শিউলি ঝরা সকাল ।আশ্বিন মাসের শেষ দিক । বিলের জল
শুকালেই তবে সোজা পথে স্কুলে যাওয়া যাবে ।কাঠের ডোঙ্গায় বক্সীপুরের বাঁওড় পেরিয়ে ওদেরকে
তখন কুসুমপুর প্রাইমারী স্কুলে যেতে হয় । ওদের মধ্যে রাজন ফোরে ,শাওন টুতে আর রাজনের
ছোট ভাই বিভাস ওয়ানে পড়ে ।ভূপেন পাটনীর নৌকায় ওদেরকে বাঁওড় পাড় হতে হয় । ভূপেন পাটনী
মাথা পিছু এক কাঠা করে ধান নেয় বছরে ।শাওনের সঙ্গে রাজনের বেজায় ভাব, আবার বেজায় ও
আড়ি দুটোই সমান তালে চলে ।
শাওনা যেদিন
স্কুলে যায় না সেদিন রাজনের মনটা কেন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে ।তার মনে হয় শাওন একটা রঙিন
প্রজাপতি । তাদের স্কুলে এমনকি তাদের পাড়ায় শাওনে মত এমন ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে দ্বিতীয়টি
নেই । রাজনের ইচ্ছে হয় সারাদিন শাওনের সঙ্গে খেলাধুলো করতে।
সময় বয়ে যায়
। রাজন হাই স্কুলে ভর্তি হয় ।শাওন ক্লাস ফোরে ।হাই স্কুলে যেতে আরো দুবছর দেরি । রাজন
ভাবে, আর কিছুদিন গেলেই শাওন তাদের স্কুলে ভর্তি হবে। সে সময় শাওনের সঙেগ তার রোজই
দেখা হবে।
এখন বিকালে
শাওনের সঙ্গে প্রায় রোজই দেখা হয় রাজনের ।ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে রাজনরা খেলার মাঠে যায়
।ছোট থাকতে শাওনরা খেলতে আসতো ।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখনো লুকোচুরি খেলতে আসে ।রাজন ভাবে
,শাওন কি এতই বড় হয়ে গেছে যে তার খেলতে আসা মানা ।শাওন ক্লাস সিক্সে উঠার পর শাওন রাজনদের
স্কুলে ভর্তি হয় ।তাদের পাড়ার শাওন ছাড়াও আরো মেয়ে তাদের স্কুলে পড়ে।
শাওনদের পরিবারের
সঙ্গে রাজনদের পরিবারের সম্পর্ক ভাল । রাজনের কাছে শাওনের বায়নার অন্ত নেই ,দাসেদের
কদম গাছে বর্ষা শুরুতেই কদম ফুল ফুটে হলুদে ছেয়ে গেছে ।মগ ডালে উঠে রাজনের ফুল পাড়তে
সাহস হয় না ,মটকা ডাল ,ডাল ভেঙে পড়ে গেলে রক্ষা নেই ।কদম ফুল পেড়ে না দেওয়ায় শাওন রাজনের
সাথে কথা বলা বন্ধ !
রাজন
ভাবে ,শাওন আমার উপর রেগে আছে । দেখা যাক শাওন আমার উপর ক’দিন রেগে থাকতে পারে !
