গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

চন্দনকৃষ্ণপাল

দুজনের গল্প

অমুঃ

স্যারের বাসায় পৌঁছেই কড়া নাড়লাম আমি। ভেতরে কে জানি হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্র সংগীতের সুর তুলছে। থামছে মধ্যে মধ্যে আবার বাজাচ্ছে। প্রথম দুবার কড়া নাড়া মিস হলো। তৃতীয়বার হারমোনিয়াম থামতেই নাড়লাম। বুঝলাম কেউ হেঁটে আসছে। একটু পর দরোজা খুলে গেল।
-কাজে চাই? মিষ্টি কণ্ঠ। তাকালাম। ষোড়শী। একরাশ স্বপ্ন জড়ানো চোখ। স্থির দৃষ্টি।
-স্যার আছেন?
-না, কোন দরকার আছে? সুরের ঝংকার কণ্ঠে।
-হ্যাঁ এই টাকাগুলো স্যারকে দেবেন। তার হাতে টাকা গুলো তুলে দেই। আমি স্পষ্ট বুঝি আমার হাত কাঁপছে।
-কিছু বলতে হবে?
-না। খুব তাড়াতাড়ি করে চলে আসি আমি। বাইরে এসেও আমি বুঝি এক জোড়া চোখ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা অস্থিরতা আমার ভেতর জন্ম নেয়। সে অস্থিরতার কোন স্বরূপ আমি খুঁজে পাইনা। কিছু কাজ ছিল। কিছু করতে পারিনা। একটা কণ্ঠ, একটা ছবি বার বার আমাকে আনমনা করে দেয়। আমি নিজেই অবাক হই। আজ পর্যন্ত অনেক মেয়ের সাথে মিশেছি। এতটুকু দুর্বলতার ছোঁয়াও অনুভব করিনি বুকের ভেতর। প্রেম বলে সে কথাটা প্রচলিত তা শুধু বইয়ে পড়া একটা সাধারণ শব্দ হিসেবেই জানতাম। বন্ধুদের ডুবে ডুবে জল খাওয়াকে কৌতুকের চোখেই দেখেছি বরাবর। তাহলে আজকে আমার এ কি হল। ঐ মেয়ের সাথে তো আমার কখনও দেখা কিংবা কথা হয়নি। এই প্রথম। কিন্তু এ রকম হল কেন? সামনে সেভারী
¯œকস। কেবিনে ঢুকে বসে পড়ি। বুকের ভেতর কালবৈশাখির ক্ষীপ্রতা। একটা ঝড় তোলপাড় করে দিচ্ছে মন-মানসিকতাকে। আজ আমার কি হল? এ অনুভূতির নাম কি। কোন উত্তর পাই না আমি। পাইনা!

মিতুঃ

দুপুরের পর থেকে কেন জানি কিছু ভালো লাগছে না। কলেজ থেকে ফিরে এসেই এ রকম মনে হচ্ছে। মা খেতে বলেছেন বার বার। খেতে পারিনি। বুঝতে পারছি না কেন এ রকম হচ্ছে। আগামী রবিবার কলেজে নবীনবরণ। শুক্র শনি বন্ধ কলেজ। কিভাবে কাটবে সময়। কলেজ থাকলে না হয় বান্ধবীদের সাথে দুষ্টুমী করে কাটিয়ে দিতে পারতাম। তাও নেই। তারপর এই বিশ্রি অনুভূতি। অনুষ্ঠানে নতুনদের পক্ষ থেকে গান গাইতে হবে আমাকে। কি যে গাইবো সিলেক্ট করতে পারছি না। অথচ একটা কিছু গাইতে তো হবে। ভীষণ একটা সমস্যা। হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে কয়েকটা গানের প্রথম চরন তুলছি। কিন্তু কেন জানি জুৎ হচ্ছে না। ধুৎ। রীড ছেড়ে গীত বিতানের পাতা ওল্টাই। ঠিক এমন সময় বাইরের কড়া নাড়ার শব্দ। প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। কে এলো এখন। ভাইয়ার কোন বন্ধু টন্ধু নাতো। দরোজাটা একটু ফাঁক করে তাকাই। একটা ছেলে। বিশ বাইশ এর মত বয়েস। শ্যামলা। ছেলেটাকে দেখে বুকের ভেতর কেমন করে আমার। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। সে চাওয়া বুকের ভেতরে একটা দীর্ঘ ঢেউ খেলে। বাবা বাসায় নেই শুনে একটু কি যেন চিন্তা করে। তারপর প্যান্টের ব্যাক পকেট থেকে একটা ক্রীম কালারের মানিব্যাগ বের করে কয়েকটা নোট বের করে বাবাকে দেয়ার কথা বলে। আমার হাতে দেয়। দেয়ার সময় ছেলেটার হাত কাঁপে। আমি বুঝি। কেমন যেন লাগে। আজি জিজ্ঞেস করি-
কিছু বলতে হবে। ও শুধু না আসি বলেই চলে যায়।আমি তাকিয়ে থাকি। ধীর পায়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। আমার চেতনায় একটি নূতন সুর খেলা করে। ছেলেটার তাকানোটা ভুলতে পারিনা। আমার এই সতের বছর বয়সে কত জনের সাথে পরিচয় হলো। কত জনের চোখের ভাষা দেখলাম কিন্তু এ রকম তো মনে দাগ কাটেনি কেউ। এ ছেলে কে? আগে তো কখনও দেখিনি। তুমি যে হও তোমার সাথে আবার আমার দেখা হবে ছেলে। হবেই!

