গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

এলি কি গো উমা

“ উহ, এখনো আলো ফোটেনি তোমার কি ভীমরতি হয়েছে গো। এখন কেউ গান ধরে।”ভোরের মিঠে ঘুম ভেঙে সুহাগি বুড়ি বালিস থেকে মাথা তোলে। বুড়ো এক মনে ভাঙা গলায় গান করে চলেছে। না আছে সুর না আছে মাধুর্য। এ পাড়ায় দুজনের বাস এখনো এক কুড়ি বছর পার হয়নি। এক টুকরো জমিতে সুহাগি বুড়ি আর কালো বুড়ো আনন্দ করে থাকে। একটা ঘর , একলা একা বারান্দা আর চাঁদের আলো মাখা এক টুকরো উঠান।উঠানে পুঁই মাচা, দোপাটি ফুলের গাছ, এই সবের সাথে একটা ‘টিপকল’ । এই টিউব ওয়েল কে নিয়ে বুড়ির খুব গর্ব ।ওদের ছেলে করে দিয়েছে। পাড়া সুদ্ধ লোক জল নিয়ে যায়। বুড়ি কক্ষনো রাগ করে না।

তাদের দেশ কোথায়  তারা বলতে পারে না। হয়তো নদী প্লাবনে ভেসে যাওয়া কোন গ্রামে। সংস্কৃতির শিকড় হীন দুটো মানুষ। সরল পরিশ্রমী আর অবশ্যই সাধারণ। নিজেরা অক্ষর হীন কিন্তু ছেলেকে যত্ন করে লেখা পড়া শিখিয়েছে। পাড়ার মাস্টার দামু বাবু তাঁকে ন্যাংটা বেলা থেকে পড়িয়েছেন।ছেলে এখন শহরে চাকরি করে। সংসারী। উৎসবে , অসুখে মা বাবার কাছে আসে। পাড়ার লোকজন কালো বুড়ো আর সুহাগি বুড়ি কে খুব ভালোবাসে । ওদের অভাব থাকলেও নিঃস্বতা নেই । চাহিদা নেই তাই অসুখ নেই।
পাড়ায় মাস্টার দামুবাবুর ছেলের বউএর একটা গানের ইস্কুল আছে। সেখানে দুগ্‌গা ঠাকুরের গান হয়। পুজার সময় অনুষ্ঠান হবে। বুড়ো সামনের বারান্দায়  বসে গান শোনে। “এলি কি গো উমা” গান টা সেখান থেকেই শেখা।দামু বাবু বুড়ো কে সম্মান করে। তিনি জ্ঞানী মানুষ ,ভক্ত লোক-বলেন, ভক্তিভরে মাকে ডাকলে তিনি দ্যাখা দেন। সেই থেকে ভীমরতি বুড়োর। এমনি তেই রাতে ভাঙা ভাঙা ঘুম হয়। আধা তন্দ্রা আধা জাগরণে গান করে। আর মাঝে মাঝে বলে “আয় মা আমার ঘরে আয় মা ।”
বুড়ির ভোরের মিঠে ঘুম ছেড়ে বালিস থেকে মাথা তোলে। আজ আকাশ পরিষ্কার হলে কাপর কাচতে হবে। বড়ি রোদে দিতে হবে। ওদিকে দেবীর হয়েছে মহা মুশকিল । কোটি পূজার আসন। কিন্তু আবাহন নেই।উনি তো আর স্বয়ম্ভু মহাদেব নন , যে নিজে নিজে আবির্ভূত হবেন। যশ, অর্থ, রূপ চাইছে সকলে।কিন্তু আবাহন ছাড়া আবির্ভাব করেন কি করে? কিন্তু হঠাৎ বাতাসে এতো পারিজাত সুবাস, আকাশে যেন প্রগাঢ় প্রশান্তি। কে যেন ডাকে।