সেদিন ছিল রথাযাত্রা
।সকাল থেকে রথ সাজাতে রাজনের দাদারা ব্যস্ত । রাজনও তাদের কাছে হাত লাগায় । রথ সাজানোর
পর একগাদা কদম ফুল বেচে যায় ,অন্যদিকে গাঁদা ফুল আরো হলে ভাল হতো । রাজন বেচে যাওয়া
কদম ফুলের থেকে বেছে বেছে বেশ কয়েকটা দিয়ে একটা কদম ফুলের স্তবক তৈরি করে ।রাজন ভাবে,
,কদম পেড়ে না দেওয়া তার উপর শাওন গোসা করে
আছে ।এগুলো দিয়ে হয়তো শাওনের মান ভাঙাতে পারবে ।
রাজন ফুলের
স্তবকটা শাওনের পড়ার টেবিলে রেখে আসে তার অজান্তেই ।পরদিন শাওনকে দেখতে পায় তাদের পাড়ার
মেয়েদের সঙ্গে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে ।সে মেয়েদের সঙ্গেই স্কুলে আসা যাওয়া করে ।শাওনদের
ক্লাসের কঙ্কনা ও অধরা শাওনের চেয়ে শরীর স্বাস্থ্যে হৃষ্টপুষ্ট এবং একটু আধটু চালাক
চতুরও বটে ।কঙ্কনা শাওনকে বলে ,"তুই রাজনদাকে দেখে হাসলি কেন রে ,শাওন?তুই তো
কিছুদিন থেকে ওকে দুচোখে দেখতে পারছিলি নে ।"
“কেন হাসলাম
তা তোকে বুঝে কাজ নেই ।"
"সেদিন
তোদের বাড়ি থেকে রাজন গোলাপ ফুল নিতে এলে তুই তার সঙ্গে একটাও কথাও বলিসনি ,তা তো আমি
নিজের চোখে দেখেছি ।"
কঙ্কনার কথা
শুনে শাওন রেগে গিয়ে বলে ," এখন আমি বুঝতে পারছি তুই রাজনকে নিয়ে এতকথা বলছিস
কেন ?"
" তোর
রাজনকে নিয়ে আমার কোন কথা ভাবতে বয়ে গেছে !"
কঙ্কনার কথা
শুনে শাওন ভাবে ,রাজন ইদানিং তাকে এড়িয়ে চললেও আসলে সে কিন্তু তাকে ....,তা না হলে
ও আমার পড়া টেবিলে এক গোছা কদমফুল রেখে যাবে কেন ? শাওনের ইচ্ছে হয় এক গুচ্ছ লাল গোলাপ
রেখে আসতে ,কিন্তু সে লাল গোলাপ পাবে
কোথায়!
শাওনরা
ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠে। স্কুলের ড্রেস পরা শাওনকে দেখতে রাজনের খুব ভাল লাগে।
সবচেয়ে রাজনের ভাল লাগে শাওনের মাথার চুলের বেণী দুটো। রাজনের ইচ্ছে হয় তার শাওনের
চুলের বেণীতে লাল গোলাপ গুজে দিতে। এজন্যই রাজন দুটো টবে লাল গোলাপের চারা
লাগিয়েছে। রাজন ভাবে, সামনের বসন্তে তার গোলাপ গাছে ফুল ফুটবে।
দিনের পর দিন
গড়িয়ে যায় ।রাজন স্কুল ফাইনাল পাশ করে যশোরের এম.এম ,কলেজে ভর্তি হয় । এক সময় রাজনের
বাবা রজত দাশগুপ্তের হোস্টেলে রেখে ছেলেকে পড়ানোর সংগতি ছিল না ।হঠাৎ করেই রাজনদের
ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় ,রজত দাশগুপ্ত ডিভি লটারীতে আমেরিকায় যাবার সুযোগ পান । রাজনদের
পরিবার সুখের মুখ দেখে।দুই ছেলে রাজন ও বিভাসের পড়াশোনার সুবিধার জন্য ওদের মা
সুচরিতা দেবী তার বাপের বাড়ি কাছে যশোর শহরের ষষ্ঠীতলায় বাসা নেন ।
সামনে ইন্টার
পরীক্ষা রাজনের ।এদিকে সামনে শাওনেরও স্কুল ফাইনাল । শাওনের সঙ্গে রাজনে দেখা সাক্ষাত্
