাগিয়ে দিয়ে যায় ! আলস্যের হাতখানা বলরাম গোপার বুকের ওপরে রাখল !
একটা দুটো কথা স্ত্রীলোকের কর্ণমূলে না দিলে রতিসুখ তেমন একটা আসে না , তাই চেপে
চেপে বলরামকে বলতে হয় ,--‘ দারুণ নরম ! এই হচ্ছে আসল ফিগার ! আজ আর একদম খোঁচা
লাগার ভয় নেই ---গয়নাগুলো কোথায় সরালে গো ?’ গোপার চোখে জল ! এই যুদ্ধকালীন
পরিস্থিতিতে এই কদিনে তাঁর ওপর যে কতটা ধকল গেছে , সে কি করে বোঝাবে ! বোঝালেও কি
বোঝে , পুরুষের মন আর পান্তাপড়া পাথর সবই এক ! তবু ভাল এতদিন পরে তার নিভে আসা
শরীরের ওপর একটু হাতের আঁচড় পড়েছে ! ---‘ চলো কিছুদিনের জন্যে বাইরে কোথাও বেড়িয়ে
আসি ! যাবে ?’
--‘ যা করছ তাই কর !’ গোপা
নিজেকে আরও একটু বিছিয়ে দিল ,--- এই মুহূর্তে যেটুকু
না দিলে নয় !
---‘ সত্যি বলছি যাবে ! ডাক্তার কাকু , আমাদের ম্যানেজার
মেসো ---অনেকেই যাওয়ার জন্যে বলছেন !’
---‘ ট্রেনের টিকিট বুকিং এর লাইনে দাঁড়ালেও কিন্তু সরকার
এখনও গায়ে কালী লাগিয়ে দিচ্ছে , এবং লক্ষ্য রাখছে তুমি আদৌ সেখানে যাচ্ছ কিনা !’
বৌটা মারাত্বক বুদ্ধিমতী ! কথার মারপ্যাঁচে হাইকোর্টের উকিলও ওর কাছে বাচ্চা !
সোহাগে জড়িয়ে ধরে বলরাম ! কিন্তু আদি উত্তেজনা আর কিছুতেই যেন আসে না ! রাত গভীর
হলে শুনি বয়সও তরুণ হয় , তবে এখনও কি টেনশান তাড়া করে ফিরছে তাকে ? গোপার আসল
খাতায় অনেক বাকি পড়ে আছে তার ! বলরাম লজ্জা পায় , আজ হয়তো একটু অন্য অলংকার
চেয়েছিল তার গোপা ! দিতে পারবে না সে ? কথা ফুরিয়ে আসে !
গোপা তখনও আপ্রাণ সাহায্য করতে থাকে ! বয়স বাড়লে মাঝে মাঝে অমন একটু আধটু হয় , এটা
সে বোঝে ! এই তো রাত পোহালেই কত বুড়ো লাইনে দাঁড়িয়ে মাথা
ঘুরে পড়ে গিয়েও পরক্ষণেই লাঠি উচিয়ে দিব্যি খাড়া হয়ে
দাঁড়িয়ে পড়ছে ----- ! দেশের জন্যে কত লোক কতকিছুই না করছে ; আর বলরাম তার
ক্ষুধার্ত স্ত্রীর জন্যে এটুকু করতে পারবে না ! গোপার বিশ্বাস, স্বামীকে সহযোগিতা
করলে সেও নিশ্চই প্রকৃত পুরুষের মত উঠে দাঁড়াবে !