         ছেলে দুর্গাপূজায় আসবে না। সুহাগি বুড়ির তাই বড্ড মন খারাপ। আজ দুর্গাষষ্টী বলে কি আছে। বুড়ি ওসব জানে না। দামু বাবুর মা বলছিলেন।“ অনেক গান হোল বিছানা ছাড়ো,... ওঠো চোখে মুখে জল দাও।”বুড়ো লুঙ্গী সামলে ওঠে । দড়িবাঁধা চশমা চোখে লাগায়। দোর খুলে নেমে যায় উঠোনে। তারপর...
   তারপর, “ ও অজিতের মা। ওগো আমাদের কি সৌভাগ্য গো। দ্যাখো কি কাণ্ড। ওগো তাড়াতাড়ি এসো।” বুড়ি ঘর ছেড়ে এসে দ্যাখে ওমা একী কাণ্ড। লাল শাড়ি পড়া সুন্দরী মেয়ে। দশ টা হাত। হাতে সব ধারালো অস্ত্র শস্ত্র। গা থেকে আলো ঠিকরে বার হচ্ছে।সঙ্গে আবার চারতে ছেলে মেয়ে। উঠোনে যেন হাজার টিউব লাইট জ্বলছে। হতভম্ভ বুড়ি কে বুড়ো বলে, “ ও সুহাগি, আমি যা দেখছি তুই ও তাই দেখছিস”। বুড়ির চমক কেটে সংসারী বুদ্ধি স্থির হয়। ভয়ে সে থরহরি হয়।এদের সে কিভাবে যত্ন করবে। বসতে দেবে কোথায়? খেতে দেবে কি? ভালো বাসন ...? তাঁর যে কিচ্ছু নেই। মস্তিষ্কে আরও ভয় আসে। যদি পুলিশ আসে। পার্টির গুণ্ডারা আসে। আরে এরা যদি অন্য কিছু হয়। মাথার মধ্যে তার যত পাকিয়ে ওঠে। বাসি মুখে সে ঝাঁজিয়ে বলে, “ আমার বাড়িতে যত উতপাত......তুই কি সারা জীবন আমার হাড় জ্বালাবি”। বালিকা কালে শেখা যতো গালাগালি আছে সব উগরে দিতে থাকে সে। বুড়ো সজল নয়নে দেবি আর তার সন্তান দের নিয়ে বাড়ীর চৌহুদ্দির বাইরে চলে যায়।

তারপর যা হবার তাই হোল। দামু বাবু এলেন।‘ক’বাবু, ‘খ’বাবু, ‘গ’ বাবু সকলে এসে দেবীকে যথাযথ সম্মানের সাথে স্থাপন করলেন।বক্স বাজিয়ে, ফুল ছিটিয়ে,ঢাক পিটিয়ে, মন্তর পড়ে পুজো শুরু হোল। বুড়ো সারাদিন ওখানে থেকে গেল। বাড়ী ফিরল না।  

বুড়ি সারাদিন নাওয়া নেই খাওয়া নেই। এমন পাষাণ বরের জন্যে তার জীবন ছাড়খার হয়ে গেল। ছেলে এলে এই সব কথা জানাবে। সারাদিন খুব কাঁদলে। সন্ধ্যে এলো ।রাত ঘন হোল। ভোরের দিকে মন থেকে অভিমানের মেঘ ধীরে ধীরে কেটে গেল। বুড়ো কি এলো? এখনো এলো না? সে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো মণ্ডপের পাশে।কালো কুকুর , লাল কুকুর, নিদ্রিত ঢাকি আর তার একপাশে শিশুর মতন ঘুমোচ্ছে বুড়ো। বুড়ি দেবীর দিকে তাকালো। স্মিত মুখে দেবি তাকিয়ে আছে। বুড়োর কাছে গিয়ে বুড়ি ডাকে, “ ওঠো ... এদের নিয়ে বাড়ী চলও। ছেলে মেয়ে দের নিয়ে দেবী এসে দাঁড়ালেন বুড়োর উঠোনে। বুড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন তাদের। দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে “ মা গো এই সব মুকুট অস্তর শস্তর ছেড়ে আরাম করে বয়স এই দাওয়া তে। টিপকল থেকে জল তুলে দিচ্ছি। চান করে একটু ঘুমিয়ে নাও। সেই সকাল থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছো”।

অবাক কাণ্ড। অস্ত্রশস্ত্র সব ঝনঝন করে মাটিতে ফেলে দেয় দেবী। আর হু হু করে কেঁদে বলে, “ কতদিন ধরে অপেক্ষা করেছি। কত সহস্র বছর। আমাকে কেউ বলে না গো। আমারও তো এই সব ছেড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে ।আর পারিনা। আমাকে কেউ ঘুমোতে দেয় না। কেবল চায়। অর্থ চায়, জয় চায়, শত্রুনাশ চায়...”।
বুড়ো অতশত কানে শুনতে পায় না। আনন্দ করে ভাঙা গলায় গান ধরে, “এলি কি গো উমা
হর মনোরমা কৈলাস চন্দ্রমা হলি কি উদয়। মা বলে একবার আয় কোলে আমার না হেরি সংসার হেরি শূন্য ময়”।