অমুঃ

আজ নবীন বরণ কলেজে। ঝকঝক করেছে কলেজ। সারা কলেজটাই যেন নবীনদের বরণ করবে বলে প্রস্তুত হয়ে আছে। প্রথম ঘন্টার পর পাল স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন। খুব সম্ভব অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমি স্যারের রুমে আসি।
অমু অনুষ্ঠান ঘোষণায় তুমি থাকবে। বুঝেছো। এই নাও লিষ্ট সমস্ত কিছু তৈরী আছে। তুমি ঠিক সোয়া এগারটায় অনুষ্ঠান শুরু করবে। আরো কিছু কথা বার্তায় পর চলে আসি আমি।
পৌনে এগারটায় অডিটরিয়ামের ডায়াসে এসে দাড়াই আমি। সারা হল ভর্তি ছেলে মেয়ে। সামনে এক সার চেয়ারে স্যার ম্যাডাম আর অতিথিবৃন্দ।
আমার হৃদপিন্ড লাফ দিয়ে ওঠে। মেয়েদের আসনগুলোর প্রথম দিকেই সেই মেয়েটি। নির্ঘাৎ ফাস্ট ইয়ার। আমার বুকের ভেতর কেমন একটা ভালোলাগার স্রোত বয়ে যায়। ঘোষণাটা একটু ভালো করে করতে হয়। এক ধরণের চঞ্চলতায় পেয়ে যায় আমাকে। অনুষ্ঠানের প্রথমে আলোচনা। মুখ্য আলোচকদের পূর্বে নতুন পুরনোরা বক্তব্য রাখে। ২য় পর্বে বিচিত্রানুষ্ঠান। স্যারের অনুরোধ ফেলতে না পেরে আমাকেও আবৃত্তিতে অংশ নিতে হয়। আবৃত্তি করি। হাততালিতে বুঝি খারাপ হয়নি। ঐ মেয়ের চোখে চোখ পড়ে যায়। চোখ নামিয়ে নেয় মেয়ে। আজ আরো অপূর্ব লাগছে। তোমার সাথে আমি পরিচিত হবো মেয়ে এবং আজই। মনে মনে বলি আমি। অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। আর একজন মাত্র বাকী। আমাদের আজকের বিচিত্রানুষ্ঠানের শেষ শিল্পী অমিতা চৌধুরী মিতু। মিতু প্রথম বর্ষ বাণিজ্যের পক্ষ থেকে আমাদের রবীন্দ্র সংগীত শুনাবেন। সেই মেয়েটি উঠে দাড়িয়েছে।
 