নেই বেশ দিন।গরমের ছুটিতে রাজন মা ও ভাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আসেন ।রাজনের বাড়ি আসার
খবরে শাওনের মনে কেন যেন রঙ লাগে !কিছুদিন ধরে তাদের ও শাওনদের পরিবারের মধ্যে একধরনের
টানা পোড়েনের চলছিল ।তাছাড়া গ্রাম্যদলাদলিও চরমে।রাজন তাদের দলের ছেলে না হলেও কিন্তু
শাওনের মন আনচান করে ওঠে রাজনকে দেখার জন্য ।
কঙ্কনা রাজনের
সঙ্গে শাওনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেয় ।সে রাজনকে বলে ,"তুই আমার সইকে পছন্দ
না করলেও সই কিন্তু তোর কথা ভাবে নিশিদিন।" রাজন জবাবে কী বলবে বুঝতে পারে না
।
রাজন শাওনকে
দেখে অবাক হয় ,মাত্র দেড় বজরের মধ্যে শাওন এত বড় হয়ে গেছে !এক সময় শাওন তাকে ঘোড়া হতে
বাধ্য করে পিঠে চড়তো এখন সে যেন পূর্ণ যুবতী !তার চেহারায় টগবগে যৌবনের উদ্যামতা ।রাজনের
সঙ্গে খুনসুটি কম করেনি শাওনের কাছে !
রাজন ইন্টার
পাশ করার পর রাজনের পরিবার গ্রামের পাঠ চুকিয়ে নিউইয়র্কে সেটেল্ট হবে খবরটা শুনে শাওনের
মনে কেন যেন অস্বস্তি দানাবেঁধে উঠে ।সে উপলব্ধি করে, অজান্তেই রাজনকে ভালোবাসে ফেলেছে
।
অনেক বছর পরের
কথা !রাজন এখন এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা । রাজনের বউ স্বাতী আমেরিকান বংশভূত বাঙালি
।আমেরিকায় থেকেও এক সময় রাজনের মন জুড়ে ছিল শাওন,সে স্বাতীর সঙ্গে গাটছড়া বাঁধার আগে
ভেবেছিল শাওনে কথা ।কিন্তু তা সে তার বাবা মাকে বলতে সাহস করেনি। এক সময় শাওনদের পরিবার
কলকাতায় পাড়ি জমায়।শাওনও কলকাতায় বসে রাজনের কথা ভেবেছে নিজের বিয়ের আগ পর্যন্ত ।
শাওনের জন্য
ছেলে দেখার কথা শুরু হলে সে তার অন্তরঙ্গ বন্ধু কঙ্কনাকে বলেছিল," রাজন আমেরিকায়
গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে আমি এখনো ভাবতে পারিনে ।"
"তোর প্রথম
ভালোবাসার মানুষটাকে তুই পাবার আশা ছেড়ে দে ।"
শাওনের ইচ্ছে
ছিল যে রাজন অন্য কাউকে বিয়ে করবে না ,না হয় সে অবিবাহিত থাকবে। শাওনের কোন যুক্তিই
ধোপে টেকে না ।রাজনের বন্ধু শোভনকে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয় ।শাওন এখন এক মেয়ের মা ।শোভনের
কাছ থেকে জানতে পারে রাজনরা পুজোয় কলকাতায় বেড়াতে আসছে।রাজনরা কলকাতায় আসছে জেনে শাওনের
মনটা নস্টালজিক হয়ে উঠে।আজ বিকালে রাজন ,রাজনের বউ ও ছেলেমেয়েরা শাওনদের ওখানে আসছে
। শাওন ড্রয়িংরুম সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছ ।রাজনারা বিকেলের দিকে এলে শাওনরা তাদের স্বাগত
জানায় । হঠাৎ শাওনের চোখ পড়ে ফ্রাওয়ার ভাসের দিকে, বিকেলে ভোরের ফুল ফ্রাওয়ার ভাসের
রাখা আছে দেখে শাওন কেন যেন মিয়িয়ে যায় ।