গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সুবীর কুমার রায়

  ধরায় আগমন


তিনটি লাইন ও দু’টি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে বেশ বড় ও ব্যস্ত একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই সময়টায় অফিস যাত্রীর ভিড়ে এমনিতেই লোক সমাগম ও ব্যস্ততা একটু বেশি থাকে, আজ আবার ট্রেন বেশ বিলম্ব থাকায়, ভিড় যেন উপচে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরেই আপ প্ল্যাটফর্মের এক পাশে সিঁদুর মাখানো একটা পাথর রাখা আছে। পাথর, তাই এটি কোন দেব বা দেবী বোঝার কোন উপায় নেই, জানবার কোন আগ্রহও কারো বিশেষ একটা আছে বলেও মনে হয় না। যে যার ইষ্টদেবতা কল্পনা করে, এক-আধ টাকা ছুড়ে দিয়ে নিজনিজ মনস্কামনা পূর্ণের আশা করেন। স্থানীয় বিল্টুদা পরম যত্ন ও আগ্রহে পাথরটির দেখভাল করেন। পাথরের অধিকার নিয়ে বহুবার তর্কাতর্কি, মারামারি, এমনকী রক্তারক্তি কান্ডও ঘটে গেছে। এটাই স্বাভাবিক, কারণ পাথরের অধিকার যার, প্রণামির অধিকারও তার।
  
একজন গরিব অন্ধ ভিক্ষুক অন্যান্য দিনের মতোই ভিক্ষার আশায় এই পাথরটার পাশেই বসে আছে। সারা দিনে পাথরের ভাগ্যে অনেক এক টাকা, দু’ টাকা, এমনকী পাঁচ টাকার কয়েন বৃষ্টি হলেও, অন্ধ ভিক্ষুকের হাত প্রায় শুন্যই থেকে যায়।

আজ একসাথে অনেক লোক সমাগম হওয়ায়, পাথরের ওপর দৃষ্টি ও বৃষ্টিপাত অধিক হলেও অন্ধের হাতে সেই বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও পড়ে নি। রুগ্ন, শীর্ণ, অসুস্থ, অভুক্ত ভিক্ষুকের মিনমিনে আওয়াজ হয়তো কারও কানে প্রবেশও করছে না।

ডাউন প্ল্যাটফর্মে স্থানীয় একটি বেকারির কর্মচারীরা কেক, রুটি, প্যাটিস, ইত্যাদি বিভিন্ন স্টেশনের দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য হাল্কা হাল্কা নরম কাঠের পেটিতে সুবিধা ও চাহিদা মতো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত। আজ আবার এই প্ল্যাটফর্মে এক নতুন অতিথির আগমন লক্ষ্য করা গেল। হাঁটুর ঠিক নীচ থেকে দু’টি পা-ই কাটা, এবং সেখানে দু’টি টায়ারের টুকরো বাঁধা একটি নতুন ভিক্ষুক, ভিক্ষার আশায় বসে আছে। ইংরাজী সি (C) অক্ষরের মতো দেখতে দু’টো কাঠের তৈরি হাতলের ওপর ভর করে পা দু’টো ঘষটে ঘষটে সে এক স্থান থেকে অন্যত্র যাতায়াত করে। বেকারির একজন কর্মচারী কোন অজ্ঞাত কারণে দয়াপরবশ হয়ে তাকে কাগজে মোড়া একটি ছোট কেক খেত দেয়। খঞ্জ ভিক্ষুকটি কিন্তু কেকটি না খেয়ে, অদ্ভুত ভাবে ডাউন প্ল্যাটফর্ম থেকে লাইনে নেমে দু’টি লাইন পার হয়ে, আবার অদ্ভুত ভাবে অতি কষ্টে আপ প্ল্যাটফর্মে উঠে এসে, অন্ধ ভিক্ষুকটির কাছে গিয়ে হাজির হয়। এরপর ঝোলা থেকে কেকটা বার করে সে অর্ধেকটা অন্ধ ভিক্ষুকটির হাতে দেয়।

ট্রেন এসে যাওয়ায় সবাই হৈ হৈ করে ট্রেনে উঠে গেলে, দুই ভিক্ষুক পাশাপাশি বসে নিজ নিজ অংশে পরম তৃপ্তিতে কামড় বসায়। আজ কিন্তু ঘষামাজা পাথরের দেবতার থেকে, নোংরা শতচ্ছিন্ন পোশাক পরিহিত এই ভিক্ষুকটিকে অনেক বেশি উজ্জল ও করুণাময় বলে মনে হ’ল।