মিতুঃ

কলেজটা আজ নূত সাজে সেজেছে। নবীর বরণ আজ। আমরা যারা নবীন তাদের আজ বরণ করে নিচ্ছেন পুরোনো ভাই-বোনেরা। বান্ধবীদের অনুরোধে বিচিত্রানুষ্ঠানে নাম দিতে হয়েছে আমাকে। এগারটার দিকে বান্ধবীদের সাথে অডিটরিয়ামে চলে আসি। সোয়া এগারটা। মাইকে এতক্ষণ আধুনিক গান বাজছিল। হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যায়। ডায়াসের দিকে সবার চোখ। ধীর পায়ে একটা ছেলে ডায়াসে এসে দাড়ায়। আমি চমকে উঠি। সেই ছেলেটা। চোখে চোখ পড়লে আমি চোখ নামিয়ে নেই। ছেলেটাও অবাক হয়ে গেছে। বুঝি। চমৎকার লাগছে ছেলেটাকে। খাদির একটা পাঞ্চাবীর সাথে নীল জিনস। চোখে অটো সানগ্লাসটা ধীরে ধীরে পরিস্কার হয়ে আসছে। পুরো হলের দিকে চোখ বুলিয়ে মাউথ স্পিকারটা হাতে তুলে নেয়।
ঃ সুধীমন্ডলী, আকেজর নবীন বরণ অনুষ্ঠান থেকে...... ভরাট কণ্ঠ। আসলে মানিয়েছে।
-কিরে একে বারে চুপ মেরে গেলি। ঘোষককে দেখে নাকি। মিনা খোঁচা দেয়।
-উঃ কি ঘোষকরে।
-এ কলেজের গত চার বছরের সমস্ত অনুষ্ঠানের ঘোষক ছিল অমুদা ।আর তুই বলছিস কি ঘোষক রে!
আমি চুপ করে যাই। আলোচনা চলছে। আলোচনার পর কবিতা আবৃত্তি। প্রথমে ও করে। এতো সুন্দর কল্পনা করা যায়না। হাত তালিতে মুখর হয়ে ওঠে হল রুম। আমি হাত তালি দিতে ভুলে যাই। বুকের ভেতর অজানা অনুভূতির একটা ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আমি আনমনা হয়ে পড়ি। কয়েক বার অজান্তেই চোখে চোখ পড়ে যায়। চমক ভাঙ্গে ওর ঘোষণায়, আমাদের আজকের বিচিত্রানুষ্ঠানের শেষ শিল্পী..............। আমি উঠে দাড়াই। প্রতিজ্ঞা করি আমার সমস্ত ভালোলাগা মিশিয়ে গাইবো আজকের গান। ঘোষক অমু হাসছে। আমি এগিয়ে যাই ডায়াসের দিকে।
অমু
আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি মিতু আসছে। ডায়াসে এসে একবার তাকায়। তারপর হারমোনিয়ামের রীডে আঙ্গুল রাখে। রবীন্দ্র সংগীতে অপূর্ব মুচ্ছনায় সারা হল মুখর হয়ে ওঠে। পিন পতন নিরবতা। আমি কল্পনা করতে পারিনি। এ মেয়ে এতো ভালো গাইতে পারে। গানের শেষ লাইনে এসে হাত তালিতে মুখর হয়ে ওঠে সারা হল। মিতুর গান শেষ হয়ে যায়। এখন বেরিয়ে যাবে মিতু। আমার ভেতর কোত্থেকে কে যেন বলে ওঠে বাইরে ওকে অপেক্ষা করতে বল অমু।
-আমি দরজার কাছে গিয়ে দাড়াই।
-মিতু, বাইরে একটু দাড়াও। আমি আসছি।
-সুধী মন্ডলী আমাদের আজকের নবীন বরণ অনুষ্ঠানের এখানেই সমাপ্তি। সবাইকে অজস্র ধন্যবাদ। সমাপ্তি ঘোষণা করে আমি তাড়াতাড়ি বাইরে আসি। হলের সমস্ত ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে যাচ্ছে। মিতু একটু দূরে দাড়িয়ে আছে। ওর ওড়নার প্রান্ত দুলছে। ওর কাছে গিয়ে দাড়াই। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে মিতু।
-মিতু, গত দুটো দিন আমার ভীষণ কষ্টে কটেছে। আমার কণ্ঠ আমিই চিনতে পারিনা।
-আমারও। চোখ তুলে তাকায় মিতু। চোখ দুটো ছলছল করছে যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে।
আমার বুকের ভেতরের পুরনো ঝড়টা থেমে গেছে।
আজ থেকে আমার ভালোবাসার নাম মিতু।